রূপরাজ্য: নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি ‘নিসর্গ’। বিশ্বভারতী নিউজ়-এর সৌজন্যে প্রতীকী চিত্র।
কোথাও ‘সৌন্দর্যায়ন’ হবে শুনলেই আজকাল বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে! মনে হয় অর্থের নয়ছয়েই তার শেষ নয়, নিশ্চিত অতি কুৎসিত কিছু একটা খাড়া করা হবে। তার ততোধিক অপ্রয়োজনীয় ‘উন্মোচন’-এ কোনও প্রসন্ন ক্ষমতাবান গোলাপি-সোনালি ফিতে কেটে জিজ্ঞাসা করবেন, “সুন্দর হয়েছে না?” স্তাবকেরা মাথা নাড়বেন, “অপূর্ব!”
চায়ের সঙ্গে পরিবেশনের জন্য মিষ্টি বিস্কুটের খোঁজে এলাকার দোকানে গিয়ে বললাম, “একটু সুন্দর দেখতে বিস্কুট দিন তো।” দোকানদার বিরক্ত হয়ে বললেন, “খাবেন, না দেখবেন?” এই বিদ্রুপ আমার মনে বিঁধে গেল! আজকাল এটাই হয়তো সুন্দরের প্রতি আমাদের বেশির ভাগের মনোভাব। ভাবখানা এই, খাবার জিনিস দেখতে ভাল হয়ে কী হবে! অনেক দিন আগে কালচে সবুজ সাবানের একটা বিজ্ঞাপন: “দেখতে খারাপ, মাখতে ভাল।” সেখানেও যেন ভাবনাটা একই— মাখার জিনিস মাখতে ভাল, তার রূপ দিয়ে আবার কী হবে! অর্থাৎ এখানে ব্যবহারিক প্রয়োজনটাই মূল, দেখার ব্যাপারটা তুচ্ছ। সুন্দরকে চিনতে না পারা, কুৎসিতকে অজ্ঞানতা আর গৌরবের সঙ্গে বরণ করে নেওয়া এক বিধ্বংসী গণ-বিপর্যয়ের পর্যায়ে পৌঁছেছে।
কুদর্শন পাঁচমিশালি স্থাপত্য, বাড়িঘরের বিকট রং, জটিল নকশার লোহার গ্রিল; প্রচার তোরণ, পোস্টার-ব্যানার; অনুষ্ঠান স্মারক, রাস্তার রেলিং, আলো; বসনভূষণ, উৎসবমঞ্চ, গৃহসজ্জা, বিজ্ঞাপন, ভিনদেশের জনপ্রিয় সৌধের করুণ, বামন প্রতিরূপ; সিনেমা-সিরিয়ালের ‘সেট’, শহুরে ড্রইংরুমে উপড়ে আনা গ্রামীণ সংস্কৃতির খুচরো, বেমানান নিদর্শন; রাস্তার পাশে বাঘ-ভালুক-ক্যাঙারুর মুখে-পেটে ডাস্টবিন, বাগানে গাছ ছেঁটে আকার দেওয়া হাতি-সারস-ডাইনোসর; আমন্ত্রণপত্র, নির্দেশিকা, পণ্যের সস্তা মোড়ক, অনুদান-লাভের শর্ত রক্ষায় গ্রামের মাটির কুটির নিশ্চিহ্ন হয়ে গড়ে ওঠা সারি-সারি কংক্রিটের একঘেয়ে মাথা গোঁজার আস্তানা, রাজনৈতিক দেওয়াল লিখন, রেস্তরাঁর মেনু কার্ড, বাড়ির ছাদে ফুটবল-এরোপ্লেন-খোলা বই অথবা জুতো-রূপী জলের ট্যাঙ্ক, পাড়ায়-পাড়ায় রাস্তার মোড়ে কদর্য ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা ঝান্ডাধারী দাদা ইত্যাদির ভিতর কুৎসিতের এক মহাযজ্ঞ চলছে। আমাদের দেখার মন, সুন্দরকে চেনার চোখ কি বন্ধ হয়ে এল? আমরা কি দেখতে ভুলে গেলাম?
সমস্যা এই যে, একের চোখে যা সুন্দর, অন্যের চোখে তা প্রবল অসুন্দর হতে পারে। প্রকৃত সুন্দর বলে কি তবে কিছু হয়, না কি সুন্দরের বোধ মূলত আপেক্ষিক, একের থেকে অন্য মানুষে বদলে যায়! সৌন্দর্যের মাপকাঠি আছে কি? এক কথায় এর উত্তর, না। কিন্তু এ হয়তো সত্যি যে এক-একটা জিনিস কত খারাপ, সেটা বোঝার ক্ষমতা থাকার কথা!
‘সৌন্দর্য’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন, সুন্দর আমাদের কিছুতে বাধ্য করে না, শুধু আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাকে চায়। সে বলে, “আমাতে তোমার আনন্দ হ’ক; তুমি স্বত আমাকে গ্রহণ করো।” সুন্দর আমাদের আনন্দ দেয়। আনন্দ, বিশ্বজগতের সঙ্গে আমাদের এক সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তোলার সহায়ক। এখানেই সুন্দরের সার্থকতা। উমবের্তো একো সুন্দরের আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, একটা সুন্দর জিনিস আমাদের নিজেদের হলে আনন্দ দেয়, অন্যের হলেও তা সুন্দরই থাকে।
জাপানযাত্রী-তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “যে-সব জিনিস অদরকারি এবং অসুন্দর তারা আমাদের কিছুই দেয় না, কেবল আমাদের কাছ থেকে নিতে থাকে। এমনি করে নিশিদিন আমাদের যা ক্ষয় হচ্ছে, সেটাতে আমাদের শক্তির কম অপব্যবহার হচ্ছেনা।” সুন্দরের অপেক্ষায় সারা জীবন কাটিয়ে দেওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘দেখা’ প্রবন্ধে লিখছেন, “আমরা চোখ মেলি, আমরা দেখি।... বিকশিত দেখা এখনও হয় নি, ভরপুর দেখা এখনও দেখি নি... আমি বলছি, এই চোখেই আমরা যা দেখতে পাব তা এখনও পাইনি। আমাদের সামনে আমাদের চার দিকে যা আছে তার কোনোটাকেই আমরা দেখতে পাইনি— ওই তৃণটিকেও না। আমাদের মনই আমাদের চোখকে চেপে রয়েছে।” চার পাশের বহু কদর্যতার ভিড়ে কোথাও লুকিয়ে থাকা আনন্দরূপ, অমৃতরূপ এবং অনন্তরূপকে দেখার সূত্র ধরিয়ে দিয়ে সুন্দরকে খুঁজে পাওয়ার পথের ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সেই দেখার চোখ আর মন তৈরি হবে কী ভাবে! যারা সেই ‘চরম দেখা’, ‘পরম দেখা’য় আমাদের দীক্ষিত করতে পারেন, ইংরেজিতে তাঁদের ‘ইসথেট’ বলা চলে। শব্দটার মূল অর্থ, সুন্দরকে চিনতে পারেন আর কদর করেন যিনি। বাংলায় হয়তো বা ‘নন্দনবেত্তা’ বলা যায়। আমাদের আজকের সমাজ নন্দনবেত্তাশূন্য, এ কথা বললে ভুল হবে। বরং বলা ভাল, সৌন্দর্যের চর্চা করেন এমন মানুষের সংখ্যাটা ক্রমশ কমে আসছে। আমাদের সমাজে সাহচর্য-শিক্ষার ধারায় দেখার সুন্দর একটা চোখ তৈরি করে দিতে পারেন যাঁরা, খোঁজ নিলে দেখা যাবে ক্ষমতা আর বাণিজ্যের দলে ভারী কারবারিদের দাপটে বিরক্ত এবং সমাজের রুচি বদলের চেষ্টায় হতোদ্যম হয়ে তাঁরা হয়তো বেছে নিয়েছেন নিভৃত জীবনচর্চা, যেখানে সুন্দরের সাধনা লোক-দেখানো, চটজলদি, অন্তঃসারশূন্য বাহ্যিক কোনও আচার নয়— বরং তা বহু দিনের দেখার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, জীবনের এক অনন্ত আনন্দপথ।
নিজের অঙ্গনটুকু সুন্দর করে গড়ে তুললেই হবে না, আমাদের চার পাশটাকেও সুন্দর করে তোলা দরকার। সুন্দরকে দেখতে পাওয়ার প্রথম ধাপ পরিচ্ছন্নতা। পরিচ্ছন্ন মন আর পরিবেশ চাই। সুন্দরের চর্চা যে কত ব্যাপক আর গঠনমূলক হতে পারে তার বড় উদাহরণ জাপান। স্বামী বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ জাপানের সৌন্দর্যপ্রিয়তার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন। ১৯০১ সালের ১৮ জুন জাপানি নন্দনবেত্তা কাকুজ়ো ওকাকুরাকে বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, “জাপান আমার কাছে একটি স্বপ্ন, এতই সুন্দর যা একজনকে সারা জীবন আচ্ছন্ন করে রাখে।” জাপানিদের সৌন্দর্যবোধের পরিচয় দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ জাপানযাত্রী-তে লিখেছিলেন, জাপানিদের চোখের খিদে তাঁদের পেটের খিদের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। লিখেছিলেন, “জাপানি রূপরাজ্যের সমস্ত দখল করেছে।... অন্য দেশে গুণী এবং রসিকের মধ্যেই রূপরসের যে বোধ দেখতে পাওয়া যায়, এ দেশে সমস্ত জাতের মধ্যে তাই ছড়িয়ে পড়েছে।... এমনতরো সর্বজনীন রসবোধের সাধনা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এখানে দেশের সমস্ত লোক সুন্দরের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।”
এই যে সুন্দরের কাছে একটা গোটা দেশের আত্মসমর্পণ, তা আমাদের প্রবণতা হয়ে ওঠেনি। তার কারণের কয়েকটা হতে পারে ভারতবর্ষের বিপুল আয়তন, দারিদ্র, বহু সংস্কৃতি বিশ্বাস আর অভ্যাসের বদহজম, পরিচ্ছন্নতার অভাব, সুন্দরকে প্রয়োজনের কাছে খাটো করার প্রবণতা এবং কাজেকর্মে, সৌষম্যবোধ রয়েছে এমন ব্যক্তি অথবা সংস্থার পরামর্শ গ্রহণে সর্ব স্তরে প্রবল অনীহা। তারই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তিতে সস্তায় পাওয়া সহজলভ্য সব উপকরণ— কাচের বদলে ‘অ্যাক্রিলিক’, কাঠের বদলে ‘প্লাস্টিক’, মাটির জায়গায় ‘রেসিন’, ফুলের জায়গায় নকল ফুল-মালা, কাগজ-ক্যানভাসের পরিবর্তে ভিনাইল, প্রদীপের ভিতর অগ্নিশিখার দাবিতে ‘টুনি বাল্ব’, ‘মেলামাইন’-এর শালপাতা— আরও কত কী!
আমাদের জনপরিসরে যে সব ভাস্কর্য, চিত্রকলা, স্থাপত্য, উদ্যান, রাস্তাঘাট, সেতু, পার্ক, অফিস-কাছারি গড়ে উঠছে, সেগুলো যাতে প্রকৃত সুন্দর হয়, এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে স্থাপিত হয়, তার জন্য আমাদের কোনও আইন নেই। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, কিন্তু আমাদের জনপরিসর ‘সৌন্দর্যায়ন’-এর প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগের মূলে রয়েছে নান্দনিক রুচি-বোধহীন প্রশাসনিক ক্ষমতার দাম্ভিক, খামখেয়ালি, অজ্ঞানতার অন্ধকার। এই সব প্রকল্পে সংবেদনশীল নন্দনবেত্তা, শিল্পী, চিত্রকর, স্থপতি, পরিবেশবিদ, নগর-পরিকল্পকদের কোনও অবদান রয়েছে বলে মনে হয় না। কুৎসিতের পরিচয় পেতে পেতে আমাদের শিশুরা বড় হচ্ছে, প্রজন্মের পর প্রজন্মের চোখ কদর্যকেই নির্বিকল্প আর সুন্দর মনে করছে। শৈশব থেকে বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে দেশের এবং বিশ্বের ঐতিহ্যে সুন্দরের নিদর্শনগুলো চিনিয়ে দেওয়ার কোনও উদ্যোগ আমরা করতে পেরেছি কি?
প্রতি দিনের নানা প্রয়োজন আমাদের থাকবেই। চেষ্টা থাকুক প্রয়োজনের সঙ্গে সুন্দরকে মিলিয়ে দেওয়ার; ক্ষুদ্রের ভিতর, সাধারণের ভিতর, সহজের ভিতর বৃহৎকে এবং আনন্দকে খুঁজে পাওয়ার। যা দৃষ্টিগোচর নয় তাকেও, যা আপাত তুচ্ছ তাকেও, যা অপ্রয়োজনীয়, বিদায়ী, এমনকি ক্ষণস্থায়ী, তাকেও সুন্দর ভাবে দেখতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এক অতি প্রয়োজনীয় সৌন্দর্য-বিপ্লব এনে দিতে পারে।
আপাতত, যেখানে মত প্রকাশের সুযোগ রয়েছে সেখানে কদর্যকে নির্ভয়ে কদর্য বলতে হবে। শিল্পী, নন্দনবেত্তারা ছাড়াও আমাদের প্রকৃত সুন্দর চিনিয়ে দিতে পারে প্রকৃতি। সেই প্রকৃতির থেকেও ক্রমাগত দূরে সরে আসছি আমরা। আলোছায়ার আঁচল-পাতা ‘নয়ন ভুলানো’ ভুবন দু’চোখ ভরে দেখে যেতে হবে, তাতে যেমন থাকবে কুৎসিতের হাতছানি, তেমনই থাকবে অতলান্ত সুন্দরের আহ্বান।
প্রতি দিনের বিচিত্র দেখার শেষে নিজেকে জিজ্ঞেস করা চাই, সুন্দর, অসীম আর অনন্তকে দেখতে পেলাম কি? নিজের কাছে নিজেরবোঝা চাই, এত দেখার ভিড়ে, “আমি কী হেরিলাম হৃদয় মেলে”!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy