Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
অসাম্যের প্রবেশিকা
NEET Examination

নিট পরীক্ষা নিশ্চিত করছে ভবিষ্যতে চিকিৎসা দুনিয়ার অবনমন

অনেকটা রেসের মাঠের ঘোড়ার মতো প্রায় এক বছর জুড়ে কিংবা তারও বেশি একচোখা অনুশীলন উৎসবে মগ্ন হয় লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী।

অভিজিৎ চৌধুরী
অভিজিৎ চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৬:৪৮
Share: Save:

মেধা কোনও স্বর্গীয় বাগানের ফুল নয় যে, তার জন্য আলাদা বাগান প্রয়োজন। সামাজিক বিকাশের সুযোগ যত বাড়ে, তত বাড়তে থাকে চার পাশে বুনো ফুলের মতো ছড়িয়ে থাকা অস্ফুট মেধার পরিচর্যা এবং প্রকাশের অবকাশ। অসম সুযোগ আর শুশ্রূষার অভাবে আরণ্যকের কুন্তীর মতো অনেক মেধাবী মানুষ শুধু লবটুলিয়াতেই ফুটে থাকে। নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার মেধা মাপার স্কেলে উত্তীর্ণ হয়ে শোভা পায় রাংতায় মোড়া কিছু মেধা সদৃশ হাঁসজারু-প্রতিম অস্তিত্বের অধিকারীরা। এরা না পারে ভাল করে হাঁটতে, আকাশে ওড়া তো দূর অস্ত্। হালফিলের অন্যতম সামাজিক আলোড়ন-তোলা মেধাসূয় যজ্ঞের নাম নিট (ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্ট)। তার মেধা পরিমাপের ক্ষমতা কত দুর্বল এবং সমাজের পক্ষে যে তা কত ক্ষতিকারক, এই প্রশ্ন তুলে নিট পরীক্ষা বিসর্জনের পক্ষে সওয়াল করেছে তামিলনাড়ু আইনসভা। একটা আস্ত বিলই পাশ হয়েছে সেখানে নিট নিরঞ্জনের লক্ষ্যে। রাষ্ট্রপতির এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন পাওয়া যাবে কি না, তা এখনও পরিষ্কার নয়। কিন্তু এই প্রস্তাবের ভিত্তিভূমি হিসাবে যে যুক্তিগুলো উঠে এসেছে, তার প্রাসঙ্গিকতা দেশ জুড়ে।

সারা দেশে ডাক্তারি পড়ার অধিকার প্রাপ্তির একমাত্র প্রবেশিকা পরীক্ষা হল নিট। অনেকটা রেসের মাঠের ঘোড়ার মতো প্রায় এক বছর জুড়ে কিংবা তারও বেশি একচোখা অনুশীলন উৎসবে মগ্ন হয় লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী। মেধার এই উৎসবে কপালে তিলক চাপে এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের। কানামাছি ভোঁ-ভোঁ গোছের এই পরীক্ষাকে আপাদমস্তক মুড়ে ফেলা হয় অপ্রয়োজনীয় এক কাঠিন্যে, আর বিষয়ের গভীরতার বাইরে কৌশল-সম্পৃক্ত এক মল্লযুদ্ধে। এই লড়াইয়ে বার বার বিপর্যস্ত হয়ে কত জন যে অবসাদে ডুবে যায়, ডাক্তারি পড়ার সিংহদরজার কাঁটা খেয়ে ছিটকে যায় যে কত জন, তার হিসাব কেউ রাখে না। এ এক অদ্ভুত সভ্যতার ইতিবৃত্ত, যেখানে ব্যর্থতার বেদি-ভূমে আত্মহত্যা ঘটতেই থাকে। এই প্রেক্ষিতেই তামিলনাড়ু আইনসভার বিল গুরুত্বপূর্ণ। তাতে যা যা বলা হয়েছে সেগুলো আমাদেরও ভেবে দেখা জরুরি। তামিলনাড়ু সরকারের নিট-সংক্রান্ত এক বিশেষ কমিটির বক্তব্য, নিট পরীক্ষা মেধার উৎকর্ষের রংমশাল জ্বালতে গিয়ে বাস্তব ক্ষেত্রে ডাক্তারি প্রবেশিকাকে পরিণত করেছে শুধুমাত্র বিত্তশালী আর সমাজের উপরতলায় থাকা মানুষদের চারণভূমিতে। এই পরীক্ষায় মেধা মাপার পদ্ধতিটাকে যে জগঝম্প ছন্দে বাঁধা হয়েছে, তাতে তাল হারাচ্ছে প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীরা। গ্রামের ছেলেমেয়েরা আর আর্থিক দিক দিয়ে পিছিয়ে-পড়া পড়ুয়ারা পরীক্ষাটির আদবকায়দা রপ্ত করতে না পেরে মেধাবী শিরোপার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, ঢুকতে পারছে না ডাক্তারিশিক্ষায়। গুণমানের সমতা আনার নামে সুকৌশলে তৈরি করা এই নাচঘর বাস্তবে সামাজিক বঞ্চনার এক মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে নাচবার সক্ষমতা অর্জনের জন্য তৈরি হয়েছে অসংখ্য কোচিং সেন্টার। ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ ‌মন্ত্রে তারা ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন বিক্রি করছে গাঁয়ে-গঞ্জে, সর্বত্র। নিট পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া মেধা মেরামত আর ধারালো করার এই কারখানাগুলো অসাম্যের গভীর খাল কেটেছে দেশ জুড়ে, যা ঘিরে রেখেছে চিকিৎসাশিক্ষার রাজপ্রাসাদকে। যিনি পয়সা ঢালতে পারবেন, তিনিই সন্তানকে ডাক্তারি পড়াতে পারবেন— এই ভাবনা সমাজে ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় বা তার আগে শুধু উচ্চবিত্তরাই ডাক্তারি পড়বে, এই ধারণা চালু ছিল। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে যা ছেড়ে এগিয়ে যাওয়ার বদলে চিকিৎসাশিক্ষাকে পিছনে ঠেলে দেওয়ার যজ্ঞ সম্পন্ন করছে নিট। সামাজিক ন্যায়ের ভাবনায় সম্পৃক্ত দেশের বেশ কিছু মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে এই পরীক্ষাব্যবস্থা। গুণমানের সমতার মুখোশের আড়ালে নিট জন্ম দিয়েছে অনেক বেশি অসাম্যের, যা শঙ্কিত করেছে তামিলনাড়ুর বিচারপতি এ কে রাজনের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া কমিটিকেও। এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই তামিলনাড়ু বিধানসভার এই বিল। সেখানে প্রস্তাব করা হয়েছে যে, খুব তাড়াতাড়ি নিট তুলে না দিলে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা গভীর খাদের দিকে এগিয়ে যাবে।

গোটা বিষয়টার মীমাংসা রাজনৈতিক ভাবেই হতে চলেছে বলে মনে হয়। তবে এই প্রস্তাবের প্রভাব সামাজিক স্তরে সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। এই রাজ্যেও এই বিল থেকে প্রেরণা নিয়ে একই ধরনের চেষ্টায় ব্রতী হওয়া দরকার। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই দেশে উন্নয়নের আলো মূলত ভোগ করেন সমাজের উপরতলার মানুষেরা। চিকিৎসাশিক্ষা যে হেতু সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তিভূমি ও সামাজিক আভিজাত্যের অন্যতম দ্যোতক, তাই তাকেও এক বিশেষ শ্রেণির মধ্যে কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা চলছে। এতে সাধারণ ভাবে সহায়ক হন বিচারব্যবস্থার অংশীদারেরা, প্রশাসনিক প্রধানেরা এবং অবশ্যই রাজনীতিবিদরা। এ যেন এক অদ্ভুত ত্র্যহস্পর্শ, যাদের মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজের সুযোগের রাজপ্রাসাদ থাকে পরিখা দিয়ে ঘেরা। আর বেশির ভাগ মানুষ দূর থেকে সেই রাজপ্রাসাদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তামিলনাড়ু বিধানসভার এই বিল সেই দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মনে করিয়ে দিয়েছে মেধার সঙ্গে বিকাশের সুযোগ আর সামাজিক ন্যায়ের নিবিড় সম্পর্কের কথা।

নিট পরীক্ষার প্রভাব যে শুধু সামাজিক অসাম্যের ক্ষেত্রে, তা-ই নয়। এর প্রকরণ-কৌশলে পারদর্শী হতে পারে না অর্থনৈতিক ভাবে সচ্ছল সমাজের পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরাও। স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে ‘নিটগেরিলা’ তৈরির আখড়াগুলোয় ব্যস্ত রাখার যে চলটা শুরু হয়েছে, সেখানে মেধা বন্ধ রেখে কেবল অন্ধ প্রশিক্ষণের এই রীতিনীতি কেবল মেধাবিকাশের পরিপন্থী নয়, প্রকৃত মেধার সঙ্গে তার বিশেষ আড়াআড়ি। বিষয়ের গভীরতার বদলে এই তরল পরীক্ষাকৌশলই কি ডাক্তারি পাঠের ক্ষমতা নির্ণয়ের শ্রেষ্ঠ পন্থা? চটকসর্বস্ব পেশাদারিত্ব তৈরির সূতিকাগৃহগুলোতে বছরের পর বছর স্বপ্ন ফুলিয়ে ‘মানসিক প্রতিবন্ধী’ হয়ে পড়ছে বহু ছাত্রছাত্রী। দেশজোড়া এই ব্যবসার মোট পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্থানে তো একটা পুরো শহর জুড়ে তৈরি হয়েছে নিট উপনিবেশ। এর পাশাপাশি প্রশ্ন ফাঁস প্রতি বছরের নিট পরীক্ষার ঐতিহ্য। নিট বাজারের কুলোর বাতাস খেতে খেতে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব প্রায় লোপ পেতে বসেছে। সেটা না ফিরলে সমাজের বিরাট বড় ক্ষতি আটকানো যাবে না।

সুতরাং, গ্রাম থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েরা ডাক্তার হলেই যে গ্রামে ডাক্তারের সমস্যা মিটে যাবে, বিষয়টা তত সরলরৈখিক নয়। সামাজিক অবস্থানের আর আভিজাত্যের কৌলীন্যের যে ভাবনা এ দেশের ডাক্তারিশিক্ষার পরিমণ্ডল দখল করেছে, তা পাল্টাতে না পারলে বনের পাখিও সোনার খাঁচাই যুগ যুগ ধরে পছন্দ করবে। এই সমস্যার বিস্তৃতি অনেক গভীরে। তবে কোনও সন্দেহ নেই যে, নিট সম্পন্ন শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার ফাঁদ পেতে সমূহ বিপদ ডেকে আনছে। মেট্রো শহরে আজন্ম লালিতের কাছে গ্রামের আলপথ, ঝিঁঝি পোকার ডাক, গ্রামের মানুষের ঘামের স্পর্শ-গন্ধ অন্য রকম তো ঠেকবেই! আর এরাই যদি ভবিষ্যতে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে বেশি সংখ্যায় পড়তে আসে, তা হলে এ দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে মানবসম্পদের জোগানের তাল মেলানো সম্ভব হবে না। মেধা বস্তুটাই আপেক্ষিক। চিকিৎসার মতো মনননির্ভর এবং সমাজসম্পৃক্ত বিষয়ে এই আপেক্ষিকতা আরও বেশি। গাণিতিক নিয়মে টিক মারা ছাঁচে ফেলে মেধার গভীরতা, সংবেদনশীলতা এবং পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রয়োজনীয়তা মাপা যায় না। মেধাবীরাই ডাক্তার হবেন। কিন্তু মেট্রিক নিয়মে মেধা মাপার পদ্ধতি বদলানো প্রয়োজন।

তামিলনাড়ুর এই বিলের প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। নিট বিসর্জনের আওয়াজ জোরালো হওয়া দরকার এ রাজ্যের স্বার্থেও। বিকল্প পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়েও ভাবনা-চিন্তা শুরু হোক এখন থেকেই।

সচিব, লিভার ফাউন্ডেশন

অন্য বিষয়গুলি:

NEET Examination Doctors
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy