জোসেফ ওভারটন ছিলেন আমেরিকান প্রযুক্তিবিদ এবং একই সঙ্গে জুরিসপ্রুডেন্স বা আইনশাস্ত্রের পণ্ডিত, ২০০৩ সালে এক দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। নব্বইয়ের দশকে রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বোঝাতে গিয়ে তিনি একটি ‘জানলা’র ধারণা উদ্ভাবন করেছিলেন। সেই জানলা বাইরেটাকে দেখার জন্যে নয়, সে নিজেই একটি দ্রষ্টব্য। অনেক দিন সেটির কথা খুব বেশি কেউ জানত না। কিন্তু ইদানীং আমেরিকায় তো বটেই, বিশ্ব জুড়েই রাজনীতির আলোচনায় ‘ওভারটন উইনডো’ সুপরিচিত হয়ে উঠেছে। স্রষ্টা যে ভাবে ভেবেছিলেন, তার থেকে ধারণাটি কিছুটা সরে এসেছে, তবে সেই সূক্ষ্ম বিচারে আমাদের যাওয়ার দরকার নেই, বিশেষ করে ধারণাটি নিজেই যখন সরে যাওয়া নিয়ে।
হ্যাঁ, ওভারটনের জানলা হল স্বভাবত সরণশীল, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্লাইডিং’। এই ভাবে ভাবা যায় যে— সেই জানলায় একের পর এক ফ্রেম, কিছু বাইরে থেকে দেখা যায়, বাকিরা থাকে দু’দিকে, দেওয়ালে বিস্তৃত খাঁজের মধ্যে, চোখের আড়ালে। এক দিক থেকে ভিতরের ফ্রেমগুলো বাইরে এলে, অন্য দিকের ফ্রেম ভিতরে চলে যায়, ফলে জানলার রূপ বদলে যায়, যা ছিল এক ধারে বা দৃষ্টির বাইরে, সেটাই চলে আসতে পারে মাঝখানে। এ-বার মনে করা যেতে পারে, ফ্রেমগুলো যেন আসলে কোনও বিষয়ে রাজনৈতিক মতামত, একটা প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত অবধি সাজানো। যেমন ধরা যাক, একেবারে ডান দিকের ফ্রেমটি হল দক্ষিণপন্থার এক চরম রূপ, যা অর্থনীতি এবং সমাজকে অতিকায় পুঁজির হাতে বেবাক ছেড়ে দিতে বলে, আর একেবারে বাঁ দিকে আছে বামপন্থার একটা চরম ধারণা, যা অর্থনৈতিক সম্পদ, উদ্বৃত্ত এবং ক্ষমতায় সমাজের সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের সামূহিক অধিকার দাবি করে। এই দুইয়ের মাঝে নানা ছাঁদের সমাজদর্শন স্তরে স্তরে বিন্যস্ত। তেমনই আবার, কট্টর সাম্প্রদায়িকতা থেকে উদার ধর্মনিরপেক্ষতা অবধি বিভিন্ন অবস্থানকে পর পর সাজানো যেতে পারে। নানা বিষয়েই ধারণা বা মতাদর্শের এমন বিন্যাস সম্ভব।
সাম্প্রতিক কালে নানা দেশের রাজনীতির চরিত্রে চমকপ্রদ পরিবর্তনকে বুঝতে এই ধারণাটিকে কাজে লাগানো হয়েছে। যেমন আমেরিকায়। এক কদর্য এবং ভয়ানক অ-সভ্যতার প্রতিমূর্তি হিসেবে রাজনীতিতে অবতীর্ণ হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো এক জন লোক কী করে রকেটের গতিতে শিখরে পৌঁছে গেলেন, তা গোটা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়েছে। বিস্ময় স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর সাফল্যের ভিত তৈরি হয়েছিল আগেই। তথাকথিত দক্ষিণপন্থী পপুলিজ়ম-এর সেই প্রেক্ষাপটের বিচার বিশ্লেষণ অনেক হয়েছে, আমরা শুধু খেয়াল করব— সে দেশের রাজনৈতিক পরিসরে ওভারটনের জানলা অনেক দিন ধরেই সরে গিয়েছে। সরে গিয়েছে বিদ্বেষের পথ ধরে। অশ্বেতাঙ্গ, অভিবাসী, নারী, শ্রমজীবী— বিভিন্ন বর্গের প্রতি বিদ্বেষের বাতাবরণ ক্রমশই বহু লোকের স্বীকৃতি পেয়েছে, আগে যে হিংস্র অসভ্যতার প্রকাশ ভাবাও যেত না ক্রমশ সেটাই দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, আগে যা জনসমাজে ওভারটনের জানলার বাইরে ছিল, অ-দৃশ্য ছিল, ক্রমশ সেটাই সামনে এসেছে, এমনকি মাঝখানে পৌঁছে গিয়েছে। যা ছিল অবিশ্বাস্য, সেটাই হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক।
২০১৯ সালে প্রকাশিত অ্যান্টিসোশ্যাল নামক একটি বইয়ে আমেরিকান সাংবাদিক অ্যান্ড্রু মারান্জ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এই বিবর্তনের অসামান্য সব বিবরণ দিয়েছেন। যেমন, ২০১৬’র নির্বাচনের দিন নর্থ ক্যারোলাইনা প্রদেশের একটি ছোট গির্জার বাইরে বিকেলবেলায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। সেখানেই একটি ভোটকেন্দ্র হয়েছে। রাস্তার ধারে এক প্রবীণ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, তাঁর নাম ল্যারি, স্বভাবত হাসিখুশি, মিশুক, একটা ফ্লায়ার বিলি করছেন, আর নানা মানুষের সঙ্গে গল্প জুড়ছেন। বাইশ বছর সেনাবাহিনীতে ছিলেন তিনি, নিজের দেশটা তাঁর ভারী পছন্দের, কারণ এ দেশে যে কোনও মানুষ জীবনে যে কোনও জায়গায় পৌঁছতে পারে। ট্রাম্পকে নিয়ে তাঁর বক্তব্য: ‘আমি চাইব না ওই উন্মাদ লোকটা প্রেসিডেন্ট হোক, কিন্তু আমার মনে কারও প্রতি কোনও ঘৃণা নেই।’ এরই মধ্যে গির্জা থেকে বেরিয়ে এলেন এক শ্বেতাঙ্গ। পার্কিং লটের দিকে যেতে যেতে ওই কালো মানুষটির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং, তাঁকে শুনিয়ে শুনিয়ে স্বগতোক্তির ঢঙে একটা লম্বা লেকচার দিলেন। বক্তৃতার সারমর্ম: দেশটা তো শ্বেতাঙ্গদেরই, অন্যরা সেখানে আছে, থাকুক, কিন্তু সত্যি কথাটা এ-বার তাদের সাফ সাফ শুনিয়ে দেওয়া দরকার! ল্যারি মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে শুনলেন পুরোটা। এবং, লোকটি চলে যাওয়ার পরে মাটির দিকে তাকিয়েই বললেন, ‘গত বিশ-তিরিশ বছরে কখনও রাস্তাঘাটে এ রকম কথা শুনিনি। এখন ওরা হঠাৎ ভাবছে এগুলো জোরে জোরে বলা যায়।’
এমন পরিবর্তন অনেক দেশেই হয়েছে, চরম বিদ্বেষের প্রবক্তারা দেখতে দেখতে রাজনীতির মধ্যমঞ্চে বিরাজমান হয়েছেন। এই সে-দিনও যাদের ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট’ বলা হত, তারা এখন রীতিমতো ‘মেনস্ট্রিম’। আমাদের দেশে তো ওভারটনের জানলা গত কয়েক বছরে এতটাই সরে গেল যে ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট’ কথাটাই এখন আর বিশেষ শুনি না। দশ বছর আগেও যা প্রকাশ্যে বলার কথা কেউ ভাবতে পারত না, এখন তা শতবীণাবেণুরবে বারংবার কীর্তন করা হচ্ছে, ‘গোলি মারো’ ইত্যাদি বচন হয়তো অচিরেই জাতীয় স্লোগান হিসেবে বন্দিত হবে, সরকারি অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সঙ্গীতও হয়ে উঠতে পারে। আর, আমাদের রাজ্যে? এখানে নির্বাচনের ঠেলায় সেই পরিবর্তনের হাওয়া গত কিছু দিন ধরে যাকে বলে খরবায়ু বয় বেগে। পশ্চিমবঙ্গের বুকে ভোটের সভা থেকে যে ভাবে দিনে দু’বেলা ‘পাকিস্তানি’ ‘পাকিস্তানি’ রব তোলা হচ্ছে, জয় শ্রীরামের বন্যায় শান্তিপুর ডুবুডুবু ন’দে ভেসে যাচ্ছে, নির্বাচনী প্রচারের অঙ্গ থেকে ডুমুরপাতাটুকুও খসে পড়েছে, সেটা আমরা অনেকেই কিছু দিন আগেও ভাবতে পারিনি। এটাই বোধ করি ‘আসল পরিবর্তন’-এর আসল প্রকল্প।
প্রশ্ন হল, সে প্রকল্প কতটা হাসিল হয়েছে? চতুর্দিকে মেরুকরণ মেরুকরণ শুনতে শুনতে আশঙ্কা অস্বাভাবিক নয় যে, বঙ্গসমাজে ওভারটনের জানলাটি বুঝি বেবাক পাল্টেই গেছে, ধর্মপরিচয়ের ঠুলিই চোখে এঁটে নিয়েছি আমরা, অন্য সব পরিচয়, সব সমস্যা, সব প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। সে-আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার জো নেই। তবে কিনা, ব্যাপারটা এমন নয় তো, যে, মেরুকরণ ঘটিয়ে তোলার অভিসন্ধিতেই এতটা জোর গলায় ‘ওরেব্বাবা, কী প্রচণ্ড মেরুকরণ’ বলে প্রচারের ঢাক বাজানো হচ্ছে, আর আমরাও সেটাই সত্য বলে মনে করছি? সমাজের মনও তো কিছুটা শেয়ার বাজারের মতো, সবাইকে যদি বিশ্বাস করানো যায় যে শেয়ারের দাম বাড়বে, তবে শেয়ারের দাম সত্যিই বাড়ে। জানলার ফ্রেম সরাতে জোর ঠেলাঠেলি চলছে, তা তো দেখাই যাচ্ছে, কিন্তু সে চেষ্টা সত্যিই কতটা সফল হল, সেটা এখনও প্রমাণসাপেক্ষ।
তার মানে এই নয় যে, নিশ্চিন্ত এবং নিশ্চেষ্ট থাকার কোনও অবকাশ আছে আমাদের। একেবারেই নেই। ধর্ম বা জাতপাত দিয়ে মানুষকে ভাগ করার দুরভিসন্ধি সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করা দরকার। মানসিক মেরুকরণের উর্বর জমি এই সমাজে বিস্তর। সেখানে বিদ্বেষের বীজ ছড়াতে দিলে বিষবৃক্ষের বিস্তার অবশ্যম্ভাবী। নির্বাচনের পালা আর ক’দিন বাদে মিটবে। কিন্তু বিষবৃক্ষ নির্মূল করার লড়াই শেষ হতে পারে না, বরং নির্বাচনী বাধ্যবাধকতার দায় মিটলে লড়াই আরও অনেক বেশি জোরদার এবং সংহত করার সুযোগ আসবে। আমরা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার কতখানি করতে পারব, তার ওপর নির্ভর করছে আমাদের ওভারটনের জানলাখানির চেহারা কেমন দাঁড়াবে। অ্যান্ড্রু মারান্জ তাঁর বইয়ের উপসংহারে লিখেছেন, অন্ধকারের কারবারিরা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু তারা ব্যর্থ হবে কি না সেটা নির্ভর করছে আমাদের ওপর। ইতিহাসের বঙ্কিম পথটির গতি ন্যায়ের দিকে— মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই ঐতিহাসিক উক্তির সূত্র ধরে অ্যান্ড্রুর সংযোজন: সে-পথ নিজে নিজে ন্যায়ের দিকে ঘোরে না, আমরাই তাকে ঘোরাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy