Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Tarun Mazumder

শ্রীতরুণ মজুমদার (১৯৩১-২০২২)

ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স পড়েছেন সেন্ট পলস কলেজে আর গ্র্যাজুয়েশন স্কটিশ চার্চ কলেজে।

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২২ ০৫:৪৫
Share: Save:

তাঁর বাবা বলেছিলেন “তোমার যা ভাল লাগে তাই করো।” অথচ, তখন তরুণ মজুমদারের পরিবারে চলচ্চিত্র পরিচালকের পেশাগত অনিশ্চয়তা খুব কাম্য ছিল না। দেশভাগের সঙ্গেই তরুণবাবুর আশৈশব বেড়ে-ওঠার সেই ছোট্ট মফস্‌সল শহর বগুড়া চলে গিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে। “বলতে বাধা নেই, আমার পরিচালকজীবনের প্রথম দিনটা আনন্দ আর আতঙ্কের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিল,” তরুণবাবুর স্বীকারোক্তি। কলকাতায় মামাবাড়িতে জন্ম ১৯৩১-এ। বগুড়ায় একান্নবর্তী পরিবার, বাবা-কাকারা সবাই তখন জেলে। বাবা বীরেন্দ্রনাথ ছিলেন স্বাধীনতা-সংগ্রামী, জ্যাঠামশাই হেমচন্দ্র ব্রিটিশ সরকারের হাতে নিহত হন ফরিদপুর জেলে।

ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স পড়েছেন সেন্ট পলস কলেজে আর গ্র্যাজুয়েশন স্কটিশ চার্চ কলেজে। কলকাতায় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হল, সেখানে ডিসিকা, রোসেলিনির মতো দিকপাল পরিচালকদের ছবি দেখে দারুণ নাড়া খেলেন— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউরোপ, সেখানকার মানুষের সঙ্কট। উপলব্ধি হল: “ওই ছবিগুলির ভিতর দিয়ে সেই সব মানুষের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতাম। এই যে ভাল ছবির একই সঙ্গে ‘ভাল’ হয়ে ওঠা এবং ‘কমিউনিকেট’ করার ক্ষমতা দু’য়ে মিলে ছবি বানানোর উদ্দেশ্যটা বড় হয়ে উঠল আমার কাছে।” সম্বল বলতে তাঁর ছিল মফস্‌সল শহরের স্মৃতি আর আশৈশব সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা। নিয়মিত ভারতীয় ছবি দেখতেন— প্রমথেশ বড়ুয়া, নীতিন বসু থেকে শুরু করে দেবকী বসু পর্যন্ত, অন্য দিকে ভি শান্তারাম বা বিমল রায়। পাশাপাশি তখন আবার ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘেরও আন্দোলন— জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাসকে সেই সূত্রেই প্রথম চেনা। “এ-সমস্ত অভিজ্ঞতা আমাকে কতটা ছবি করার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল জানি না, তবে পথের পাঁচালী-র মুক্তি ভাবনার জগতে তুমুল তোলপাড় তুলল। এত দিনের দেখা যাবতীয় ছবি সিঁড়ির একেকটা ধাপে তুলে আনছিল ভারতীয় সিনেমাকে, কিন্তু পথের পাঁচালী ভারতীয় ফিল্মকে এক লাফে পৌঁছে দিল সিঁড়ির মাথায়,” বলতেন তরুণবাবু।

শুরুতেই ‘নিরাপদ’ হওয়ার তাগিদে অবিসংবাদী দুই তারকা সুচিত্রা-উত্তমকে নিয়ে দু’টি ছবি করতে হয়েছিল তাঁকে: চাওয়া পাওয়া আর স্মৃতিটুকু থাক— প্রথমটিতে সুচিত্রা-উত্তম, দ্বিতীয়টিতে শুধু সুচিত্রা সেন। তরুণবাবু তখন ‘যাত্রিক’-এর ব্যানারে ছবি করা শুরু করেছেন, অন্য দুই সঙ্গী দিলীপ মুখোপাধ্যায়, শচীন মুখোপাধ্যায়। যাত্রিক-কে পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সুচিত্রা-উত্তমের ভূমিকা সম্পর্কে তরুণবাবু বলেছেন, তাঁরা ‘ব্যক্তি হিসেবে অতি চমৎকার। সহযোগিতার কোনও তুলনা হয় না।’ তা সত্ত্বেও দু’টি ছবির পরেই তাঁর মনে হল “স্টার নেওয়া মানেই দর্শকমনে এক ধরনের আগাম প্রত্যাশা উস্কে দেওয়া। যে প্রত্যাশা নতুন কিছু চায় না। চায় এক ধরনের বাঁধা পথ, বাঁধা ইমেজ, বাঁধা শুরু, বাঁধা শেষ ব্যস।... তখন মনে মনে স্থির করলাম, ঢের হয়েছে, আর নয়, এ বার রাস্তা পাল্টাও।” তরুণবাবু কিন্তু প্রথম থেকেই চেয়েছিলেন জনপ্রিয় পরিচালক হতে: “ভাল ছবি আর জনপ্রিয় ছবি একই সঙ্গে হতে পারে, হওয়া সম্ভব, হওয়া উচিত, এটাই হল মডেল।” এ ব্যাপারে তাঁর আদর্শ ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন।

তৃতীয় ছবি কাঁচের স্বর্গ থেকেই সে ভাবে আর তারকাদের নিয়ে কাজ করেননি। যদি বা তারকারা কাজ করতে এসেছেন তাঁর ছবিতে, কৃতী শিল্পী হিসেবেই নিজেদের নিংড়ে দিয়েছেন তাঁরা। ‘যাত্রিক’-এ পরিচালনার ভার মূলত তরুণবাবুরই উপর ছিল, পলাতক-এর পর আলোর পিপাসা থেকে স্বনামে পরিচালনা শুরু। একটুকু বাসা, বালিকা বধূ, নিমন্ত্রণ, কুহেলি, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, ঠগিনী, সংসার সীমান্তে, ফুলেশ্বরী, গণদেবতা, দাদার কীর্তি, ভালবাসা ভালবাসা, মেঘমুক্তি, শহর থেকে দূরে, অমরগীতি, পথভোলা, পথ ও প্রাসাদ ইত্যাদি থেকে নতুন শতকে আলো, চাঁদের বাড়ি বা ভালোবাসার বাড়ি অবধি সব ছবিতেই ঘুরেফিরে আসে খুবই সাধারণ মানুষ ও তাদের অসাধারণ মানবিক গুণ বা বৃত্তিগুলি নিয়ে। তারা কেউই নিখুঁত নয়, খুঁতওয়ালা মানুষ— সামাজিক সফলতার মাপকাঠিতে তারা সমাজের কাছে ‘মান্য’ বা ‘বড়’ নয়। এই মানুষগুলো তাঁর ছবিতে উঠে আসে তাঁর ছেড়ে আসা দেশ-গাঁ থেকে, কলকাতার বাইরে থেকে। ফেলে আসা পুরনো সময়টার সঙ্গে তখন সাম্প্রতিক সময়টার একটা যোগসূত্রও খুঁজে পেতেন। এখান থেকেই তৈরি হত তাঁর বিশ্বাসের জগৎ, যা অবিরত তাঁর ছবিতে ফুটে ওঠে। এই বিশ্বাসের জোরেই তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম সব ধরনের বাঙালিকে আনন্দ দিয়েছেন। সত্যজিৎ রায়ের চেয়েও বাণিজ্যসফল পরিচালক ছিলেন তিনি— সত্যজিৎ স্বয়ং অনুরাগী ছিলেন তাঁর ছবির। পদ্মশ্রী ও জাতীয় পুরস্কার-সহ নানাবিধ সম্মানে ভূষিত মানুষটির লেখালিখিও সমান জনপ্রিয় তাঁর ছবিরই মতো। গল্পগ্রন্থ: বাতিল চিত্রনাট্য, প্রবন্ধ: নকশি কাঁথা; তাঁর সিনেমাজীবনের স্মৃতি হাতড়ে লিখেছিলেন: সিনেমাপাড়া দিয়ে— ছায়াছবির আলোছায়ার মতোই গোটা গ্রন্থ জুড়ে আলোছায়ার খেলা।

অন্য বিষয়গুলি:

Tarun Mazumder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy