Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
ইচ্ছা ‘কাহারো দেখিনা’ নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
Visva-Bharati

শতবর্ষেও শ্রীনিকেতনের প্রয়োজন বা প্রাসঙ্গিকতা ফুরায়নি

শ্রীনিকেতনের এক সময়ের মুখপত্র ব্রতীবালক-এ কালীমোহন ঘোষ লিখছেন, “যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, প্রত্যেক গ্রামের ভিতরেই আমাদের দেশের বড় বড় সমস্যাগুলি বর্তমান রহিয়াছে।”

কর্মী: শ্রীনিকেতনের প্রথম বর্ষপূর্তি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এলম্হার্স্ট এবং কাসাহারার কন্যা ইতুকো, ১৯২৩।

কর্মী: শ্রীনিকেতনের প্রথম বর্ষপূর্তি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এলম্হার্স্ট এবং কাসাহারার কন্যা ইতুকো, ১৯২৩। ছবি সৌজন্য: বিশ্বভারতী

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১২:৪০
Share: Save:

২২ মাঘ, ১৪২৮; ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২। শীতের ভোরে, শ্রীনিকেতনের শতবার্ষিক প্রতিষ্ঠা দিবসের বৈতালিকের ভিড়ে পা মিলিয়ে বিশ্বভারতী পরিবার। সকলের উদাত্ত কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান, “বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো/ সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।” এই গান যেন কুয়াশায় মোড়া প্রাচীন সুরুল-কুঠিবাড়ির প্রত্যয়ী অস্তিত্বে প্রতিধ্বনিত হয়ে বর্তমানের প্রয়োজনে খুলে দিচ্ছে অতীতের পাতা।
শ্রীনিকেতনের এক সময়ের মুখপত্র ব্রতীবালক-এ কালীমোহন ঘোষ লিখছেন, “যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, প্রত্যেক গ্রামের ভিতরেই আমাদের দেশের বড় বড় সমস্যাগুলি বর্তমান রহিয়াছে।” বিশ্বভারতীর ছেলেমেয়েদের পল্লিসংগঠনের উদ্যমে আপ্লুত কালীমোহন বলছেন, শিক্ষা শেষে অধিত বিষয়ের ভিতর যখন ছেলেমেয়েরা দেশের সমস্যার সমাধানের আলো খুঁজে বেড়ায়, “তখন তাহাদের অন্তরের জ্ঞানপিপাসা সত্য হয়ে ওঠে।” আশ্বিন ১৩৩৬ সংখ্যায় ‘ব্রতীবালক’ প্রবন্ধে স্বদেশের কল্যাণে অল্প-বয়সিদের কর্তব্য স্মরণ করিয়ে অনাথনাথ বসু লিখছেন, “আজ যে যুগে আমরা জন্মলাভ করেছি সে যুগের দুঃখ কষ্ট কি আমাদের মনে আঘাত দেয়না?... আমাদের অন্তরে কি জিজ্ঞাসা আসেনা এই যে অন্তরে বাহিরে এত দুঃখ এর নিবৃত্তির উপায় কোথায়?” এর পর, এক অমোঘ সত্যের উপস্থাপনায় অনাথনাথ লিখছেন, “কিন্তু মানুষের যতই বয়স হয়, বিষয় বুদ্ধি তার ততই বেশী হয়। অভিজ্ঞতা মানুষকে কাপুরুষ করে তোলে।” বয়স আর অভিজ্ঞতা অন্তত রবীন্দ্রনাথকে ভীরু করে তুলতে পারেনি। জীবনের ছয় দশকের বিচিত্র টানাপড়েনের পরেও, শ্রীনিকেতনে পল্লি পুনর্গঠনের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিজেকে যুক্ত করার সাহস দেখান রবীন্দ্রনাথ। প্রবুদ্ধ করেছিলেন অন্যদেরও, বিশেষত যুব সম্প্রদায়কে।
জীবনের দুটো ধাক্কা, রবীন্দ্রনাথকে দুটো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রেরণা দিয়েছিল। শৈশবে বৈভবে মোড়া কলকাতার শিক্ষার পরিবেশের নির্দয় চার দেওয়ালের ধাক্কা। আর, যৌবনে পূর্ববঙ্গে পারিবারিক জমিদারি তদারকির পর্বে অন্নহীন, স্বাস্থ্যহীন, শিক্ষাহীন, আনন্দহীন, পারস্পরিক সহযোগিতা বিহীন, দুর্দশায় ম্লান বাংলার পল্লিসমাজের অসহায় বাস্তবের ধাক্কা। প্রথম আঘাতের ‘প্রতিবাদ’ যদি হয়ে থাকে ১৯০১-এ শান্তিনিকেতনের নিভৃত-ছায়ায় কবির আশ্রম বিদ্যালয়, দ্বিতীয় সঙ্কটের ‘প্রতিকার’ যেন, শতবর্ষ আগে, পল্লিমঙ্গলে ব্রতী রবীন্দ্রনাথের শ্রীনিকেতন। কাগজে-কলমে এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রায় দুই দশকের ব্যবধান। কিন্তু তাঁর ব্রহ্মচর্যাশ্রমের আদিপর্বেও নিজের পল্লি-ভাবনা থেকে বিশ্লিষ্ট হননি রবীন্দ্রনাথ, স্বপ্নকে বাস্তব করতে শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছেন।
১৯০৩-এ রথীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “আমাদের পারিবারিক মর্য্যাদা বহন করিবার উপযুক্ত ছেলে এখন আর দেখিনা... স্বদেশকে মহৎভাবে দীক্ষিত করিবার ইচ্ছা, চেষ্টা, শিক্ষা বা ক্ষমতা কাহারো দেখিনা।” ১৯০৬-এ পুত্র রথীন্দ্রনাথ এবং আশ্রমের ছাত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদার আর ১৯০৭-এ জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে কৃষি এবং গোপালন-বিদ্যা শিখতে আমেরিকায় পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ। ২১ জুন, ১৯০৮, প্রবাসে অধ্যয়নরত পুত্রকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “…চাষারা অনেকে সমবেত হয়ে যদি কাজ করতে পারে তাহলেই নানা হিসেবে ভাল হয় কিন্তু আমাদের দেশের হাওয়ায় কি চাষা কি ভদ্রলোক কোনোমতে সমবেত হতে জানেনা। তোরা ফিরে এসে চাষাদের মধ্যে থেকে তাদের মতিগতি যদি ফেরাতে পারিস ত দেখা যাবে। …পল্লীসমাজ গড়ে তোলবার চেষ্টা করচি যাতে আমাদের পরে প্রজাদের বিশ্বাস জন্মে এবং তারা একত্র হয়ে নিজেদের হিতসাধন করতে পারে এই চেষ্টাতেই আমি বিশেষভাবে প্রবৃত্ত হয়েছি।”
দেশে ফিরলে রথীকে শিলাইদহে পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ। পল্লির সামগ্রিক স্বাস্থ্যোদ্ধারে আর কৃষি-গবেষণায় নিজেকে উজাড় করে দেন রথীন্দ্রনাথ, তবে শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয়ের কাজে তাঁকে ফিরিয়ে আনেন পিতৃদেব। ১৯১২ সালে বিলেতে বসেই শান্তিনিকেতনের অদূরে সুরুলে কিছু জমি-সহ এক কুঠিবাড়ি কিনেছিলেন কবি। এই বাড়িকে কেন্দ্র করে, রথীন্দ্রনাথের সহায়তায় শুরু করলেন পল্লি-উন্নয়নের কাজ। প্রথম প্রথম ‘সুরুল ফার্ম’-এর কাজ ছিল জমির উর্বরতা বৃদ্ধি আর কৃষি-গবেষণা। তখন খুব ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। কাজে বাধা পড়ে। ১৯২২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি, প্রতিষ্ঠিত হল ‘সুরুল-সমিতি’। পরে যার নাম হয় ‘শ্রীনিকেতন-সমিতি’।
১৯২১-এর শেষ। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে শ্রীনিকেতনের হাল ধরার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে, তরুণ, উদ্যমী ইংরেজ কৃষিবিদ লেনার্ড নাইট এলম্হার্স্ট তার পাঠালেন, “আসব কি?” আশ্রম থেকে এল চার্লস অ্যান্ড্রুজ়ের জবাব, “এসো না, টাকা নেই।” এলম্হার্স্ট লিখলেন, “টাকা আছে, আসব?” এ বার এল রবীন্দ্রনাথের উত্তর, “আপ্লুত, চলে এসো।” ডরোথি স্ট্রেট-এর আনুকূল্যে, অর্থের নিয়মিত, দীর্ঘ সংস্থান নিশ্চিত করে, সেবার আদর্শের টানে এলম্হার্স্ট এসে এগিয়ে দিয়ে গেলেন শ্রীনিকেতনের কর্মকাণ্ড, শ্রীনিকেতন-সমিতির সচিব এবং কৃষিবিদ্যা বিভাগের অধিকর্তার অধিকারে। পরে, দীর্ঘ সময়, শ্রীনিকেতনের দায়িত্ব সামলেছিলেন রথীন্দ্রনাথও।
পুঁথিগত বিদ্যার সীমানা ছাড়িয়ে, হাতে-কলমে কাজ করে গ্রামগুলোকে স্বনির্ভর করে তোলার উপর জোর দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘পল্লীর উন্নতি’ প্রবন্ধে বাবাকে স্মরণ করে রথীন্দ্রনাথ লিখছেন, “গ্রামের সমস্যা যে সমগ্র দেশের সমস্যা, দেশের উন্নতি যে নির্ভর করে গ্রামের উন্নতির উপর... এই-সব কথা বারবার নানা প্রবন্ধে ও বক্তৃতায় তিনি দেশবাসীকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন।” এলম্হার্স্ট শান্তিনিকেতনে এসেই বাংলা শেখার চেষ্টা করলে, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শান্ত করেন এই বলে যে, সব সময় জনসংযোগ নিজে না করে বরং কর্মীদের আরও বেশি করে গ্রামের মন বুঝতে শিখিয়ে দিন এলম্হার্স্ট।
শুধু কৃষিকাজে আবদ্ধ না থেকে সমাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতির হাল ফিরিয়ে পল্লির আনন্দময় ও পূর্ণাঙ্গ উন্নতিসাধনই ছিল রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য। গ্রামগুলো ‘ভদ্রলোক’দের আনাগোনা দেখত সন্দেহের চোখে। কাজেই রবীন্দ্রনাথ প্রথমেই গ্রামের শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস অর্জন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ব্যাধি-জর্জরিত গ্রামগুলোতে চিকিৎসাপ্রদানের উদ্যোগ শুরু হয়। আমেরিকা থেকে এসে হাত লাগান নার্সিং-প্রশিক্ষিতা, সেবাভিজ্ঞা গ্রেচেন গ্রিন। আসেন ডাক্তার হ্যারি টিম্বর্স। গ্রামের জঙ্গল পরিষ্কার, ডোবাগুলো বোজানো, আগুন নির্বাপণের ব্যবস্থা করা, ব্রতীবালক দল গঠন করে গ্রামবাসীদের নানা পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া, পারস্পরিক সহযোগিতার গুরুত্ব বোঝানো, অন্নের সংস্থান নিশ্চিত করে ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়মুখী করা, ঔষধালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নৈশ বিদ্যালয়, প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়, চলন্তিকা গ্রন্থাগার, সমবায় সমিতি ও ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা, চাষিদের ঋণদান, নেশামুক্তি, বয়স্কদের পঠনপাঠনের ব্যবস্থা, নানা শিল্পকর্মে পারদর্শী করে তোলার জন্য শিল্পভবনের সূচনা: অভূতপূর্ব সব কাজ পল্লি-পুনর্গঠন, পল্লি-সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ধাপে ধাপে সংঘটিত হয়েছিল শ্রীনিকেতনে। রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা, এলম্হার্স্ট এবং বহু উৎসাহী ছাত্রছাত্রী ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন সন্তোষ মিত্র, চার্লস অ্যান্ড্রুজ়, নেপালচন্দ্র রায়, কালীমোহন ঘোষ, ধীরানন্দ রায়, গৌরগোপাল ঘোষ, প্রেমচাঁদ লাল, ধীরেন্দ্রমোহন সেন, জাপানি শিল্পী এবং উদ্যান নির্মাতা কিন্তারো কাসাহারার মতো শিক্ষক এবং কর্মীকে।
বিশ্বভারতীর ২০১৯-২০’র ‘বার্ষিক কার্যবিবরণী’তে চোখ রাখা যাক। ব্রহ্মচর্যাশ্রমের কাজেকর্মে কিছুটা হতাশ হওয়ার পর মূলত গ্রামের ছাত্রদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গড়ে তোলা বিদ্যালয় শিক্ষাসত্র ছাড়াও, এই সময়ের শ্রীনিকেতনের মূল দুই শাখা পল্লি-সংগঠন বিভাগ এবং পল্লি-শিক্ষাভবনের অধীনে প্রায় ষোলোটি বিভাগের বিপুল, নীরব কর্মযজ্ঞ চলে। প্রতিষ্ঠার শতবর্ষেও শ্রীনিকেতন তার অতীত অঙ্গীকারে অবিচল, উৎকর্ষে অদ্বিতীয়। তার সময়োপযোগী কাজের পরিধি আজ বিস্তৃত শতাধিক গ্রামে। শুধু পল্লিতেই নয়, কবির শ্রীনিকেতন ভাবনা, আজ যেন হতে পারে বিশ্বের যে কোনও ঝিমিয়ে পড়া সমাজের বিকাশের পথ-প্রদীপ। ফুরায়নি প্রয়োজন, তাই শ্রীনিকেতন ফুরায়নি আজও।
ছয় মাস নিবিড় গবেষণার পর, পল্লির দুর্দশার মূল কারণ শনাক্ত করা গেল কি না জানতে চাইলে রবীন্দ্রনাথকে এলম্হার্স্ট বলেছিলেন, “মাঙ্কিস, ম্যালিরিয়া অ্যান্ড মিউচুয়াল মিস্-ট্রাস্ট”। বাঁদর ফসল খেয়ে যায়, তাই পুষ্টিকর খাদ্য ঘাটতিতে বিপর্যস্ত হয় গণস্বাস্থ্য। এই পরিস্থিতির অনিবার্য পরিণাম দারিদ্র, উদ্যমে অনীহা, তীব্র হতাশা। তখনই আসে পরনির্ভরতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস।
বীরভূমের রুক্ষ প্রান্তরে, ভারতবর্ষের করুণ বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, এলম্হার্স্ট যেন এই সামান্য তিন আঁচড়ে সে দিন এঁকে দিয়েছিলেন গভীর এক ছবি, যে মানবিক নিরীক্ষণের ছন্দে, সহযোগের আনন্দে, পল্লিসমাজের এক সময়-হারা মহাকাব্য হয়ে উঠবে শ্রীনিকেতন।

অন্য বিষয়গুলি:

Visva-Bharati Rabindranth Tagore Shantiniketan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy