বাংলা শেখার আনন্দ চান রাজ্যপাল আনন্দ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শ্রীশ্রী সরস্বতীমাতা সহায়
মাননীয় বোসবাবু,
এই খোলা চিঠিতে বাংলার রীতিই মানলাম। দেবদেবীদের নামোল্লেখ করেই বাংলায় চিঠি লেখার রীতি। সম্বোধনে পদমর্যাদার রীতি মেনে ‘মহামহিম রাজ্যপাল মহোদয়’ না লিখে ‘বোসবাবু’ লিখতেই ইচ্ছে হল।
আগামী সরস্বতী পুজোর দিন আপনার ‘হাতেখড়ি’ হবে। আপনি বাংলায় লিখতে চান, বলতে চান। তাই সবচেয়ে আগে শিখতে চান। সেই শেখার শুরুটা বাংলার মতো করেই করতে চান। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বাংলার প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি অনুরাগ ও আগ্রহ প্রকাশ করতে গিয়ে আপনি নিজেকে ‘বাংলার দত্তকপুত্র’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু বাংলাকে যাঁরা ভালবেসেছেন, বঙ্গজননী তাঁদের কাউকে কখনও ‘দত্তক সন্তান’ ভাবেননি। আপন করে নিয়েছেন। আত্মজ বানিয়েছেন। আপনিও তেমনই হতে চলেছেন। কারণ, আপনি বাঙালির ‘শ্রীপঞ্চমী’-কে ‘আনন্দ পঞ্চমী’ করতে চলেছেন।
প্রায় সব বাঙালি বাড়িতেই সরস্বতী পুজোর দিন কতগুলি নিয়ম মানা হয়। যদিও পরিবার অনুযায়ী লোকাচার আলাদা। আমাদের বাড়িতে ওই দিন সকালে তেল-হলুদ মেখে স্নান করার নিয়ম। ছেলেদের পোশাক ধুতি-পাঞ্জাবি। তবে বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু মেয়েদের আবশ্যিক পোশাক শাড়ি। হলুদ বা বাসন্তী রঙের হলে তো কথাই নেই। স্নানের শেষে পড়ার বই, খাতা, পেন, পেন্সিল রাখতে হয় মা সরস্বতীর পায়ের কাছে। সঙ্গীতের ছাত্রছাত্রীরা রাখেন বাদ্যযন্ত্রও। এক সময়ে আমি বইপত্র রাখতাম। কিন্তু চাকরি পাওয়ার পরে পাঠ্যপুস্তক থেকে দূরত্ব বেড়ে যাওয়ায় ইদানীং লেখার প্যাড আর পেন রাখি। ডায়েরিও।
এ বছর সরস্বতী পুজো ২৬ জানুয়ারি। সাধারণতন্ত্র দিবসের ছুটি ‘নষ্ট-করা’ শ্রীপঞ্চমী। মাস দেড়েক আগে আমদাবাদের সবরমতী আশ্রমে গিয়েছিলাম। সেখানকার স্টল থেকে একটা নীল মলাটের সংবিধান কিনে এনেছি। এমনিই। সরস্বতী পুজো আর সাধারণতন্ত্র দিবস মিলে যাওয়ায় ঠিক করেছিলাম, এ বার পুজোর দিনে সরস্বতী মায়ের কাছে সংবিধানটাই দেব। কন্যার সঙ্গে কথাও হয়ে গিয়েছিল। আপনার ‘হাতেখড়ি’র খবর শুনে মনে হল, আরে! আমার মনের কাজটাই তো হতে চলেছে! রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান নিজেই শ্রীপঞ্চমী তিথিতে বীণাপাণির পদতলে বসতে চলেছেন।
বাংলাকে কাজের ভাষা করার চেষ্টা এ রাজ্যে কম হয়নি। আপনার ‘হাতেখড়ি’ অনুষ্ঠানের মুখ্য অতিথি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাংলা ভাষা নিয়ে অনেক কাজ করার কথা বলেছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সবটা পেরে ওঠেননি। তিনি নিয়মিত বাংলায় লেখালেখি করেন। তার ভাষা ও সাহিত্যগুণ নিয়ে যাঁরা সমালোচনা করেন, তাঁরাও মুখ্যমন্ত্রীর ‘চেষ্টা’ এবং ‘লেগে থাকা’-র তারিফ করতে বাধ্য হন। এর আগের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বাংলা ভাষারই ছাত্র ছিলেন। তিনিও ব্যবহারিক বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য অনেক কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন। সরকারি কাজে বাংলাকে বেশি করে ব্যবহারিক করে তোলার উদ্যোগও অনেক ছিল। কিন্তু সবটা তিনিও পারেননি। এ বার মনে হচ্ছে আপনার ‘হাতেখড়ি’ বাংলার সেই অপূর্ণ কাজ শুরুর ‘হাতেখড়ি’ হয়ে উঠতে পারে। আপনার বাংলা শেখার ইচ্ছা এবং চেষ্টা অনেককে প্রেরণা দিতে পারে।
‘চেষ্টা’ শব্দটা সচেতন ভাবেই লিখলাম। কারণ, বাঙালি আমি যেমন শত চেষ্টাতেও আপনার মতো মালয়ালম কখনও আয়ত্ত করতে পারব না, তেমন আপনার ক্ষেত্রেও হতে পারে। কারণ, বলা হয়, মায়ের মুখ থেকে না শুনলে তা ‘মাতৃভাষা’ হয়ে ওঠে না। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে ‘লোকদেখানো’র অভিযোগ তোলা যাবে না। কারণ, আপনার ঐকান্তিক আগ্রহ।
এর আগে বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেক রাজ্যপাল বাংলা শিখেছেন, বাংলা বলেছেন। অনেকে এ কথা বলতেই পারেন যে, অন্য রাজ্য থেকে বাংলায় আসা পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারাও তো বাংলা শিখতে, বলতে বাধ্য হন। আপনি আর নতুন কী করছেন? আপনি, বোসবাবু, শেখার বিষয়টাকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ করছেন। রাজ্যের শীর্ষ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান রাজভবন থেকে যখন কোনও বার্তা আসে, তার প্রভাব সমাজে পড়তে বাধ্য। আপনি নিজেও বুঝিয়ে দিয়েছেন ‘হাততালি’ পেতে নয়। ভালবাসা থেকেই এই শিক্ষার আয়োজন। রাজ্যে এসে আপনিই তো জানিয়েছিলেন, রোজ একটি করে নতুন বাংলা শব্দ শিখবেন।
কাজের ভাষা হিসাবে বাংলা শেখা যে জরুরি, সেটা বুঝেছিল ব্রিটিশরাও। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্যোগে স্থানীয় ভাষা শেখার নানা উদ্যোগও ছিল। আদালতের কাজে ফার্সি ভাষার ব্যবহার থাকলেও বাংলা অনেক কাল পর্যন্ত ব্রাত্য থেকেছে। বাঙালির সাক্ষ্য নেওয়ার সময় ইংরেজ বিচারকদের দোভাষীর সাহায্য নিতে হত। কাজের তাগিদেই বাংলা শিখেছিলেন অনেকে। প্রথম দিকে স্থানীয় মুন্সিদের মাধ্যমে বিদেশিরা বাংলা শিখতেন। কোম্পানির আমলে ভাষা শেখার জন্য বাড়তি অর্থযোগও ঘটত।
আমি ইতিহাসের ছাত্র নই। তবে বিভিন্ন লেখালেখি পড়ে জেনেছি, উইলিয়াম হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল হওয়ার পরে চেয়েছিলেন, প্রশাসনের ইংরেজ কর্তা ও কর্মচারীরা যেন বাংলা বলতে, পড়তে এবং বুঝতে পারেন। সেই লক্ষ্যে তিনি ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডকে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ লেখার অনুরোধ জানান। পরে চার্লস উইলকিন্স বাঙালি পঞ্চানন কর্মকারের সহায়তায় তৈরি করলেন বাংলা হরফের টাইপ। ১৭৭৮ সালে মুদ্রিত পুস্তক রূপে বেরিয়ে এল হ্যালহেডের ব্যাকরণ ‘আ গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’। সেই বইয়ের আখ্যাপত্রে বাংলা হরফে লেখা হয়েছিল ‘বোধপ্রকাশং শব্দশাস্ত্রং ফিরিঙ্গিনামুপকারার্থং ক্রিয়তে’। অর্থাৎ, ফিরিঙ্গি সাহেবদের উপকারের কথা ভেবেই এই শব্দশাস্ত্রের বোধপ্রকাশকারী বইটি লেখা।
ধর্মপ্রচারের জন্যও বাংলা শেখার দরকার হয়ে পড়েছিল। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের আগে দোমিনিক দে সুজা নামে এক যাজক বাংলা ভাষায় খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন। তবে বিদেশিদের বাংলা চর্চায় সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করা হয় উইলিয়াম কেরির নাম। তিনি নাকি মাতৃভাষার মতো করেই বাংলা বলতে পারতেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন জোসুয়া মার্শম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ড। তাঁদের উদ্যোগে শ্রীরামপুর মিশন হয়ে উঠেছিল বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনার শক্তিশালী কেন্দ্র। তবে সে সবের পিছনে বেশি ছিল ব্যক্তিগত বৈষয়িক ভাগ্যবদল ও খ্রিস্টধর্ম প্রচারের লক্ষ্য।
আপনাকে জনান্তিকে একটা কথা জানিয়ে রাখি। আমজনতা আপনার সঙ্গে কথায় কথায় রাজভবনে আপনার পূর্বসূরির তুলনা করেন। অধুনা দেশের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে আপনার তুলনা স্বাভাবিক। সে কৌতূহলের নিরসন এখনও হয়নি। তবে ধনখড় ‘সাহেব’ রাজ্যে এসে হাতে টুইটার তুলে নিয়েছিলেন। আপনি বোস ‘বাবু’ হাতে স্লেট-পেন্সিল নিতে চাইছেন। ধনখড় কঠিন কঠিন ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতেন। ওঁর ভাষা ব্যবহার নিয়েও একটা রাজনৈতিক বিতর্ক হয়েছিল।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যপালের উদ্দেশে একটি টুইটে ইংরেজিতেই লিখেছিলেন, ‘আপনি পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় রাজ্যপাল। আশ্চর্যজনক ভাবে আপনার চিঠির লেটারহেড ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় লেখা। বাংলায় একটি শব্দও নেই। আপনার যদি বাংলা অনুবাদ প্রয়োজন হয় দয়া করে (রাজ্যপাল, পশ্চিমবঙ্গ) লিখুন।’ জবাবে ধনখড় লিখেছিলেন, ‘খুব ভাল পরামর্শ। দ্রুত এই পরামর্শ কার্যকর করা হবে। যদিও ইতিমধ্যেই আমি নিমন্ত্রণপত্র-সহ অন্যান্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহার শুরু করেছি। আপনাকে লেখা আমার চিঠিতে বাংলাই থাকবে। ধন্যবাদ।’
এমনিতে বাঙালিরা খুবই উন্নাসিক। নিজেরা হাজার ভুল বলি, লিখি। কিন্তু অন্য ভাষার কারও বাংলা বলায় ত্রুটি খুঁজতে উঠেপড়ে লেগে যাই। হাততালি পেতে যাঁরা বাংলা বলেন, তাঁরা সে সবে পাত্তা দেন না। অভিনেতা থেকে রাজনীতিক— টেলিপ্রম্পটার দেখে কিংবা মুখস্ত করে বক্তৃতার মাঝে একটু আধটু বাংলা বলে দেন। ‘আমি বাংলাকে ভালবাসে’, ‘আমি রসগুল্লাকে ভালবাসে’ ধরনের ‘বাংলা’ বলে হাততালিও পান। কিন্তু তাঁদের সত্যি সত্যিই বাংলা শেখার আগ্রহ থাকে না।
তবে ব্যতিক্রমও আছে। আমি এমন এক রাজনীতিককে জানি, যিনি ত্রিপুরায় সংগঠন বাড়াতে গিয়ে প্রথমেই ‘ককবরক’ ভাষা শিখেছিলেন। তিনিই আবার অন্ধ্রপ্রদেশে গিয়ে ‘তেলুগু’ শিখেছেন। বাকিরা হাততালিটাই চান। এ ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদী, শাহরুখ খানের সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনও ভেদ নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়, ‘‘ছেঁড়া ছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে এক বৈকুণ্ঠের দিকে।।’’ সেই বৈকুণ্ঠে বয়ে চলে ‘হাততালি’।
এ সব কথা এখন থাক। বরং অপেক্ষায় থাকি আগামী বৃহস্পতিবারের জন্য। শ্রীপঞ্চমীতে বাংলার রাজভবনে এই প্রথম বাংলায় ‘হাতেখড়ি’। মায়ের কাছে শুনেছি, পরিবারের নিয়ম মেনে সাদা খড়িমাটি দিয়ে কালো পাথরের থালায় ‘অ’, ‘আ’ লিখেছিলাম। তখন আমার বয়স মাত্র পাঁচ। আপনি বাহাত্তরে পৌঁছেও বাংলা শেখার ‘শিশু ছাত্র’। আপনাকে প্রণাম!
ভাল থাকবেন, মহামহিম রাজ্যপাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy