Advertisement
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
ভবিষ্যদ্বাণী মিলুক বা না মিলুক, শুভেন্দু বাঘের পিঠে সওয়ার
BJP

দাঁড়িয়ে আছে ডিসেম্বর!

কেন্দ্রীয় সংস্থাদের দিয়ে গাদা গাদা তদন্ত করানোর পিছনে বিশেষ কোনও ‘অভিসন্ধি’ আছে কি না, সে সব অবশ্য রাজনৈতিক তর্কের বিষয়।

সুকান্ত মজুমদার এবং শুভেন্দু অধিকারী।

সুকান্ত মজুমদার এবং শুভেন্দু অধিকারী। নিজস্ব চিত্র।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২২ ০৪:৫৩
Share: Save:

বাঙালি এত কাল ‘কাম সেপ্টেম্বর’ জেনে এসেছে। এখন জানছে, ‘কাম ডিসেম্বর’! প্রথমটিতে রয়েছে সুরমূর্ছনার তৃপ্তি। পরেরটি রাজনীতির কাদায় মাখা। ষাট বছর আগের হলিউড ছবি কাম সেপ্টেম্বর-এর সুরঝঙ্কার হল তার অন্যতম পরিচয়। আর ইদানীং ডিসেম্বর-শাসানি হয়ে উঠেছে শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদারদের ‘সিগনেচার টিউন’!

এই ডিসেম্বরের ‘রহস্য’ কী এবং কেন, তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা এখনও পাওয়া যায়নি। তবে দেশের শাসক, তথা রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের দুই দায়িত্বশীল পদাধিকারী যে ভাবে ক্রমাগত ডিসেম্বরে তৃণমূল সরকারের বিপদঘণ্টা বাজার হুমকি দিচ্ছেন, তাতে ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে, তাঁদের কাছে নিশ্চয় কোনও ‘গোপন’ খবর আছে! বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখা যাক।

বিভিন্ন আর্থিক কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির অভিযোগে তৃণমূলের বহু নেতা-মন্ত্রী ফেঁসেছেন এবং ফাঁসছেন। অনেক প্রশাসনিক ব্যক্তিও কেন্দ্রীয় তদন্তের সেই জালে জড়িয়ে গিয়েছেন। ইতিমধ্যেই অনেককে জেলেও যেতে হয়েছে। এই বাস্তব অবস্থাটি লুকোনোর কোনও জায়গা আজ শাসকের নেই। এর জন্য তৃণমূল ও তাদের সরকারের গায়ে কালি লাগছে না বললে নিখাদ মিথ্যাচার হবে।

কেন্দ্রীয় সংস্থাদের দিয়ে গাদা গাদা তদন্ত করানোর পিছনে বিশেষ কোনও ‘অভিসন্ধি’ আছে কি না, সে সব অবশ্য রাজনৈতিক তর্কের বিষয়। নেতাদের চাপানউতোরে প্রতিনিয়ত তার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। তাই নতুন করে সেই আলোচনার প্রয়োজন নেই। তবে এটাও সবাই জানেন যে, এই সব তদন্তের নির্দেশ আসে মূলত আদালত থেকে, এবং কোর্টের আদেশ সর্বদা শিরোধার্য। সুতরাং সব মিলিয়ে রাজনীতির মঞ্চে বিষয়টি শেষ পর্যন্ত মেঠো ঝগড়াতেই থেকে যায়। যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি, কোনওটাই শেষ কথা বলে না।

কিন্তু প্রশ্ন জাগে বিজেপি নেতাদের ডিসেম্বর-শাসানি দেখে। তাঁরা কার্যত ঘোষণা করেই দিয়েছেন যে, পরিস্থিতি যেখানে যাবে, তাতে এই মাসেই সরকারের শিরে সংক্রান্তি। এমনকি, সরকার পতনের সম্ভাবনাও প্রবল। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বেশ কিছু দিন ধরে বুক বাজিয়ে এটা বলে বেড়াচ্ছেন যে, ডিসেম্বরেই ‘বড় চোর’ ধরা পড়বে, এবং সরকারও তাতে টলমল করবে। প্রায় একই সুরে দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্তের হুমকি, ডিসেম্বরে যত শীত পড়বে, তৃণমূল তত কাঁপবে!

রাজনীতির কূটকৌশলে শুভেন্দু দুঁদে। তাই কে ‘বড় চোর’, সেই নামটি এখনও সরাসরি তিনি উচ্চারণ করেননি। শুধু ‘পিসি চোর-ভাইপো চোর’ ইত্যাদি বলে তাঁর চালটি চেলে যাচ্ছেন। যদিও কী বোঝাতে চান, তা নিয়ে কোনও দুগ্ধপোষ্য শিশুরও সংশয় থাকার কথা নয়।

বিরোধী পক্ষ সরকারের পতন চাইবে, এতে আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু শুভেন্দু-সুকান্তরা নির্দিষ্ট ভাবে যে ধারণা তৈরি করতে চাইছেন তা হল, দুর্নীতি, অনিয়ম ও আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে যে সব তদন্তপ্রক্রিয়া চলছে, তারই সূত্রে দু’এক জন ‘বড় চোর’ ডিসেম্বরে ধরা পড়বে। বাকিটা সহজ অনুমান!

‘গন্ধ’টা এখানেই সন্দেহজনক! কারণ সিবিআই অথবা ইডি-র মতো সংস্থা যদি কোনও তদন্ত করে, তা হলে তার গতি কবে, কী ভাবে, কোন দিকে মোড় নেবে, সেটা এক জন রাজনৈতিক ব্যক্তির পক্ষে আগাম জানার কথাই নয়— তা তিনি যে-ই হোন। অন্তত এটাই হওয়া উচিত। তবু শুভেন্দু এতটা নিশ্চিত দাবি করতে পারছেন কিসের জোরে?

আদৌ কী হবে, সেটা ক্রমশ দেখার। তবে এগুলি নিছক শীতের হাওয়া গরম করার কৌশল ভেবে নিলেও সেটা হয়তো অতি সরলীকরণ হতে পারে। বিষয়টি আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে শুভেন্দুর ডায়মন্ড হারবারের সাম্প্রতিক বক্তৃতায়। তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংসদীয় কেন্দ্রে গিয়ে সে দিন শুভেন্দু জানিয়ে এসেছেন, ডিসেম্বরেই ‘বিজয় উৎসব’ করতে তিনি লাড্ডু নিয়ে ফের সেখানে যাবেন!

আবার বলি, সত্যিই কী হবে সে সব ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে রাজ্য বিজেপির ‘আগুয়ান’ মুখ শুভেন্দু যে ভাবে রোজ এই চ্যালেঞ্জটি ছুড়ে দিচ্ছেন, তাতে সন্দেহের গন্ধ কিন্তু থেকেই যায়। কোথাও কোনও স্তর থেকে কোনও ‘সঙ্কেত’ কি তা হলে সত্যিই তাঁর কাছে পৌঁছচ্ছে? যদি তা হয়, তা হলে বুঝতে হবে যে, গোটা প্রক্রিয়ায় কোনও না কোনও ইঁদুরের গর্ত নিশ্চয় আছে! সে ক্ষেত্রে সামগ্রিক পদ্ধতির স্বচ্ছতা নিয়ে সংশয় ওঠা স্বাভাবিক।

আর শুভেন্দুর আস্ফালন যদি শেষ পর্যন্ত ‘শূন্যগর্ভ’ হয়ে যায়, তখন নেতা হিসাবে তাঁর রাজনৈতিক ‘দাপট’ ও বিশ্বাসযোগ্যতা দুই-ই লোকচক্ষে ঢিলে হতে বাধ্য। অতএব এটা তাঁরও উভয়সঙ্কট বলা যেতে পারে। ডিসেম্বরেই ‘বড় চোর’ ধরা পড়া এবং তার পরে ‘বিজয় উৎসব’ করার ঘোষণা তাই তাঁর পক্ষে কতকটা বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়া!

রাজনীতির কারবারিদের অবশ্য মস্ত একটি সুবিধা আছে। বিড়ম্বনায় পড়লে তাঁরা বলা কথা সহজে ‘ভুলে’ যেতে পারেন। পুরনো কথার নতুন ভাষ্য দিতে পারেন। সর্বোপরি মিডিয়াকে কাঠগড়ায় তুলে বলতে পারেন, তাঁর কথার ‘অপব্যাখ্যা’ করা হয়েছে। দল-মত-পতাকার রং নির্বিশেষে এটা সমভাবে প্রযোজ্য। এখনই তার মধ্যে যাচ্ছি না। আপাতত আলোচ্য ডিসেম্বরের হুমকি।

সবাই জানি, যে সব তদন্তপ্রক্রিয়া সরকার ও শাসক তৃণমূলকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরেছে, নিয়োগ দুর্নীতি এবং কয়লা ও গরু পাচার সেই তালিকার শীর্ষে। সব তদন্তই জোরকদমে চালু আছে। দু’টি পাচার-কাণ্ডের জেরে ইতিমধ্যে তৃণমূলের নেতা-সহ কয়েক জনের জেল হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে অভিষেক, তাঁর স্ত্রী ও আরও কয়েক জনকে। তাঁরা কেউ তদন্ত এড়িয়ে গিয়েছেন বা সহযোগিতা করছেন না, এমন শোনা যায়নি।

আর সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর শিক্ষক-নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে তো আদালতের নির্দেশে প্রথমেই এক হেভিওয়েট মন্ত্রীর জেল হয়েছে। পিছন পিছন জেলে ঢুকে গিয়েছেন শিক্ষা-প্রশাসনের আরও কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিক।

লক্ষণীয় হল, মহামান্য কলকাতা হাই কোর্ট সম্প্রতি প্রকাশ্যে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘অবৈধ ভাবে’ নিযুক্ত শিক্ষকদের চাকরি বাঁচাতে চাওয়ার পিছনে ‘অন্য মাথা’ আছে। “এ বার ধেড়ে ইঁদুর বেরিয়ে পড়বে”, “ঢাকি সমেত বিসর্জন হবে” এমন কিছু কিছু মন্তব্যও শোনা যাচ্ছে মহামান্য কলকাতা হাই কোর্ট থেকে।

আদালতের বিষয়ে কোনও প্রশ্ন নয়। শুধু মাননীয় বিচারপতির আসন থেকে উচ্চারিত ওই মন্তব্যগুলি থেকে মনে হতে পারে, এক বা একাধিক ‘অন্য মাথা’ এবং ‘ধেড়ে ইঁদুর’-এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মহল যথেষ্ট ‘ওয়াকিবহাল’, এবং এগুলি বস্তুত তারই ইঙ্গিত। ফলে এই রকম বার্তার সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিঘাত অনিবার্য। সেটাই হচ্ছে।

মহামান্য বিচারপতি এবং পেশাদার রাজনীতিকের নিজ নিজ মর্যাদা, অবস্থান সবই আলাদা। তাঁরা যে যা বলেন তার উদ্দেশ্য, অর্থ, মান্যতা সবই পৃথক হতে বাধ্য। উভয়ের মধ্যে কোনও তুলনাই চলে না। তুলনা করতে যাওয়া অমার্জনীয় স্পর্ধাও বটে। কিন্তু নিছক ঘটনাচক্রে রাজনীতিকের মুখে ‘বড় চোর’ এবং আদালতের মুখে ‘ধেড়ে ইঁদুর’-এর মতো কিছু শব্দবন্ধের ব্যঞ্জনা আজ সময়ের প্রেক্ষিতে খুব একটা পৃথক করা যায় না। মর্মার্থ একই দিকে নির্দেশ করে।

আদালতের আলোচনা থাক। রাজনীতিতে ফিরি। যে সব দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছে, তা অতি ভয়ঙ্কর। তদন্ত করে আইনি পথে দোষীদের শাস্তি অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু রাজনীতি কোথাও কোনও ভাবে আগাম ‘রসদ’ পেতে থাকলে সেই পরিস্থিতিও বাঞ্ছনীয় হতে পারে না। বরং তা বিচ্যুতি।

গত পঞ্চায়েত ভোটের আগে রাস্তা জুড়ে ‘উন্নয়ন’ দাঁড়িয়েছিল। তার হাতে ছিল বাঁশ, লাঠি। এ বার কি তারই পাল্টা এই ‘ডিসেম্বর জুজু’? সঙ্গে কোনও ‘লুকোনো হাতিয়ার’?

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Suvendu Adhikari Sukanta Majumdar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy