নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, তাকে নারী করে তোলা হয়— পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ‘নারী’দের গড়ে তোলে, নারী হিসাবে কী করা উচিত আর কী উচিত নয়, তার ফর্দ তৈরি হতে থাকে; যত দিন যায়, তত ফর্দ লম্বা হতে থাকে। কথাটি সিমোন দ্য বোভোয়া-র। তাঁকে প্রশ্ন করা যেত যে, পুরুষদেরও কি গড়ে তোলা হয় না ঠিক একই ভাবে? কোনটা ‘মেয়েলি’ আর কোনটা ‘পুরুষালি’, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সেই তৈরি করে দেওয়া ছকে কি বাঁধা পড়ে না উভয়েই?
নারীবাদী রাজনীতি সচেতন ভাবেই সেই ‘মেয়েলি’ ছাঁদকে ভাঙতে চাইছে অন্তত পঞ্চাশ বছর ধরে। কিন্তু, অনেক ক্ষেত্রেই যেটা চোখ এড়িয়ে যায়, তা হল, ‘পুরুষালি’র ছাঁদও ভাঙছে। তার মধ্যে নারীবাদী রাজনীতির প্রভাব আছে, কিন্তু আরও বেশি করে আছে বাজারের প্রভাব। আজকের আধুনিক নারী রোজগেরে, ফলে প্রত্যক্ষ ক্রেতা। অতএব, বাজারের বিজ্ঞাপন এখন আর শুধু পুরুষের সঙ্গে কথা বলে না, মেয়েদের সঙ্গেও বলে। সেই কথার সুর স্বভাবতই আলাদা। বিজ্ঞাপন বা সমাজমাধ্যমে দেখা যায়, কারও বর তাকে সকালে উঠে কফি করে খাওয়াচ্ছে, কোনও ছেলে তার মায়ের জন্য বা স্ত্রীর জন্য রান্না করছে, কারও প্রেমিক তার প্রেমিকার জন্মদিনে নিজে হাতে কেক বানাচ্ছে, বা পিরিয়ড চলাকালীন এগিয়ে দিচ্ছে গরম জল, ওষুধ। অস্বীকার করা যাবে না যে, চূড়ান্ত স্বাভাবিক কিছু কাজকে ‘বিশেষ’ অথবা ‘মহান’ কাজের তকমা দেওয়া হচ্ছে এই নির্মাণে— কারণ, যে সব কাজ নিতান্তই নারীর ছিল, পুরুষ সেগুলো করলে তা পুরুষের মহত্ত্ব তো বটেই! কিন্তু, এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে, চেনা ছকগুলো ভাঙছে।
লরা মালভি বলেছিলেন যে, মূলস্রোতের জনপ্রিয় সিনেমার নির্মাণ হয় ‘মেল গেজ়’ বা পুরুষালি দৃষ্টিকোণ থেকে, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য নারীকে ‘অবজেক্টিফাই’ করা। বিজ্ঞাপনে এখন পুরুষ শরীরও পণ্যায়িত প্রদর্শনের বস্তু, কারণ মহিলারা পুরুষদের কী ভাবে দেখতে চায় তা বাজার-অর্থনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরুষদের জন্য তৈরি হেয়ার রিমুভাল ক্রিমের কথাই ধরুন। এর অন্যতম কারণই হচ্ছে মেয়েদের চাহিদা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং তার উপরে ভিত্তি করে বাজার-অর্থনীতির পরিবর্তন। পিতৃতন্ত্র গড়ে উঠেছে ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, আধিপত্য ও শরীরের মতো উপাদানের উপর ভিত্তি করেই। পিতৃতন্ত্রে পুরুষদের মধ্যেও এক ধরনের ক্রমোচ্চ সজ্জা থাকে, আগে যেটা নির্ধারিত হত বয়স অনুযায়ী, এখন তার স্থান নিয়েছে প্রধানত উপার্জন ক্ষমতা, এবং তার উপর ভিত্তি করে সমাজে তার ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও সামাজিক অবস্থান। তাই এই সমস্ত কিছুর দ্বারা গঠিত চক্রব্যূহে এখন পুরুষরাও বন্দি।
আমাদের অধিকাংশ চাওয়া-পাওয়া বা প্রত্যাশা নির্ভর করে গণমাধ্যম বা সমাজমাধ্যমের বিজ্ঞাপিত মানদণ্ডের উপর। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এক ধরনের পুরুষের ইমেজ তৈরি হয়েছে, যেখানে তারা নারীদের সহমর্মী। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিরিয়ালগুলিতে যে ভাবে নায়কদের দেখানো হয়, বহুসংখ্যক মেয়েকে তা প্রভাবিত করে। বর্তমানে নারীরা এই জাতীয় পুরুষ পছন্দ করে যাদের মধ্যে আগ্রাসন কম, যারা নারীদের ঘরের কাজ এবং একই সঙ্গে পেশাদার কাজে সাহায্য করে ও উৎসাহ দেয়, সমানাধিকারে বিশ্বাস করে। পূর্ব তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিরিয়ালের অধিকাংশ নায়ক চরিত্র তৈরি হয় এই ধারণার উপর নির্ভর করে, যা পাশ্চাত্যের কর্তৃত্বশালী পুরুষত্বের ধারণার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এ ছাড়াও, সোশ্যাল মিডিয়া এমন বহু পুরুষকে এমন একটা প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে, যাদের বাস্তব সমাজ প্রান্তিক করে রেখেছিল— তারা তাদের চিন্তাধারা ও বক্তব্য একটা বড় সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছে এই সমাজমাধ্যমের দ্বারা। নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশের সমর্থনও তারা লাভ করেছে, যাদের মধ্যে একটা বড় অংশ নারী।
কিন্তু, পুরুষ যদি তার ‘পুরুষালি’ ভঙ্গিটি ছেড়ে সংবেদনশীল হয়ে ওঠে, তাতে রাষ্ট্রশক্তির গোসা হয়। যে রাষ্ট্র ‘পৌরুষ’-এ বিশ্বাসী, যে রাষ্ট্র দাপুটে ভঙ্গিতে বিশ্ব শাসন করতে চায়, তার প্রয়োজন পুরুষালি পুরুষ। বহু দেশে যে এখনও বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তার অন্যতম কারণ দেশের পুরুষদের রাষ্ট্রের মাপে শক্তপোক্ত করে গড়েপিটে নেওয়া। সামরিক ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় নির্ভীকতা, সাহসিকতা, বীরত্ব প্রভৃতি ‘পুরুষালি’ গুণ। অতএব, যথেষ্ট পুরুষালি নয়, এমন পুরুষকে দমন করা রাষ্ট্রীয় কর্তব্যই বটে। এ বিষয়ে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে চিন। সেখানে সমকামীদের নিয়ে তৈরি সিনেমা বা সিরিজ় দেখানো নিষিদ্ধ; নারীসুলভ পুরুষদের টিভি, সিনেমা বা কোনও অনুষ্ঠানে পারফর্ম করার উপর কড়াকড়ি শুরু হয়েছে। এমনকি, শিক্ষাব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজানো হচ্ছে— জোর দেওয়া হচ্ছে এমন সব বিষয়ের উপরে, যা ‘ছেলে’দের ‘পুরুষ’ হতে সাহায্য করে। যেমন, শারীরশিক্ষা। স্কুলের প্রাক্-প্রাথমিক স্তরে বাড়ানো হচ্ছে পুরুষ-শিক্ষকের সংখ্যা, যাতে ছোটবেলায় কোনও শিক্ষিকার খপ্পরে পড়ে ছেলেদের মধ্যে মেয়েলি সত্তা জেগে না ওঠে।
রাষ্ট্রের এই ‘পুরুষত্ব’ নির্মাণের চেষ্টা অবশ্য নতুন কিছু নয়, ইতিহাস ঘাঁটলে এর উদাহরণ প্রচুর— আমেরিকা, ইংল্যান্ড, রাশিয়া-সহ বিভিন্ন রাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে এই ‘পুরুষত্ব’ নির্মাণের খেলার সাক্ষী। বর্তমানে যে দেশগুলি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের ‘আদর্শ’ রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তারা এক ধরনের দ্বিধায় ভোগে— তাদের এক দিকে যেমন লিঙ্গসাম্যের কথা প্রচার করতে হয়, আবার অন্য দিকে তথাকথিত ঐতিহ্য অর্থাৎ পূর্ববর্তী প্রজন্মের নিয়ম ও রীতির পরিবর্তন করতেও তারা বিশেষ উৎসাহী হয় না। রাষ্ট্রশক্তির শীর্ষে অধিষ্ঠিত পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূরা যতখানি লিঙ্গসাম্যকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন, আধুনিক আদর্শ রাষ্ট্রের দৌড়ও ততটুকুই।
লিঙ্গনির্বিশেষে আমাদের আত্মপরিচিতির অনেকটা অংশ জুড়ে থাকে অপরের চোখে আমাদের নির্মাণ— অন্যরা আমায় কী ভাবে দেখবে? সেই ‘অন্য’ আমাদের পরিবার হতে পারে, বন্ধু হতে পারে, প্রেমিক/প্রেমিকা হতে পারে। পুরুষদের কাছে এই ‘আমি’র নির্মাণের কোনও ফর্মুলা নেই। নারীবাদী আন্দোলন মেয়েদের জন্য একটা নতুন ‘আমি’-র ধারণা তৈরি করে দিয়েছে। পুরুষদের জন্য এই নির্মাণ হয়নি, তারা বরাবর সমাজের ক্রমোচ্চ স্তম্ভে বসে নিজেদের শ্রেষ্ঠ হিসাবে প্রচার করে গিয়েছে, কোনও রকম পরীক্ষা ছাড়াই। পৌরুষের খাপ থেকে বেরোতে চাওয়া পুরুষকে কী ভাবে দেখব, সেই চোখও তৈরি হয়নি ‘অপর’-এর— রাষ্ট্রেরও না, সমাজেরও না, পরিবারেরও না। ফলে, অনেক পুরুষকেই দেখি, স্ত্রীর সঙ্গে একান্ত পরিসরে যারা সংবেদনশীল, সাহায্যে তৎপর; অথচ পরিবার, আত্মীয় বা বন্ধুদের সামনে কঠোর স্বামী। তারা সংশয়ে ভোগে— সমাজ এবং পরিসর তাদের জন্য সে সংশয় তৈরি করে দেয়— তাদের সংবেদনশীল বন্ধুতাপূর্ণ রূপটি জনসমক্ষে এলে বুঝি তাদের ‘পৌরুষ’-এ অনপনেয় দাগ পড়বে।
হায়! এই অসহায় পুরুষগুলিকে কেউ যদি বলে দিত যে, পুরুষের কোনও আলাদা সংজ্ঞা হয় না। সমাজ বললেও হয় না, পরিবার বললেও নয়। কান্নার অধিকার যেমন তাদের আছে; গোলাপি রং ভালবাসার, ফুটবলের চেয়ে নাচ বেশি পছন্দ করার অধিকার আছে; তারা যেমন ইচ্ছা হলে ফেসওয়াশ, সানস্ক্রিন, ক্রিম লাগাতেই পারে— তেমনই বাড়িতে মা-বোন-স্ত্রীর ঘরের কাজে সাহায্য করাটাই স্বাভাবিক। ‘পুরুষত্ব’র কোনও নির্দিষ্ট অপরিবর্তনীয় সংজ্ঞা হয় না। তা সমাজ, দেশ, কালের উপর ভিত্তি করে পাল্টাতে থাকে। যদি কিছু অপরিবর্তনশীল হয়ে থাকে, তা হল পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো— যা লিঙ্গনির্বিশেষে সবার কাছেই দমনমূলক।
লিঙ্গসাম্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, তা সবার আগে নিজেকে মানুষ হিসাবে মর্যাদা দেয়, তার পরে লিঙ্গ বিচার্য হয়— আগে মানুষ হিসাবে তার কী দায়িত্ব বা কর্তব্য যদি তা শিখে নেওয়া যায়, তা হলে হয়তো আলাদা করে ‘পুরুষত্ব’ শেখার প্রয়োজনই পড়বে না। তখন মেয়েরা গাড়ি চালালে ব্যঙ্গ করতে ইচ্ছা করবে না, মেয়েদের দেখে বিশ্রী ইঙ্গিত করতে ইচ্ছা করবে না, চূড়ান্ত অপমানজনক ‘ওয়াইফ জোকস’ মজার বলে মনে হবে না, সমকামী মানুষদের হেয় করতে ইচ্ছা করবে না।
আর এই সব করে সবচেয়ে বেশি সাহায্য পুরুষ হয়তো নিজেকেই করবে, কারণ সে বুঝতে শিখবে যে, মানুষের পরিচয় শুধুমাত্র জৈবিক লিঙ্গসাপেক্ষ হতে পারে না। তথাকথিত সামাজিক প্রত্যাশার প্রভাব তাকে ফাঁপা পুরুষত্বের আবরণে ঢেকে রেখে কী ভাবে তার ব্যক্তিসত্তা আর সামাজিক সত্তার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে, পুরুষ তা বুঝতে পারবে। সে ‘পার্থক্য’কে সম্মান করতে শিখবে, ‘বহুত্ব’কে মেনে নিতে শিখবে। সর্বোপরি সে নিজেকে ‘মানুষ’ হিসাবে ভালবাসতে শিখবে, মানুষ হিসাবে নিজের পছন্দ-অপছন্দকে জোর গলায় বলতে শিখবে। আর কোনও কবিকে লিখতে হবে না: “সরোদ বাজাতে জানলে বড় ভালো হতো/ পুরুষ কিভাবে কাঁদে সেই শুধু জানে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy