—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
বাংলার রাজনীতিতে কি মেয়েবেলা শুরু হল? নারীপক্ষের সূচনা হল? নিন্দুক-সমালোচকদের কথা তোলা থাক, বরং সম্ভাবনাটা নিয়ে ভাবা দরকার।
এই ছোট লেখা অসংখ্য লেখার পর লক্ষ্মীর ভান্ডার নিয়ে বা নির্বাচনে তার প্রভাব নিয়ে আর একটা লেখা নয়। সাংবাদিক ও প্রাত্যহিক পর্যবেক্ষকরা সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে বাংলায় জনবাদীদের জয়কে প্রায় এক কারণজনিত বলে ঘোষণা করেছেন। যেন, সারা বাংলার ভাগ্য নির্ধারণ করেছে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প। এই প্রকল্পের গুরুত্ব সবাই জানেন বাংলার সাধারণ নারীজীবনে। তাই এ নিয়ে পুনরুক্তি অর্থহীন। কিন্তু এই সক্রিয়তা কি এই লক্ষ্মীর ভান্ডারেই সীমাবদ্ধ? আর একটু বড় ভাবে ভাবার সুযোগ কি নেই?
সমগ্র দেশে এই বার নির্বাচনে পুরুষ ভোটদাতাদের ৬৫.৮ শতাংশ ভোট দিয়েছিল, অন্য দিকে নারী ভোটদাতাদের ৬৫.৭৮ শতাংশ ভোট দেয়। ১৯৬২-তে এই শতকরা হিসাব ছিল যথাক্রমে ৬৩.৩১ শতাংশ এবং ৪৬.৬ শতাংশ। ২০১৯-এ এই হিসাব হয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬৭.২ শতাংশ এবং ৬৭.১৮ শতাংশ। ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে যে, মেয়েরা বিভিন্ন প্রদেশে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কী ভাবে অধিক হারে নির্বাচনে যোগ দিতে এগিয়ে এসেছে। বাংলায় এই চেহারা আরও পরিষ্কার।
এই বারের ভোটে দক্ষিণপন্থী শাসক দলের আসন জেতার ক্ষমতা ক্রমাগত কমেছে। প্রথম পর্বে তারা ৩৯ শতাংশ আসন জিতেছে মোট ৭৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ও তৃতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ঘৃণাভাষণ ও উত্তেজক প্রচারের সাহায্যে জয়ী আসনসংখ্যা বেড়েছিল যথাক্রমে ৬৭ ও ৭০ শতাংশ। পঞ্চম পর্যায়ে তা আবার নেমে যায় ৪৫ শতাংশে ও শেষ বা সপ্তম পর্যায়ে ৩৫ শতাংশে। মোট জেতা আসনসংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় ৫৪ শতাংশ। ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদ হয়তো স্বীকার করে নেবেন যে, একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে প্রধান সামাজিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে মেয়েরা।
পশ্চিমবঙ্গে ঐতিহাসিক ভাবে রাজনৈতিক উদ্দীপনা অন্যান্য প্রদেশ থেকে বেশি এবং নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, এই বার নির্বাচনে তারা পশ্চিমবঙ্গে ১,১৯,২৭৬টি আবেদন পেয়েছিল সভাসমিতি, শোভাযাত্রা ইত্যাদির জন্য। সংগঠিত মিটিং, শোভাযাত্রা ইত্যাদির প্রকৃত সংখ্যা ছিল ৯৫,০০০। যেন সবাই রাস্তায় নেমে আসতে চেয়েছিল ভোট দিতে। প্রথম পর্যায়ে ৮১.১১ শতাংশ ভোটার বাংলায় ভোট দিয়েছিল, সারা দেশের হিসাবে এই শতকরা সংখ্যা ছিল ৬৬.১৪। দ্বিতীয় পর্যায়ে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৭৬.৫৮ শতাংশ এবং ৬৬.৭১ শতাংশ। তৃতীয় পর্যায়ে ৭৭.৫৩ শতাংশ এবং ৬৫.৬৮ শতাংশ। চতুর্থ পর্যায়ে ৮০.২২ শতাংশ এবং ৬৯.১৬ শতাংশ। পঞ্চম পর্যায়ে যথাক্রমে ৭৮.৪৫ ও ৬২.২ শতাংশ, ষষ্ঠ পর্যায়ে ৮২.৭১ শতাংশ এবং ৬৩.৩৭ শতাংশ। এবং শেষ পর্যায়ে ৭৩.৩৬ শতাংশ ও ৬১.৬৩ শতাংশ। এ কি দরিদ্র জনসাধারণের উন্মাদনা? না অন্য কিছু?
নারীসমাজ যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অনন্য মাত্রায়। গরম, রোদ, বন্যা, জলে ভরা রাস্তা, ছোট খাল, সব পেরিয়ে মেয়েরা এসেছিল। দু’জনের মৃত্যু ঘটেছে। ২০২৪-এর নির্বাচনে মোট প্রার্থীর ৯.৬ শতাংশ ছিল মেয়েরা। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল দলের ৪২ জন প্রার্থীর মধ্যে নারী-প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ১২। শতাংশের হিসাবে ধরা যায় ২৫। ভারতীয় জনতা পার্টির ক্ষেত্রে এই শতকরা হিসাব ছিল ১৬। নারীদের ভোটদানের অংশ দেখলে এই চেহারা আরও বোঝা যাবে। নারীরা পুরুষদের চেয়ে ৩ শতাংশ বেশি ভোট দিয়েছে। তমলুক, কাঁথি, ঘাটাল, মেদিনীপুর, বাংলার এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নারীসমাজ ভোট দিয়েছে ব্যাপক হারে। গ্রামবাংলার ধুলোমাটির রাস্তায় কিশোরী থেকে প্রবীণা সবাই নেমে এসেছে, বসে থেকেছে, প্রতিবাদে মুখর হয়েছে।
যে অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্য সম্পদ আহরণকেন্দ্রিক প্রক্রিয়া, সেই অর্থনীতিতে মেয়েদের খাটতে হয় পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি। তাদের শোষণ চলে অধিক হারে। হাজার লক্ষ শ্রমিক যখন পরিযায়ী হয়ে যায়, মেয়েরা ঘর সামলাতে থাকে। ঘর সামলায় মা, মেয়ে, বৌ, বোন। কৃষিসঙ্কটের ধাক্কা সামলায় মেয়েরা। মনে রাখতে হবে সমগ্র দেশে অবৈধ বিবাহের (মূলত শিশুবিবাহ) ১৫.২ শতাংশ ঘটে পশ্চিমবঙ্গে। সমীক্ষা বলছে, ১৫-২৪ বছরের মেয়েদের ৪৯.৯ শতাংশ বাড়িতে থাকে, স্কুলে তারা যায় না। তারাই আসলে বাংলার গৃহ-অর্থনীতির বোঝা সামলায়। জাতীয় সংখ্যাও কহতব্য কিছু নয়। তবু এই রাজ্য থেকে কিছু ভাল। এমনকি আমাদের গর্বের কন্যাশ্রী প্রকল্পও মেয়েদের এই দুর্দশা থেকে বাঁচাতে পারেনি।
কাজেই বিস্মিত হব কেন যখন মেয়েরা এগোচ্ছে অনেক বেশি উৎসাহে, উদ্দীপনায়? অথবা সরকারি সাহায্য ও কল্যাণকামী পদক্ষেপ তাদের মনে এক অভূতপূর্ব অনুরণন সৃষ্টি করে? ‘খেলা হবে’ ধ্বনি উঠলে সহস্র নারীকণ্ঠে সেই আহ্বানের সাড়া শোনা যায়? মেয়েরা সাড়া দেয় জনবাদী সরকারের কথায়, বিশেষত এক মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিতে। এই প্রতিশ্রুতি অব্যর্থ নয়, এই ডাকও স্পষ্ট নয়, কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে এই অর্থ পৌঁছে যায় বা গেছে। জনবাদীরা সক্ষম হয়েছেন আপাতদৃষ্টিতে অঞ্চল, জাতি ও পেশা নির্বিশেষে মেয়েদের জড়ো করতে। রাজনীতির জন্য নারীসমাজ সৃষ্টিতে যে কাজ বামপন্থীরা তাঁদের দীর্ঘ গণআন্দোলন ও পরিশ্রমের মাধ্যমেও এই ভাবে সক্ষম হননি। যদিও এই শতাব্দীর গোড়ায় ভিখারি পাসোয়ানের সহসা মৃত্যুর প্রতিবাদে চটকলগুলিতে নারী সমাবেশ, তার পর সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের যে সাম্প্রতিক ইতিহাস, তার ভিত্তি রূপে কাজ করেছে দীর্ঘ জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী কর্মোদ্যোগ।
শুধু সরকারি প্রকল্পে কি কাজ হত, যদি জনবাদী রাজনৈতিক বোধ না থাকত? আশাকর্মী, অভিনেত্রী, চিকিৎসক, প্রশাসক এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের দুঁদে কর্মী, সবাইকে সমবেত করে নির্বাচনের নারী-প্রার্থী বাহিনী তৈরি করেছেন জনবাদীরা। এই রসায়ন অনেকটাই দুর্জ্ঞেয়। নির্বাচনী সমাবেশের অর্থ শুধু ভোট দেওয়া নয়, প্রার্থীর কথা শোনা, সেই দল বা সরকারের নীতি বিবেচনা, এবং অনেক ক্ষেত্রেই সাময়িক বক্তব্য অথবা ঘটনার বিচার করা। এই প্রেক্ষিতে মেয়েদের ভোটদানকে পর্যবেক্ষকরা এক-এক জন নারী ভোটদাতার ভোটদান রূপে দেখেন, নারীসমাজের সমাবেশ রূপে দেখতে তাঁরা সম্মত হন না। সাধারণ সমাজ হতে পারে, তা বলে নারীসমাজ? অথচ, জনবাদী রাজনীতি ঠিক এখানেই বামপন্থী চিন্তাপদ্ধতি থেকে অন্য পথে গেছে। বামপন্থীরা নারী-শ্রমিক, শ্রমজীবী নারী, চাকরিজীবী নারী, এই রকম পেশা ও শ্রেণিভিত্তিক সংগঠন তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিলেন। নারীসমাজ রূপে এক সমগ্রকে জনরাজনীতির পরিসরে আনার চিন্তা থাকলেও, তা ছিল কম।
তাই বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যখন দেখা যায়, সমগ্র দেশে পুরুষ ও নারী ভোটদাতাদের শতাংশ প্রথম পর্বে ছিল যথাক্রমে ৬৬.২২ শতাংশ ও ৬৬.০৭ শতাংশ, এবং পশ্চিমবঙ্গে এই শতকরা সংখ্যা ছিল ৮১.২৫ ও ৮২.৫৯। সাতটি পর্ব জুড়ে বাংলায় মেয়েরা বেশি হারে ভোট দিয়েছে। তৃতীয় পর্বে সারা দেশের ওই শতকরা সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৬৬.৮৯ শতাংশ এবং ৬৪.৪১ শতাংশ। বাংলায় ওই একই পর্বে আনুপাতিক সংখ্যা ছিল ৭২.২১ শতাংশ এবং ৮৩.০১ শতাংশ। চতুর্থ পর্বে এই সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় দেশের ক্ষেত্রে ৬৯.৫৮ শতাংশ এবং ৬৮.৭৩ শতাংশ, বাংলায় যথাক্রমে ৭৯ এবং ৮১.৪৯ শতাংশ। ষষ্ঠ পর্যায়ে এই তারতম্য থেকে যায়। দেশের ক্ষেত্রে ওই সংখ্যা ছিল ৬১.৯৫ শতাংশ এবং ৬৪.৯৫ শতাংশ। বাংলায় ৮১.৬২ শতাংশ এবং ৮৩.৮৩ শতাংশ।
স্পষ্টতই, নির্বাচনে অধিক হারে গণ অংশগ্রহণের অধিক মানুষের যোগদান, অধিক সংখ্যায় নারীর যোগদান, লক্ষ লক্ষ সংখ্যায় দৈহিক অংশগ্রহণ। এ যেন এ সামাজিক যুদ্ধ, যা চলছিলই, আরও তীব্র হল। এ বারে মাথা ঠান্ডা রাখা আরও শক্ত ছিল। প্রতি দিন সংখ্যালঘুদের অপমান, যে কোনও প্রতিবাদকে ‘শহুরে নকশাল’ বলে আখ্যায়িত করা, নির্বাচন মিটলে প্রতিশোধের হুমকি, এবং এই যৎসামান্য সরকারি কল্যাণ প্রকল্পগুলিকেও বন্ধ করার কথা ঘোষণা, এর সামনে মন শক্ত করে, সংগঠিত ভাবে ভোট দেওয়া সহজ ছিল না। বাংলার মেয়েরা তা করেছে। আগামী যুগের ইতিহাসবিদ সম্ভবত বলবেন যে, স্বৈরতন্ত্রের অগ্রগতি নারীসমাজ প্রতিহত করেছে। বাংলায় রাজনীতির মোড়কে সামাজিক যুদ্ধ চলছে। দেখা যাচ্ছে, জনবাদীরা রাজনৈতিক উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে তাঁরা চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে যাচ্ছেন।
প্রশ্ন হল, তাৎক্ষণিক বোধ, কৌশলগত বিচার ও উদ্ভাবনী শক্তির ভিত্তিতে জনবাদী রাজনীতি যে ভাবে নারীসমাজকে সঙ্ঘবদ্ধ করছে, বামপন্থীদের পথের সঙ্গে তার যে পার্থক্য, তা কি অনপনেয় থেকে যাবে? এই দুইয়ের মাঝে কি সংলাপের ভূমিকা নেই? সম্ভবত বাংলার নারীসমাজের রাজনৈতিক জীবনই এই প্রশ্নের উত্তরের দিশা। জৈব রাজনীতি বাংলায় আজ রাজনীতির মূল রূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী ছাড়া এই রাজনীতি জৈব রাজনীতি হয়ে উঠত না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy