ঢাকা বারান্দা, সামনে ছাদ, নীচে বাগান, পাঁচিলের পাশেই বস্তি। প্রতি দিন সেই বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে পকেট গীতায় চোখ বোলান বাঙালি জজ গৌরদাসবাবু। অবশ্য জজ বললে তিনি বিরক্ত হন। বিলেতফেরত গৌরদাসবাবুকে বলতে হয় ‘মিঃ জাস্টিস’। পকেট গীতা কেনার কারণ, বইটি চোখের সামনে ধরে রেখেও সামনের জামরুল গাছটির ফাঁক দিয়ে দিব্যি দেখা যায় বস্তির একটিমাত্র কলে স্নানরত রমণীদেহ। স্নানের দৃশ্যটি চোখের দৃষ্টিতে কব্জা করে চক্ষু মোদেন জাস্টিস। ক্রমে তাঁর হাত অবশ হয়ে ঝুলে পড়ে, প্ল্যানচেটের বোর্ডের মতো দেহটা কাঁপতে থাকে।
স্টকিং বা লুকিয়ে দেখা থেকে যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ, অপরাধের মাত্রা যা-ই হোক, কমলকুমার মজুমদারের ছোটগল্প ‘জাস্টিস’-এর চরিত্র গৌরদাসের মতো অপরাধী আজকের ভদ্রলোক সমাজেও বিরল নয়। আর জি করের ঘটনা যেন মিলিয়ে দিয়েছে ধনীর অট্টালিকা থেকে দরিদ্রের পর্ণকুটিরের সমস্ত মেয়েকে। শুধুমাত্র মেয়ে বলেই একটি মেয়েকে যে বিপন্নতার সঙ্গে বসবাস করতে হয়, গণপরিসরে উঠে এসেছে সামাজিক কাঠামোয় সেই বিপন্নতার উৎস খোঁজার দাবি, এবং তার থেকে মুক্তি বা ‘আজ়াদি’র ডাক। লিঙ্গসাম্যের অভাব এবং লিঙ্গহিংসা যে আমাদের সমাজজীবনের পরতে-পরতে মিশে আছে, তা যত তাড়াতাড়ি যত বেশি মানুষ বুঝবেন এবং স্বীকার করবেন, ততই মঙ্গল। কিন্তু এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, সমস্ত মেয়ে অসুরক্ষিত হলেও সুরক্ষার অভাবেরও মাত্রাভেদ আছে। হাসপাতালে, নিজের কর্মক্ষেত্রে কর্মরত অবস্থায় এক জন ডাক্তারের ধর্ষণ এবং খুন একটা গোটা সমাজকে যে এই ভাবে আলোড়িত করল, তার কারণ ঘটনাটি বিরলের মধ্যে বিরলতম— শুধু বীভৎসতা বা নারকীয়তার নিরিখে নয়, যাঁর বিরুদ্ধে এই জঘন্য অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে, তাঁর সামাজিক অবস্থানের প্রেক্ষিতেও বটে।
আমরা আশান্বিত হয়েছি এই দেখে যে, আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন অধ্যাপক বা ইঞ্জিনিয়ারদের পাশাপাশি রিকশাচালক, ঠিকাশ্রমিক, বিড়িশ্রমিক এবং গৃহসহায়িকারাও। যে মেয়েটি রাতে শহরের রাস্তা সারাইয়ের কাজ করেন, তাঁর নিজস্ব বিপন্নতার বোধই হয়তো তাঁকে পথে নামার প্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি হয়তো হিসাব করে দেখেননি, তাঁর বা তাঁর পেশার কারও সঙ্গে এমন অন্যায় হলে কত জন তাঁদের সুরক্ষার দাবিতে রাস্তায় নামেন বা নামবেন। তিনি হয়তো মুম্বইয়ের বিলাসবহুল হিরানন্দানি গার্ডেনসের ঘটনাটি শোনেননি। হিরানন্দানির মহিলা আবাসিকেরা আর জি করের ঘটনার প্রতিবাদে একটি সভা ডেকেছিলেন, যেখানে সমাজের সব মানুষকে যোগ দিতে বলা হয়েছিল। এ দিকে পাশের জয় ভীম নগরের বস্তিটি কিছু দিন আগেই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের উচ্ছেদের পরে সবচেয়ে বেশি অসুরক্ষিত হয়ে পড়েন মহিলারা। জয় ভীম নগরের মহিলারা হিরানন্দানির সভায় যোগ দিতে এলে তাঁদের তাড়িয়ে দেন ভদ্রমহিলারা। বলেন, “তোমাদের ইস্যু আলাদা।”
যৌনহিংসার শ্রেণিচরিত্র এবং জাতিচরিত্র অস্বীকার করা অসম্ভব। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে ৩১০০০ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে (ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ঘটে ২৪৮টি)— প্রতি দিন গড়ে ৮৫টি, প্রতি ঘণ্টায় চারটি এবং প্রতি পনেরো মিনিটে একটি ধর্ষণ। মনে রাখতে হবে যে, এনসিআরবি পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যাই দেখায় কেবল। বাস্তব চিত্রটি এর চেয়েও অনেক বেশি ভয়ানক। বহু ক্ষেত্রেই এই ধরনের অপরাধের অভিযোগটুকুও জানানো হয় না লোকলজ্জা, ক্ষমতাশালীর প্রতিশোধস্পৃহা জাগিয়ে তোলার ভয় এবং বিচারব্যবস্থায় অনাস্থার মতো কারণে। আবার অভিযোগ জানাতে গেলেও তা সহজে গৃহীত হয় না। বিশেষত গরিব, দলিত মেয়েদের উপরে যৌনহিংসা হলে সে খবর ধামাচাপা দিয়ে দেওয়াই দস্তুর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। তা সত্ত্বেও স্রেফ সরকারি হিসাব অনুযায়ী ভারতে ২০১৫ থেকে ২০২১-এর মধ্যে গরিব, দলিত মেয়েদের ধর্ষণ বেড়েছে ৪৫%। ২০২২ সালে ‘প্রিভেনশন অব অ্যাট্রসিটিজ় অ্যাক্ট’-এর আওতায় উচ্চবর্ণের পুরুষের দ্বারা দলিত মেয়েদের ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ২৮৩৯টি। জনজাতি মেয়েদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৮২০।
রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘জেন্ডার সেনসিটিভিটি অ্যান্ড দ্য কভারেজ অব রেপ ইন দি ইন্ডিয়ান মিডিয়া: টেন ইয়ার্স আফটার দ্য নির্ভয়া কেস’ শীর্ষক একটি রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, ধর্ষণ বিষয়ে লিখতে গিয়ে সাংবাদিকেরা কী ভাবে জাতিগত পরিচয়ের বিষয়টিকে গৌণ করে দেখান। হাথরসের ঘটনায় ধর্ষিত এবং নিহত মেয়েটি যে দলিত সম্প্রদায়ের, কয়েকটি সংবাদপত্র তা উল্লেখ করলেও ধর্ষকেরা যে উচ্চবর্ণ ঠাকুর সম্প্রদায়ের, এই তথ্যটি প্রায় কোনও গুরুত্বই পায়নি। অথচ সাম্প্রতিক ভারতে এমন ঘটনার নজির ভূরি ভূরি। জাতিগত হিংসার অঙ্গে অঙ্গে মিশে থাকে লিঙ্গহিংসা। নারীবাদী গবেষকেরা বার বার মনে করিয়ে দেন শ্রেণি এবং জাতি, বঞ্চনার এই দু’টি অক্ষ এবং তাদের প্রতিচ্ছেদের নিরিখেই দেখা দরকার লিঙ্গহিংসার প্রশ্নটিকে। সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হলে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতে শুরু করে। যেমন তফসিলি জাতির মানুষদের অবস্থার উন্নতি হলে বর্ণব্যবস্থায় উপরে থাকা হিন্দুরা তাঁদের শিক্ষা দিতে নানা ধরনের অত্যাচার শুরু করেন। এবং, বাড়ির মেয়েদের যৌন-নিগ্রহ করার চেয়ে জুতসই শাস্তি আর কী?
২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশের ললিতপুর জেলায় তেরো বছরের এক দলিত কিশোরীকে বার বার ধর্ষণ করে চার জন উচ্চবর্ণ পুরুষ। অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ তা গ্রহণ করে না। পাঁচ মাস পর সেই পুরুষেরাই আবার ধর্ষণ করে তাকে। এ বারও এফআইআর দায়ের করতে দেয় না পুলিশ। উল্টে তিলকধারী সরোজ নামের এক স্টেশন হাউস অফিসার নিজেই ধর্ষণ করে তাকে। এর পর ‘বচপন বচাও আন্দোলন’ নামের এক সংস্থার সাহায্যে দীর্ঘ লড়াইয়ে নামে মেয়েটির পরিবার। এ বছর মে মাসে হাই কোর্টের অর্ডার বাতিল করে তিলকধারীর জামিনের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৭ সালে উন্নাওয়ের কুখ্যাত ধর্ষণের ঘটনাতেও নিগৃহীতা ছিল দলিত নাবালিকা। মেয়েটি জানিয়েছিল তার বয়ান নিলেও মূল অভিযুক্ত বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিংহ সেঙ্গারের নামটাই উল্লেখ করতে দেয়নি পুলিশ। আনন্দ তেলতুম্বডের লেখায় পাই ২০০৬ সালের খৈরলাঞ্জি হত্যাকাণ্ডের হাড়হিম করা বিবরণ, যেখানে এক দলিত মহিলা ও তাঁর দুই মেয়েকে নগ্ন করে হাঁটিয়ে বার বার ধর্ষণ করে খুন করে কুনবি সম্প্রদায়ের পুরুষেরা, বর্ণব্যবস্থায় যাদের অবস্থান উচ্চতর। মহিলার দুই ছেলেও খুন হন সেই ঘটনায়। সিবিআই পরে ধর্ষণের অভিযোগ নাকচ করে দিলেও তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সে সময়ে অনেক প্রশ্ন ওঠে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লিঙ্গহিংসা বা ধর্ষণের আলোচনা শ্রেণি এবং জাতির প্রশ্নগুলিকে যথোচিত গুরুত্ব দেয় না। গরিব মেয়েরা ভয়ানক ভাবে অসুরক্ষিত, কারণ তাঁদের ঘরে বসে থাকার অবকাশ নেই। দিনের বিভিন্ন সময়ে তাঁদের একা একা বেরোতে হয় জল আনতে, জ্বালানি কুড়োতে বা মাঠের কাজ করতে। গবেষণা দেখিয়েছে, বাড়িতে শৌচালয় না থাকার কারণে রাতবিরেতে একা মাঠে গিয়ে ধর্ষিত হন গ্রামাঞ্চলের বহু মেয়ে। অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতে শ্রমের বাজারে মহিলাদের যোগদান লক্ষণীয় ভাবে কম। এর অন্যতম কারণ কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার অভাব। প্রত্যাশিত ভাবেই অসংগঠিত ক্ষেত্রে সেই অভাব অনেক বেশি। এ দেশে ‘কর্মরতা’ হিসাবে চিহ্নিত মেয়েদের ৮০ ভাগ— ১৫ কোটির বেশি মেয়ে— অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। এঁরা গরিব মেয়ে, কাজ না করলে গ্রাসাচ্ছাদনের উপায় থাকবে না। সরকারি আইন অনুযায়ী এঁদের কর্মক্ষেত্রে যৌন-হেনস্থার জন্য প্রতিটি জেলায় লোকাল কমিটি তৈরি করার কথা ডিস্ট্রিক্ট অফিসার বা কালেক্টরের। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০২০ সালের একটি রিপোর্টে দেখছি, ৩০ শতাংশের কম জেলায় লোকাল কমিটির অস্তিত্বের কথা জানা গিয়েছে। সেই রিপোর্টেই রয়েছে শালিনীর কথা (নাম পরিবর্তিত)। শালিনী গুরুগ্রামের এক গৃহসহায়িকা। তাঁর ভাষায়, “আমাদের মতো মেয়েদের মি-টু নেই। মুখ খুললে কাজটাই চলে যাবে।” মেয়েদের সুরক্ষা নিয়ে গণ-আন্দোলনের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে শালিনীর মতো মেয়েদের কথা বেশি করে তুলে না ধরলে ‘জাস্টিস’-এর ধারণা কমলকুমারের গল্পের রূপকের মতোই ন্যায্যতা হারাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy