আপাত নিস্তরঙ্গ বঙ্গসমাজে তিনিই কেকের উপর আসল ‘চেরি’। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মঙ্গলবার দুপুরের সামান্য আগে ইথারে আচম্বিতে কাটা-কাটা এবং স্পষ্ট, প্রায় বাচিকশিল্পী-সুলভ উচ্চারণে ভেসে এল, ‘‘ওই টাকা আমার নয়! আমার অনুপস্থিতিতে এবং আমার অজান্তে আমার ঘরে টাকা ঢোকানো হয়েছে!’’
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, কোথাও একটা ক্লান্তি আসছে কি? নৈঃশব্দ্যের ক্লান্তি? পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ওই টাকা তাঁর নয়। অর্পিতা মুখোপাধ্যায় বলছেন, ওই টাকা তাঁর নয়। তা হলে ওই বিপুল টাকা কার? নীরবতা। নৈঃশব্দ্য। ক্লান্তিকর নৈঃশব্দ্য।
কিন্তু সেই নৈঃশব্দ্য এবং সেই নৈঃশব্দ্যজনিত ক্লান্তি চুরমার হয়ে যাচ্ছে এক নারীর উপস্থিতিতে। আপাত নিস্তরঙ্গ বঙ্গসমাজে তিনিই কেকের উপর আসল ‘চেরি’।
পার্থ-কাহিনি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই মনে হচ্ছিল, অর্পিতা নাম্নী এই নারী এই কাহিনিতে না-থাকলে (মানে তেমন নুন-মশলা না থাকলে) কি আমরা হামলে পড়ে এই নাটক গপগপিয়ে গিলতাম? এক অগ্রজ হিতৈষী একবার বলেছিলেন, ‘‘গিরিশ ঘোষ বলতেন, সেকেন্ড অ্যাক্টো হয়ে গেল। এখনও স্টেজে মেয়ে এল না? এ বার লোক উঠে যাবে তো!’’
মনে হচ্ছিল, ‘বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের গ্যারিক’ শুধু মেধাবীই নয়, ভূয়োদর্শী ছিলেন। ঠিকই বলেছিলেন। পার্থ-নাটকে অর্পিতা হলেন সেই দ্বিতীয় অঙ্কের নারী। যিনি মঞ্চে এসে না-পড়লে সম্ভবত এতখানি ‘হিট’ হত না এই পালা। এসএসসি দুর্নীতি নাটকের প্রথম অঙ্কে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থকে দিনভর জেরার পর সন্ধ্যায় দ্বিতীয় অঙ্কে এসে হাজির হয়েছিলেন অর্পিতা এবং তাঁর ফ্ল্যাটে কাঁচা, নগদ টাকার পাহাড়। সেই দ্বিতীয় অঙ্ক থেকে লোক ভেঙে পড়ল থিয়েটারে। যে লোক উঠছে না। বরং প্রতিদিন বাড়ছে। আর জুলজুল করে দেখছে, কখনও অর্পিতা গাড়িতে বসে হাউহাউ কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। কখনও রাস্তায় বসে পড়ছেন। কখনও হুইলচেয়ারে বসে হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে বলছেন, ‘‘পারছি না! আমি আর পারছি না!’’ আবার কখনও স্পষ্ট উচ্চারণে, শান্ত হয়ে বলছেন, ‘‘ওই টাকা আমার নয়। আমার অনুপস্থিতিতে এবং আমার অজান্তে আমার ঘরে টাকা ঢোকানো হয়েছে।’’ তার কিছুক্ষণ পর তিনি গাড়িতে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।
দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় দেখছি, আনন্দবাজার অনলাইনে অর্পিতা সংক্রান্ত খবর পাতে পড়তে পারছে না। দেওয়া হচ্ছে কি ফুলকো লুচির মতো টপাটপ উড়ে যাচ্ছে! স্বাভাবিক। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানুষ মূলত ভালবাসে অন্যের জীবনের কেচ্ছা। অন্যের খারাপ থাকায় আমরা ভাল থাকি। ফলে লোক আসছে। আরও লোক আসছে। তারা রাত জাগছে। আলোচনা করছে। রেগে যাচ্ছে। তর্ক করছে। বিতণ্ডায় অংশ নিচ্ছে। দ্বিতীয় অঙ্কের নারীকে দেখতে লোক বাড়ছে।
সেই লকলকে ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে কলকাতা শহরের রাজপথে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অনাহারে, অর্ধাহারে বসে-থাকা হা-ক্লান্ত কিছু নাচার চেহারা। হারিয়ে যাচ্ছে সরকারি চাকরির পরীক্ষার মেধাতালিকায় নাম তুলেও বঞ্চিত হওয়ার যন্ত্রণা। তাঁদের হাতে কাঁচাহাতের লেখা দাবিদাওয়া সংবলিত প্ল্যাকার্ড। কণ্ঠে আকুতি। মগজে চিন্তা পিছনে ফেলে-আসা দিন আনি-দিন খাই সংসারের।
দ্বিতীয় অঙ্কের নারী এসে গিয়েছেন। পিচ রাস্তায় বসে-থাকা দীনহীন, ঝোলা-সম্বল কিছু অবয়ব ধূসর আর ঝাপসা হয়ে গিয়েছে কবে!
বাবা ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরে। তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর চাকরিটা পেতে পারতেন অর্পিতা। সে চাকরি তিনি করেননি। অত অল্পবয়সে সরকারি চাকরিটি না নেওয়ার কারণ কী? আমরা ঠিকঠাক জানি না। সম্ভবত সরকারি চাকরি তাঁর উচ্চাশাকে বেঁধে রাখার মতো জোরালো ছিল না। মডেলিং করতেন। তার পরে অভিনয়। উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। থাকবে না-ই বা কেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষা তো কোনও অপরাধ নয়। কিন্তু কোন পথে সেই ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে হয়, সেই ন্যায়-অন্যায়ের বিভাজনরেখাটা কোথাও একটা ঝাপসা হয়ে যায়। সম্ভবত অভীপ্সার তাড়সেই।
অর্পিতার যে ছবি তাঁর বিভিন্ন মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে এবং যে সমস্ত ছবি এবং ভিডিয়োর সম্ভার তাঁর ফেসবুক জুড়ে রয়েছে, তাতে তিনি লাগসই মাপের লাস্যময়ী। মুখখানা ঈষৎ কঠোর বোধহয়। হনুর হাড় জায়গা মতো উঁচু। চোয়ালের রেখা অতটা খর না-হলেও মোটামুটি দৃশ্যমান। একঝলক দেখলে ডানাকাটা পরি বলে মনে হয় না ঠিকই। কিন্তু একেবারে হ্যাক ছি-ও বলা যায় না। একটা আলগা চটক আছে।
সেই অর্পিতা জড়িয়ে গেলেন পার্থের সঙ্গে। শোনা যায়, কোনও এক প্রমোটার যোগাযোগটা করিয়ে দিয়েছিলেন। হতে পারে। না-ও পারে। তবে যোগাযোগটা হতই। এই ধরনের যোগাযোগ হয়ে যায়। প্রমোটার না হলে ডেভেলপার। ডেভেলপার না হলে উমেদার। উমেদার না হলে ক্ষমতার কাছাকাছি সতত সঞ্চরমান ফড়ে। ফড়ে না হলে ক্ষমতাবানের ‘সাইডকিক’। কেউ না কেউ। কারণ, ক্ষমতার দরজার কলিং বেলে কখনও ধুলো জমে না। কেউ না কেউ এসে ঠিক আঙুল রাখে।
যেমন অর্পিতা রেখেছিলেন। ওড়িয়া ছবিতে অভিনয়, টালিগঞ্জের কিছু ভুলে যাওয়ার মতো ছবিতে চোখে না-পড়ার মতো ভূমিকায় বিচরণ, ছুটকোছাটকা মডেলিং— এই ছিল তাঁর কেরিয়ার। আলগা চটক ছিল। কিন্তু ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা ছিল না।
পার্থের সঙ্গে অর্পিতা কি একটা নিশ্চিন্ত ভবিষ্যতের কামনায় জড়িয়ে গেলেন? একের পর এক যৌথ উদ্যোগে, যৌথ নামে সম্পত্তি। বিনোদন সংস্থায় বিনিয়োগ। কলকাতা শহর এবং কলকাতার উপকণ্ঠে একাধিক ফ্ল্যাট। নখ-নকশার একাধিক পার্লার। সাদা চোখে এগুলো তো ভবিষ্যতের বিনিয়োগই বটে।
নাকি খানিক উত্তেজনার খোঁজে? যেমন আমরা সাধারণত খুঁজি। কারণ, আমাদের অধিকাংশের জীবনে উত্তেজনা খুব কম। কোনও ঘাত-প্রতিঘাত নেই। তরঙ্গ নেই। তাই উত্তেজনার আঁচ পেলে আমরা সে ভাবে তার দিকে ধেয়ে যাই, যে ভাবে পতঙ্গ ধেয়ে যায় আগুনের দিকে। পুড়ে মরবে জেনেও দুর্মর, দুর্নিবার এবং অমোঘ আকর্ষণে ছুট লাগায়। শিরা-ধমনীতে রক্ত চলকে ওঠে। ঘুম-টুম সব উধাও হয়ে যায়।
বেলঘরিয়ার পৈতৃক বাড়ি, সেই বাড়ির অনাদরে-ভরা আসবাবের মধ্যে তক্তাপোশে বসে-থাকা উলোঝুলো রাত্রিবাসে লজ্জা নিবারণ-করা প্রৌঢ়া মা। যাঁর সঙ্গে উচ্চাভিলাষী কন্যার সম্পর্কের সুতো ক্রমশ আলগা হয়ে এসেছে। যে কন্যা নিম্ন-মধ্যবিত্ততার প্রায়ান্ধকার গ্রহ ছাড়িয়ে উঁচুতে, সৌরজগতে আরও উঁচুতে উঠে যাওয়ার নিরন্তর চেষ্টায় রত। শক্তিশালী গ্রহের স্যাটেলাইট হওয়া ছাড়া উপায় কী ছিল অর্পিতার? কিন্তু উপগ্রহ হয়ে ঘুরতে ঘুরতে যে এই ঘূর্ণাবর্তে পড়বেন, তা সম্ভবত ভাবেননি তিনি।
নাকি তিনি জানতেন? মানুষের তো নিজের দুর্বলতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে নিজের দুর্বলতার কাছেই আত্মসমর্পণ করে। মানুষ জানে, লোভ ভাল নয়। অসূয়া ভাল নয়। ঈর্ষা ভাল নয়। হিংস্রতা ভাল নয়। তবুও সে সেগুলোর কাছে না গিয়ে পারে না। যেমন মধুমেহ রোগের রোগী তার কাছে বিষবৎ জেনেও সন্দেশ-রসগোল্লা খায়। যেমন হাই কোলেস্টেরলযুক্ত লোক পাঁঠার মাংস দিয়ে সাপ্টে এক থালা ভাত খাওয়ার জন্য শিশুর মতো ঝুলোঝুলি করে।
তদন্তকারী সংস্থার বেড়াজালে গাড়ির সিটে সেঁধিয়ে-যাওয়া সাদা-কালো ছাপ ছাপ পোশাক পরিহিতা অর্পিতার ছবি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, যতই তিনি একই পোশাকে থাকবেন, কাঁদতে কাঁদতে যতই তাঁর চোখমুখের ধারালো ভাবটা কমে যাবে, ততই এই কেচ্ছার জৌলুস কমবে।
তখন হয়তো অর্পিতা ভাববেন। পিছু ফিরে দেখবেন। কারণ, মানুষ তার জীবনের অবসরে অতীত ঘাঁটে। পিছু ফিরে দেখে। যে জালে অর্পিতা জড়িয়ে পড়েছেন, সেটি তাঁর জীবনে এক অনন্ত অবসরের বার্তা বয়ে এনেছে। সেই অবকাশে, সেই নৈঃশব্দ্যে অর্পিতাও সম্ভবত পিছু ফিরে দেখবেন। হয়তো ভাববেন, তাঁর ভিতরের সুকুমার, কোমলমতি মেয়েটি কি খুব দ্রুত নিভে গিয়েছিল? ভাববেন, অভাবে স্বভাব নষ্ট হয় না। স্বভাব নষ্ট হয় প্রাচুর্যে। তখন মাথায় অপ্রয়োজনীয় বিলাসব্যসনের ভূত চাপে। হিরোইন-হওন-প্রয়াসী হয়ে যান নিছক ‘দ্বিতীয় অঙ্কের নারী’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy