যুবকটির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল এক পর্যটন মেলায়। সেখানে জম্মু-কাশ্মীর পর্যটনের স্টলে তিনি ও তাঁর সতীর্থরা ভূস্বর্গে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন। বলছিলেন, পর্যটকদের জন্য কোথাও কোনও সমস্যা নেই। কাশ্মীর তার দরজা খুলে রেখেছে। শুধু রাস্তায় কখনও প্রশ্ন করতে পারেন ফৌজিরা, কোথায় যাবেন? কোথা থেকে আসছেন? যখনই শুনবেন পর্যটকদের গাড়ি, তখন আর কোনও সমস্যা নেই।
খানিকটা যেন অস্ফুটে সেই যুবক বলে ওঠেন, “এত দাম দিয়ে শান্তি কিনতে হচ্ছে, এটুকু অসুবিধা তো কিছুই নয়। কিন্তু আমাদের কাশ্মীরের তুলনা সারা দুনিয়ায় নেই।” এত দাম দিয়ে শান্তি কেনা মানে! বিস্ময়বোধক প্রশ্নে প্রশ্নকর্তাকে কয়েক সেকেন্ড মেপে নেন যুবক। বলেন, “এত সেনা, এত সাঁজোয়া গাড়ি, এত লোকলস্কর, তার খরচ নেই? তা ছাড়া, বন্দুকের নল আকাশে উঁচিয়ে থাকলে শান্তি তো থাকবেই।” আর এত কিছু না থাকলে বা
কমে গেলে? “ভাল প্রশ্ন। কিন্তু উত্তরটা আমাদের জানা নেই।”
না কি, উত্তরটা ভূস্বর্গের ভালই জানা আছে? সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ও ৩৫ (এ) অনুচ্ছেদ বিলোপের সময় ও আজকের মধ্যে ব্যবধান চার বছরের। সেই ২০১৯-এর ৫ অগস্ট সংসদে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খারিজ করে দেন। পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত গোটা কাশ্মীরকে মুড়ে ফেলা হয় সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা বলয়ে। গত চার বছর ধরেই চলছে নির্বিচার ধরপাকড়। দীর্ঘ কাল ধরে কার্যত বিনা বিচারে আটক রাখার জন্য প্রয়োগ করা হচ্ছে কুখ্যাত জম্মু-কাশ্মীর জনসুরক্ষা আইন। অভিযোগ উঠছে, জনসুরক্ষা আইনে বন্দিদের মামলার শুনানি প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইচ্ছাকৃত ভাবে নানা টালবাহানায় পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে তাঁদের মুক্তি ত্বরান্বিত না হয়। অসংখ্য বন্দিকে উপত্যকার গণ্ডি পার করিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ভিন রাজ্যেও, যাতে তাঁদের আত্মীয়পরিজন সহজে খোঁজ না পান।
অথচ, কাশ্মীর নাকি এখন শান্তি পারাবার। লোকজন নিশ্চিন্তে চলাফেরা করছে। ভূস্বর্গে পর্যটকের ঢল নেমেছে। সব কিছুই যেখানে এত ‘স্বাভাবিক’, সেখানে ‘শান্তি’ রাখতে এত বিপুল আয়োজন কেন? কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রক্ষায় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের সিদ্ধান্ত আদৌ সাংবিধানিক কি না তা বিবেচনা করে দেখতে গত চার বছরে ইতিমধ্যেই গুচ্ছ গুচ্ছ মামলা দায়ের হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। আদালতের রায়ের জন্য স্বাভাবিক ভাবেই অপেক্ষা করতে হবে আরও বেশ কিছু কাল।
কাশ্মীরে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ) এবং জনসুরক্ষা আইনের এত ব্যাপক হারে প্রয়োগ দেখলে মনে হয়, উপত্যকায় শুধু জঙ্গি এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই থাকে। ইতিহাসের দিকে এক বার মুখ ফেরানো যাক। ১৯৫৪-তে দলীয় নথিতে তৎকালীন জনসঙ্ঘ (অধুনা বিজেপি) বলেছিল, গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে নাগরিক অধিকার বলতে যা বোঝায়, জনসঙ্ঘ সেই অধিকার রক্ষার পক্ষে দাঁড়াচ্ছে। যারা হিংসায় বিশ্বাস করে তারা ছাড়া বাকি দলগুলির ও প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতার জন্য এই সংগঠন কাজ করে যাবে। জনসঙ্ঘ আরও বলেছিল, ব্যক্তিস্বাধীনতার নীতির বিরুদ্ধাচরণ করে এমন সতর্কতামূলক আটক আইন বাতিল করার জন্যও তারা ব্যবস্থা করবে। ১৯৫৮-র নির্বাচনী ইস্তাহারে জনসঙ্ঘের প্রতিশ্রুতি: তৎকালীন সরকার (কংগ্রেস) যে সতর্কতামূলক আটক আইন এবং জনসুরক্ষা আইন প্রয়োগ করছে, তারা সে সব বাতিল করে দেবে।
শুনতে বড় ভাল লাগে। ঠিক যেমন ভাল লাগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের প্রতিশ্রুতি শুনেও, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই কাশ্মীরের পৃথক রাজ্যের মর্যাদা আবার ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কাকে বলে ‘স্বাভাবিক’ পরিস্থিতি? অন্ধকারে, হতাশায়, বেয়নেটের ধারালো খোঁচার সামনে কুঁকড়ে থাকা সেই কাশ্মীর কি স্বাভাবিক? যদি স্বাধীন মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করার সর্বাত্মক প্রয়াস ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা হয়, কথায় কথায় সাংবাদিকদের থানায় বা গোয়েন্দা দফতরে অথবা স্থানীয় পুলিশ চৌকিতে ডেকে পাঠিয়ে লাগাতার জেরা করাটা ‘স্বাভাবিক’ হয়, অপছন্দের বা ‘দেশবিরোধী’ খবরের সোর্স সম্পর্কে অনুপুঙ্খ জানতে চাওয়া হয়, সাংবাদিকদের শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহ করার অসংখ্য অভিযোগ ওঠাটা ‘স্বাভাবিক’ হয়, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়ে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে উপত্যকার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়াটা ‘স্বাভাবিক’ হয়, যেমন, ২০২২-এই অন্তত ২৪ বার এখানে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তা হলে কাশ্মীর অবশ্যই ‘স্বাভাবিক’!
ঠিক যেমন ‘স্বাভাবিক’ ছিল চার বছর আগে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের ঠিক পরেই শ্রীনগরের রাস্তায় বিরিয়ানি খেতে খেতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের ‘সাধারণ’ মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতাও! ঠিক এ রকম স্বাভাবিকতাই তো চান মোদী-শাহ-ডোভালরা। হ্যাঁ, যা করেছেন তাঁরা, সংখ্যাগরিষ্ঠতার অঙ্ক মেনেই করেছেন। ঠিক যে ভাবে ‘আইন মেনে’ই মোদী-পদবি সংক্রান্ত মানহানির মামলায় সুরাতের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট রাহুল গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করে দু’বছর কারাদণ্ড দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর সাংসদ পদ খারিজ করে দেওয়া হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ না দিলে পরিস্থিতি কী হত তা অবশ্য ভিন্ন প্রশ্ন।
কাশ্মীরে তিন দশকেরও বেশি সাংবাদিকতা করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অনুরাধা ভাসিন তাঁর আ ডিসম্যান্টলড স্টেট/ দি আনটোল্ড স্টোরি অব কাশ্মীর আফটার আর্টিকল ৩৭০ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন সেই মিথ্যাচারের। ২০১৯-এর ৬ অগস্ট লোকসভায় বিরোধীরা যখন কাশ্মীরের নির্বাচিত সাংসদ ফারুক আবদুল্লার অনুপস্থিতি সম্পর্কে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন, জানতে চাইছেন তিনি গ্রেফতার হয়েছেন কি না, সে সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ফারুককে আটক বা গ্রেফতার, কিছুই করা হয়নি। তিনি স্বেচ্ছায় বাড়িতেই রয়েছেন। শাহের বক্তব্যের সারবত্তা খুঁজতে তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই ফারুকের বাড়ি পৌঁছন সাংবাদিকরা। ফারুক তাঁদের বলেন, তাঁকে জোর করে আটক করা হয়েছে।
গত চার বছরে কাশ্মীর এত ‘স্বাভাবিক’ হল, অথচ রাষ্ট্রের লৌহমুষ্টি স্বাভাবিক হল না! শেষ হল না ভূস্বর্গের ক্ষয়াটে, বিষণ্ণ মুখে পমেটম মাখানোর কাজটিও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy