Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Online Examination

বাস্তবে ফিরতে দরকার সাহস

শেষ পর্যন্ত ১৪৪ ধারাও তা হলে জারি করতে হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে! বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীদের দূরে রাখতে ব্যবহার করতেই হল পুলিশি ব্যবস্থা।

ঈশা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২২ ০৪:৫৪
Share: Save:

শেষ পর্যন্ত ১৪৪ ধারাও তা হলে জারি করতে হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে! বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীদের দূরে রাখতে ব্যবহার করতেই হল পুলিশি ব্যবস্থা। গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যাঁদের কোনও কাজে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চত্বরে যেতে হয়েছে, তাঁরা জানেন ভোগান্তির পরিমাণ কতখানি। আসন্ন পরীক্ষা অনলাইন বা অফলাইন যা-ই হোক, তার জন্য প্রশ্নপত্র তৈরি, জমা দেওয়া এবং আরও আনুষঙ্গিক কাজ শুরু হয়ে যায়। সেই সব কাজের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকরা নানা কলেজ থেকে আসেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট কাজটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা বিভাগে পৌঁছে দিতে। গোপনীয়তা বজায় রাখার কারণে ইমেলের মাধ্যমেও এই কাজ করা সম্ভব হয় না। এই বার মূল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যেতে গিয়ে তাঁদের চূড়ান্ত হয়রানি হল। অনেকে ঢুকতে পারলেন না ঠিক সময়ে। এত ভিড়, ধস্তাধস্তি, তাঁরা চিন্তিত হয়ে পড়েন সঙ্গে থাকা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার নথি সম্পর্কেও।

বিষয়টি শুধু শিক্ষণ-বিভাগের সঙ্গে যুক্তদের অসুবিধাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ও সংলগ্ন অঞ্চল কলকাতা শহরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। কলেজ-ভর্তি ইত্যাদি সময়ে বা হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনও প্রতিবাদের কারণে ছাত্র জমায়েত, বিক্ষোভ এবং তার ফলে যান চলাচলে ব্যাঘাতের সঙ্গে অভ্যাস আছে কলেজ স্ট্রিট চত্বরের, সঙ্গে কলকাতাবাসীরও। মানুষ যে অসুবিধা সত্ত্বেও ছাত্রবিক্ষোভ, ভর্তির সময় জ্যামজটের সঙ্গে সাধারণ ভাবে মানিয়ে নেয়, তার একটি কারণ হয়তো ছাত্রদের বয়স, তাদের নিখাদ রাজনৈতিক আবেগের প্রতি এক ধরনের সহানুভূতি। ইতিহাস সাক্ষী, সশস্ত্র ছাত্র-আন্দোলনও এই একই কারণে অনেক সময়ই পেয়েছে সবার সমর্থন। কিন্তু সেই আন্দোলনই যখন সীমা অতিক্রম করেছে, তখনই সেই সহানুভূতি সরে গেছে, ছাত্র-আন্দোলনের দূষণ প্রকট হয়েছে।

প্রায় একই কথা বলা যায় এই অনলাইন পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলন প্রসঙ্গেও। অতিমারির মুখোমুখি হয়ে অনলাইন শিক্ষা, অনলাইন পরীক্ষা ছাড়া উপায় ছিল না। অনেক অসুবিধা, প্রযুক্তিগত অসাম্য সত্ত্বেও সবাইকেই মেনে নিতে হয়েছিল সেই অদ্ভুত পরিস্থিতি। ২০২১-এ পুজোর পরে শুরু হল ব্লেন্ডেড বা মিশ্র পরিস্থিতিতে শিক্ষণ প্রক্রিয়া। তখনই লক্ষ করা যাচ্ছিল ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহারের মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন। তারা কলেজে আসতে চায় না, এলেও কোনও মতে ক্লাস শেষ করে চলে যেতে চায়। বস্তুত, তারা যে কোনও ভাবে বাড়ি থেকে ব্লেন্ডেড মোডে ক্লাস করতে চায়। এই পদ্ধতিতে শিক্ষকদের কলেজে বসে অনলাইন ক্লাস করাতে হত। কোভিডের তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা তখন দোরগোড়ায়। মাস্ক পরে, ক্লাসরুমের বোর্ডের সামনে ল্যাপটপ খুলে পড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা আর ল্যাপটপের পর্দায় মেয়েদের ভেসে আসা ছবি। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিসরে। শিক্ষকদের উষ্মা অমূলক ছিল না।

ক্লাসরুম পঠনপাঠনে অনাগ্রহের একটা কারণ যদি কোভিড কালের অনভ্যাস হয়, আর একটা বড় কারণ ছিল অনলাইন পরীক্ষার নিশ্চিন্তি। পড়া শুনে বা বুঝে কী হবে, বইপত্র তো পরীক্ষা দেওয়ার সময় সামনেই থাকবে— এই মনোভাব ছিল সর্বজনীন। যে সব বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন নিয়ে চিরকাল ছাত্রছাত্রীদের চিন্তিত থাকতে দেখা গেছে, বার বার প্রশ্ন করে বুঝে নিতে দেখা গেছে, সেই সব কঠিন বিষয়েও তারা একদম নিশ্চিন্ত।

সমস্যা আরও বাড়ল, যখন করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের কারণে অনলাইন পরীক্ষারই পুনরাবৃত্তি হল। সেই একই প্যাটার্ন হতাশার সঙ্গে মেনে নিতে বাধ্য হলেন শিক্ষককুল। যে ছেলেটি বা মেয়েটি ক্লাসে একান্ত অনিয়মিত ছিল, বা যে একেবারেই পড়া বোঝার চেষ্টা করেনি, সে-ই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বসল। সর্বাপেক্ষা হতাশার বিষয়, সেই নম্বর দিতে বাধ্য হলেন শিক্ষক, কারণ তার অনলাইন খাতাটি তো নির্ভুল। তাই এ বার শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসকরা ছিলেন অনড়। এর আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষকরা নির্দিষ্ট ভাবে আন্দোলনরত ছাত্রদের জানিয়ে দেন, কোনও চাপের মুখেই তাঁরা অনলাইন পরীক্ষা নিতে রাজি নন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন বা অফলাইন পরীক্ষা নিয়ে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে শিক্ষাপ্রশাসন বার বার অধ্যক্ষ, শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে। ছাত্রছাত্রীদের ক্রমাগত বিক্ষোভের চাপ অগ্রাহ্য করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নেয় অফলাইন পরীক্ষার পক্ষে।

ছাত্রছাত্রীদের অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট, অত্যন্ত চিন্তিত, বিধ্বস্ত তারা। অনেক অভিভাবকেরও একই অভিব্যক্তি। ক্রোধ সংবরণ করতে হয়, তাদের অসহায়ত্ব অনৈতিক, অন্যায্য, কিন্তু সত্য। সন্তানের ভুল, অন্যায় দেখলে আমরা রেগে যাই, তবু হাত তো ছাড়তে পারি না। ছাত্রছাত্রীদের বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি আমরা সবাই। অভিভাবকদের অনুরোধ, ওদের পাশে থাকুন। এই বিরাট সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এক সামগ্রিক ‘ডিনায়াল’-এ ছিল, বাস্তবের মুখোমুখি হতে তাদের অনেক সাহস প্রয়োজন।

তাদের হাতটুকু ধরে থাকতেই হবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

Online Examination Calcutta University
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy