কাল ২৪ মার্চ ছিল বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এ বারের যক্ষ্মা দিবসের স্লোগান: ‘যক্ষ্মা নির্মূল করতে বিনিয়োগ’। আটকে যেতে হয় ওই বিনিয়োগের প্রশ্নে। কে করবে এই বিনিয়োগ? সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে কোভিডের টিকায় যে বিপুল বিনিয়োগ হতে দেখেছি, তার এক শতাংশও যক্ষ্মায় হয় না কেন? কারণ, যক্ষ্মায় অকালমৃত্যু হয় শুধু গরিব দেশের গরিবদেরই।
ইংরেজ কবি জন কিটস ১৮২১ সালে যখন মাত্র ২৫ বছর বয়সে ‘পালমোনারি কনজ়াম্পশন’-এ প্রয়াত হলেন, প্রিয় বন্ধু ও কবি শেলি লিখেছিলেন, ‘আহা, মৃত্যুতেও কী সুন্দর সে’। এ কালে অতি উদ্ভট মনে হলেও, যক্ষ্মার প্রভাবে যে শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায় (যেমন, শীর্ণকায়তা), তা ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে নারীসুলভ সৌন্দর্যের নিদর্শন বলে মনে করা হত। এই ‘পালমোনারি কনজ়াম্পশন’-কে পরে চিহ্নিত করা হল যক্ষ্মা বলে। ১৮৮২ সালের ২৪ মার্চ রবার্ট কখ ঘোষণা করলেন, যক্ষ্মারোগের কারণ একটি নির্দিষ্ট ব্যাকটিরিয়া। বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালন সে দিনটিকেই মনে রেখে। তার পর ১৪০ বছর কেটে গিয়েছে। যক্ষ্মা নিবারণে অগ্রগতি হয়নি, তা বলা যাবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যক্ষ্মাকে যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে প্রতি বছর এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে থাকে। তবুও, উন্নত দেশে যক্ষ্মায় মৃত্যু আজকাল বিরল হলেও, তৃতীয় বিশ্বে মৃত্যুর হারের নিরিখে যক্ষ্মা এখনও অনেক উপরে।
কিছু পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। ২০১৯ সালেও গোটা বিশ্বে যক্ষ্মায় মৃত্যু হয়েছে আনুমানিক ১৩ থেকে ১৫ লক্ষ মানুষের, এবং যক্ষ্মা-আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক কোটির মতো। অতএব, সংক্রমণের সাপেক্ষে মৃত্যুর হার— যাকে পরিভাষায় বলে ‘কেস ফ্যাটালিটি রেট’ (সংক্ষেপে সিএফআর)— এ ক্ষেত্রে ১৪ শতাংশের আশেপাশে। আর কোভিডের? দুই শতাংশের নীচে। তবে যক্ষ্মায় সংক্রমণ আর মৃত্যুর মধ্যে যে হেতু অনেকটা সময়ের ব্যবধান থাকে, এবং সংক্রমণের হার যে হেতু ক্রমশ কমছে, প্রকৃত সিএফআর হয়তো ১৪-র থেকে অনেকটা কম হবে। তা হলেও, যক্ষ্মার সিএফআর কোভিডের সিএফআর-এর থেকে যে কয়েকগুণ বেশি, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। অর্থাৎ, এক জন যক্ষ্মা-আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুসম্ভাবনা এক জন কোভিড-আক্রান্তের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। মনে রাখতে হবে যে, দু’টিই সংক্রামক রোগ— অতএব নিবৃত্তিমূলক ব্যবস্থার বিচারে যক্ষ্মা সমধিক গুরুত্ব দাবি করে। এখানে ‘মৃত্যুসম্ভাবনা’ বলতে সামগ্রিক পরিসংখ্যানগত দিক থেকে বুঝতে হবে, ক্লিনিক্যাল দিক থেকে নয়। যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় যাঁরা ওষুধপথ্য যথাযথ গ্রহণ করেন, তাঁদের মৃত্যুসম্ভাবনা অতি সামান্য। যক্ষ্মার সঙ্গে দারিদ্রের যোগসূত্রের মধ্যে এসে যায় অপুষ্টি, বাতাস চলাচলহীন ছোট ঘরে গাদাগাদি করে বাস, তারই মধ্যে ধূমপান ইত্যাদি।
ভারতে যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত চিহ্নিতের সংখ্যার গতিপ্রকৃতির দিকে নজর করলে দেখব যে, ২০১৯ পর্যন্ত তা প্রতি বছর বেড়েছে। তার পর ২০২০-তে দেখা যাচ্ছে, সংখ্যাটা ঝপ করে অনেকখানি কমে গেল। চিহ্নিতের সংখ্যা বাড়ার মধ্যে ভাল-মন্দ দুইই আছে। হতে পারে যে, সংক্রমণের হার বাড়ছে। আবার সংক্রমণ হয়তো তেমন বাড়ছে না, কিন্তু রোগাক্রান্ত চিহ্নিতকরণে বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে, এমনও হতে পারে। কিন্তু এক বছরের মধ্যে চিহ্নিতের সংখ্যা অনেকটা কমে যাওয়া নিশ্চিত ভাবে চিহ্নিতকরণের শিথিলতা নির্দেশ করে। স্পষ্টতই, কোভিড অতিমারি জনস্বাস্থ্যব্যবস্থাকে এমন ব্যতিব্যস্ত করে তুলল যে, অন্য সংক্রামক রোগের প্রতি নজর দেওয়ার আর অবকাশ রইল না। এর ফল হতে চলেছে মারাত্মক। যে কোনও সংক্রামক রোগে রোগাক্রান্ত চিহ্নিতকরণ সবচেয়ে জরুরি প্রাথমিক কাজ। সেটি শিথিল হওয়ার অর্থ হল সংক্রমণ গুণিতক হারে বেড়ে যাওয়া। আগামী বছরগুলিতে যক্ষ্মায় মৃত্যু যে অনেকটা বাড়বে, সেই সম্ভাবনা প্রবল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যক্ষ্মা বিষয়ক সাম্প্রতিক রিপোর্টে বিশেষ ভাবে ভারতের উল্লেখ আছে, উদ্বেগের সঙ্গে। তার কারণ হল, গোটা বিশ্বে কোভিডকালে যক্ষ্মা চিহ্নিতকরণ যতটা কমেছে, তার ৪১ শতাংশই ভারতের অবদান। বিশ্বে যে ১৬টি দেশকে যক্ষ্মার ব্যাপকতার দিক থেকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে ভারত অন্যতম।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক হাত গুটিয়ে বসে নেই। যক্ষ্মা দূরীকরণের লক্ষ্যে বিস্তারিত কর্তব্যসমূহ ও নির্দেশাবলি মন্ত্রকের সাইটে গেলেই মিলবে। নীতিচিন্তায় ভুল নেই— বরং, যথেষ্ট আধুনিক। ২০১৮ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে। রোগ নির্ণয় এবং নিরাময়ের জন্যে রোগী নিজেই যাতে এগিয়ে আসেন, তার জন্যে সরাসরি আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থাও আছে। যেমন, যক্ষ্মায় আক্রান্তদের প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা দেওয়া হচ্ছে পুষ্টিকর খাবার কিনে খাওয়ার জন্যে। যে কোনও ব্যক্তি কোনও রোগাক্রান্তকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার জন্যে নিয়ে এলে এককালীন ৫০০ টাকা পাবেন। এমন বিবিধ প্রণোদনা দেওয়ার ঝোঁক বেড়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। অথচ এর পরেও চিকিৎসা সম্পূর্ণ না করার প্রবণতা থেকে যায়, আশ্চর্য!
‘জাতীয় যক্ষ্মা দূরীকরণ প্রকল্প’ (এনটিইপি)-র ব্যয়বরাদ্দে এক অদ্ভুত প্রবণতা দেখছি। বাজেট বরাদ্দ যতটা উদারহস্তে করা হচ্ছে, প্রকৃত ব্যয় ততটা হচ্ছে না। আর যতটা খরচ হচ্ছে, তার অর্ধেকেরও কম যাচ্ছে রাজ্যগুলির হাত দিয়ে। অথচ রাজ্যস্তর, জেলাস্তর থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র কী ভাবে প্রকল্পটিতে সমন্বিত হবে, সে বাবদে বিস্তারিত নির্দেশ আছে কেন্দ্রের। এই উপর থেকে নেমে আসা প্রকল্পের একটি প্রধান সীমাবদ্ধতা হল, স্থানীয় বিশেষত্বকে গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগ তেমন থাকে না। চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থাকতেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হল যক্ষ্মা দূরীকরণের প্রধান বাধা, যার ফলে পরে ওষুধে আর কাজ হয় না। এই আচরণের পিছনের কারণগুলি বিচিত্র ও জটিল, যার ব্যাখ্যা পেতে হলে সমাজ-মনস্তত্ত্বের সাহায্য নিতে হবে, যার খানিকটা স্থানিক প্রেক্ষিত থাকে। প্রকল্পে সেই নমনীয়তার অভাব থাকে।
স্বাস্থ্যনীতি চিন্তার সাম্প্রতিক মোড় ঘোরা নিয়েও কয়েকটি কথা বলতেই হয়। সারা দেশে চালু হল আয়ুষ্মান ভারত, রাজ্যে স্বাস্থ্যসাথী। বিমামুখী এই নীতিভাবনার চাপে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি যে খানিক পিছু হটতে পারে, সে আশঙ্কা ছিলই, এখন তা মাথাচাড়া দিচ্ছে। সীমিত আর্থিক বরাদ্দের মধ্যে এক দিক ঢাকতে গিয়ে অন্য দিকটা উদোম হয়ে পড়ে। আর ফাঁকফোকর দিয়ে যক্ষ্মার মতো সংক্রামক রোগ আবার ডালপালা বিস্তার করতে পারে। এ বিষয়ে সতর্ক না হলে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে।
আধুনিক সভ্যতার একটি নির্মম সত্য হল, বিজ্ঞানের আলোও সর্বত্র সমান ভাবে পড়ে না। যক্ষ্মা নিবারণে টিকা একটি আছে বটে— বিসিজি— কিন্তু তা মূলত শৈশবে যক্ষ্মা-জনিত মেনিনজাইটিস প্রতিরোধে সক্ষম, পূর্ণবয়স্কের ফুসফুসের যক্ষ্মা তা প্রতিরোধ করতে পারে না। ফুসফুসের যক্ষ্মা প্রতিরোধকারী টিকা অদূর ভবিষ্যতে মিলবে, এমন আশা ক্ষীণ। সাম্প্রতিক কোভিড অতিমারি যক্ষ্মা দূরীকরণের কাজটিকে যে বেশ কিছুটা পিছিয়ে দিল, তা নিয়েও তেমন শোরগোল আশা করা যায় না— কারণ, আগেই বলেছি, যক্ষ্মায় মৃত্যু হয় মূলত গরিবদের। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার কোন ঘাটতির ফলে যক্ষ্মা কিংবা কুষ্ঠ রোগ আবার ক্রমশ ফিরে আসছে, সে খবরে সমাজেরও তেমন আগ্রহ নেই।
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy