Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বিপর্যয়ের মধ্যে নতুন সুযোগ
Education system

শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতিপূরণ করতে চাই বহুমুখী উদ্যোগ

বাচ্চারা যেমন বাইরের দুনিয়া থেকে হারিয়ে গিয়েছিল, বিশ্বপ্রকৃতিও তেমনই তাদের কাছে হয়ে উঠেছিল অদৃশ্য।

মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৫:২৪
Share: Save:

অবশেষে ছোটদের লেখাপড়ায় সরকারি ছাড়পত্র মিলল। অনলাইন ক্লাস পেরিয়ে, পাড়ার শিক্ষালয়ের কয়েক দিন পার করে, এই বার স্কুলের পথে হাঁটবে ছোটরা। আজ থেকেই। কার্যত দু’বছর পরে। বসন্তের হাওয়ায় আবার ছাত্রছাত্রীরা একত্রে রোদে সাঁতার দেবে, ধরিত্রীর ধুলো ও ঊনপঞ্চাশ পবন তাদের আবার মানবের পুত্রকন্যার মতো আপন করে নেবে, আর তারা বই-খাতা নিয়ে, পাঠের সামগ্রী নিয়ে, একত্রে শিক্ষকদের সঙ্গে লেখা-পড়ার চর্চায় ফিরতে পারবে, এটা কম বড় কথা নয়। অনেক দেরি হল, কিন্তু শেষ অবধি যে স্কুলগুলো খুলে যাচ্ছে শিশুদের জন্য, এটাই এখনও অবিশ্বাস্য ঠেকবে হয়তো অনেকের কাছে।

গত দু’বছরে পৃথিবীর সঙ্গে শিশুদের যোগ হয়ে উঠেছিল দুর্লভ। বাচ্চারা যেমন বাইরের দুনিয়া থেকে হারিয়ে গিয়েছিল, বিশ্বপ্রকৃতিও তেমনই তাদের কাছে হয়ে উঠেছিল অদৃশ্য। অতিমারির সবচেয়ে বড় কোপ যদি কোথাও পড়ে থাকে, তা হল ছোটদের লেখাপড়া, এবং বৃহত্তর অর্থে তাদের গোটা জগৎটাতেই। এবং, এই সময়ে রাষ্ট্রের চোখে সবচেয়ে গুরুত্বহীন হয়েও থেকেছে তাদের লেখাপড়া, বড় হওয়ার প্রশ্নটাই। এক রকম ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে, আর যা কিছুই শুরু হোক না কেন, ছোটদের লেখাপড়া এখন আর হবে না। ছোটদের সংক্রমিত হওয়া নিয়ে তথ্য এবং পরিসংখ্যান যা-ই থাকুক, ভূতের ভয়ের মতো এই আতঙ্ক ঘাড়ে চেপে বসেছিল যে, ছোটরা পড়তে এলেই প্রলয় ঘটবে। গোটা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি দিন স্কুলে তালা ঝুলল ভারতে; আর দেশের মধ্যেও যে রাজ্যগুলো স্কুল খুলতে সবচেয়ে দেরি করল, সেগুলির অন্যতম পশ্চিমবঙ্গ।

পরিণতি কতটা ভয়াবহ কল্পনা, তা করতেও হাড় হিম হয়ে আসে। “কোন ক্লাসে পড়িস”, এই অত্যন্ত সহজ প্রশ্নের উত্তরে বালিকা যখন জোরের সঙ্গে বলে ‘ফাইভ’, অথচ তন্নতন্ন করে খুঁজেও খাতায় তার নাম মেলে না, তখন যতটা বিস্ময় হয়, তার চেয়ে বেশি ভীতির সঞ্চার হয় সপ্তম শ্রেণির খাতায় তার নামখানা খুঁজে পাওয়ায়। বালিকা তখনও বলে, সে তো পঞ্চমেই ছিল, কী ভাবে সে সপ্তমে এল, তার জানা নেই। ভানুমতীর এই তাকলাগানো খেল তার জীবন থেকে দুটো বছর সম্পূর্ণ ভ্যানিশ করে দিয়েছে।

বড়রা বহু কিছু নিয়ে চুলচেরা আলোচনা করে শেষ পর্যন্ত বিকল্প উপায় যা তৈরি করছিলেন, তা হল— যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের জন্য অনলাইন ক্লাস, কিংবা বিশেষ কোনও প্রযুক্তির সাহায্যে লেখাপড়া। এ ব্যবস্থা যার কাজেই আসুক, এর দ্বারা সর্বশিক্ষা হয় না। বৈষম্যের জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে রইল প্রযুক্তির এই আস্ফালন।

স্কুল খোলা থাকলেও যেটি ছাড়া আজকাল লেখাপড়া হয় না, তা হল প্রাইভেট টিউশনি। গ্রাম কিংবা শহর, সব জায়গায় এর নির্বিকল্প উপস্থিতি। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে স্কুল খোলার পরে পরেই বেশ কয়েক জায়গায় স্কুলে যথেষ্ট ছাত্রছাত্রী উপস্থিত না হওয়ার কারণ হিসাবে জানা গেল, স্কুল বন্ধ থাকায় স্কুলের সময়েই ছাত্রছাত্রীরা টিউশনিতে যাওয়া অভ্যাস করেছে। এ দিকে উচ্চ প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীদের টিউশনি যে কেবলমাত্র মডেল অ্যাক্টিভিটি টাস্ক করে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও কাজে আসেনি, সেটা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। যে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, প্রায় সেখানেই রয়ে গেছে। উপরন্তু স্কুলের বাইরে থাকার ফলে আর যে সমস্ত উপাদান দিয়ে শৈশব নির্মিত হয়, তা থেকে বঞ্চিত থাকার ফলে কারও কারও মধ্যে এক ধরনের বিপন্নতাও তৈরি হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার হাল নিয়ে সমাজমাধ্যমে টীকা-টিপ্পনী, হাসি-ঠাট্টা সবই চলছে। কিন্তু হওয়া তো উচিত ছিল অন্য রকম: এই শিশুদের কাছে আমাদের সকলের— সরকার, সমাজ, ব্যক্তি, সকলের— করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করার দরকার ছিল। বলার দরকার ছিল— বাছারা, তোমাদের কাছে আমরা ঘোর অপরাধ করেছি, তোমাদের জীবন থেকে তোমাদের শৈশব ও তোমাদের ভবিষ্যৎ সক্ষমতা কেড়ে। সেই অপরাধবোধ হয়তো দিতে পারত পাপক্ষালনের কিছু নিদান।

পাড়ায় শিক্ষালয় চালু হতেই এই কথাটা আরও বেশি করে প্রমাণিত হল যে, বিদ্যালয় এবং শিক্ষক-শিক্ষিকার বিকল্প কোনও কিছুই হতে পারে না। যে ভাবে হইহই করে ছেলেমেয়েরা এবং তাদের মা-বাবারা এগিয়ে এলেন, তা দেখে আরও স্পষ্ট বোঝা গেল, কতটা ক্ষতি হয়ে গেছে। যাঁরা এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাঁরা সকলেই জানেন যে, কী রকম আগ্রহ নিয়ে ছেলেমেয়েরা এগিয়ে আসছে— আবার বন্ধুদের কাছাকাছি, আবার প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষিকার স্নেহ ভরা মুখের সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চাওয়া, আবার ব্ল্যাকবোর্ডে চকের আঁচড়ে তৈরি হচ্ছে অক্ষর থেকে শব্দ থেকে কল্পনা। যুগ-যুগান্ত প্রতীক্ষার যেন অবসান ঘটল। যত বিধি-নিষেধই থাক, দেখা গেল মধ্যাহ্নকালীন আহারের জন্য সেই চিরপরিচিত আগ্রহ নিয়ে লাইনে ছোটরা, দেখা গেল খুনসুটি, গল্প-স্বল্প, খেলাধুলা, জীবন স্বাভাবিক করার বহু প্রয়াস। সবচেয়ে বিস্ময়কর, এবং বাস্তবিকই আশা-জাগানিয়া যে জিনিসটা দেখা যাচ্ছে, তা হল, যে ছেলেটি দুই বছর-কাল অনলাইনে ‘লেখাপড়া’ করছিল, তার মা-বাবা বহু কষ্টে বে-সরকারি স্কুলে তার ফি জোগাচ্ছিলেন, সেই ছেলেটিও পাড়ার শিক্ষালয়ে হাজির। এবং ক্ষণকালেই সে জেদ ধরে নিল, “আমি এই ইস্কুলেই পড়ব, আর কোথাও যাব না।”

ধ্বংসের পাশাপাশি দুর্বিপাক নিয়ে আসে কিছু সুযোগও। শিক্ষাক্ষেত্রে যে মহা ধ্বংস ঘটে গিয়েছে, সেখানে আশার কিরণ এই যে, নতুন করে তাকে গড়ে তোলার মস্ত একটা সুযোগ এসেছে। শিক্ষার মতো একটা সর্বজনীন অর্জনকে যে ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য সামগ্রীতে পরিণত করা হয়েছিল, তাকে সেই বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার একটা সুযোগ এসেছে— ওই বালকটির হাত ধরে, যে বলছে, “আমি এই ইস্কুলেই পড়ব।” মহা-ভারত আমাদের শেখাচ্ছে, শিক্ষা বিক্রি-বাটার জিনিস নয়।

সেই শিক্ষাকে আবার ফলবান করে তোলার সুযোগটা নিতে হলে সর্বাগ্রে চাই এই দু’বছরে যে ঘাটতি হয়েছে তার পূরণ। সরকারের উদ্যোগকে যথেষ্ট বলে মনে করার কারণ দেখা যাচ্ছে না। ক্ষতির পরিমাণ ঠিক কতটা, সেটা বোধ হয় শিক্ষার দাফতরিক চিন্তায় ধরা পড়ছে না। একটা অস্বাভাবিক, যার অনেকটাই নিজেদের সৃষ্ট, পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে প্রয়োজন বহুমুখী উদ্যোগ— শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থী সকলের মধ্যে থেকে উঠে আসা মূল্যায়নের ভিত্তিতে বহু ধরনের শিক্ষাপদ্ধতির প্রয়োগ। এই কঠিন সময়ে শিক্ষক-সহ সমাজের একদল মানুষ যে ভাবে বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট নিজস্ব উদ্যোগে শিক্ষার ধারাকে চলমান রেখেছেন, সে ভাবেই এখন এই সেতুবন্ধনের কাজে কাঠবিড়ালির ভূমিকায় তাঁদের প্রয়োজন। শিক্ষার মানে শুধু সাজেশন মুখস্থ করে পরীক্ষায় নম্বর পাওয়া নয়— তার জন্য তো কোচিং সেন্টার বা চ্যানেলই যথেষ্ট— শিক্ষা যে অর্থে মানুষকে মানুষ করে, আজ গোটা সমাজের দায়িত্ব ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যথাযথ ভাবে সে দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

বিশেষ করে শিক্ষকসমাজকে এই কথাটা মনে রাখতেই হবে যে, সরকার নয়, শিশুর পিতামাতারাও নন, তাদের প্রকৃত অভিভাবক শিক্ষকরাই। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সবাইকেই আজ পুনরুচ্চারণ করতে হবে: যেমন করিয়া হউক, সকল দিকেই আমরা মানুষকে চাই।

অন্য বিষয়গুলি:

Education system Coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy