মূল ছবি: পিটিআই।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে নিহত চিকিৎসক পড়ুয়ার সুরতহাল রিপোর্ট (ইনকোয়েস্ট রিপোর্ট) জানতে পেরে চমকে উঠেছি। যে ধরনের ক্ষত এবং আঘাতের চিহ্নের কথা সেখানে লেখা হয়েছে, তা কোনও এক জন ব্যক্তির উপরে কেবল এক জনের অত্যাচারের ফলে অসম্ভব! তা তিনি যতই বলশালী হোন না কেন! পুলিশ ইতিমধ্যেই এক জনকে গ্রেফতার করেছে। মঙ্গলবার হাই কোর্ট এই ঘটনার তদন্তভার সিবিআইকে দিয়েছে। তদন্তে নিশ্চয়ই সব দিক উঠে আসবে। তবে এত দিন ধরে হাজারো ফৌজদারি মামলা দেখা-শোনা-জানা-লড়ার পর একাধিক প্রশ্ন আমাকে ভাবাচ্ছে। তারই অন্যতম হল, অপরাধী এক না একাধিক?
ভয়ঙ্কর একটা অপরাধ যে ঘটেছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ধর্ষণ এবং খুন যে হয়েছে, তা-ও তো প্রশ্নাতীত। কোনটা আগে হয়েছে, সেটা তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু অপরাধটা তো ঘটেছে। সেখানেই আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন। কী ভাবে ওই ভাবে পড়ে-থাকা একটা দেহ দেখার পর কর্তৃপক্ষের তরফে ওই মহিলা চিকিৎসকের বাড়ির লোককে জানানো হল, ‘আত্মহত্যা’! পুলিশ বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তো অনভিজ্ঞ নন। একটা দেহ দেখে সেটা খুন না আত্মহত্যা, তা বোঝার মতো পারদর্শিতা তাঁদের থাকবে সেটা তো স্বাভাবিক। যাঁরা চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং অপরাধ নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করেন, তাঁরা এটা কী ভাবে বললেন? এটা কি অপরাধকে লুকোনোর চেষ্টা নয়? আমার মনে হয়, এ ক্ষেত্রে অপরাধ লুকোনোর চেষ্টা করা হয়েছে। সেখান থেকেই পরের প্রশ্ন, কেন সেই কর্তৃপক্ষ এবং ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হল না? একটা খুন এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেটা কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরেও তদন্ত শুরু করার আগে ‘আত্মহত্যা’ তকমা লাগিয়ে বাড়ির লোককে ফোন করলেন! এক জন আইনজীবী হিসাবে আমার মনে হচ্ছে, এটা তদন্তকে বিপথে চালিত করার জন্য করা হয়ে থাকতে পারে। বাকি অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা এই মানসিকতায় স্পষ্ট। এটাও তো এক ধরনের অপরাধ। এ ক্ষেত্রে কেন এঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত হবে না?
অপরাধীদের যাতায়াত কোন তিন জায়গায় সবচেয়ে বেশি জানেন? আদালত, হাসপাতাল এবং থানা। এই তিন জায়গাতেই অপরাধীদের নিয়মিত আনাগোনা থাকে। আদালতে মামলার কারণে, হাসপাতালে চিকিৎসার কারণে এবং থানায় হাজিরার কারণে এই তিন জায়গায় অপরাধীদের যেতেই হয়। সে কারণেই এই তিন জায়গায় সিসি ক্যামেরা থাকা প্রয়োজনীয়। ডিকে বসু মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দিষ্ট নির্দেশিকা মেনেই এখন প্রত্যেক থানায় সিসি ক্যামেরা থাকে। সেই সিসি ক্যামেরা তো জনগণের করের টাকায় কেনা। রক্ষণাবেক্ষণও আমাদের টাকাতেই হয়। তা হলে সেই ক্যামেরা ঠিকঠাক কাজ করছে কি না, তা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব কার? সুযোগ বুঝে সেগুলো খারাপ করে রাখা বা খারাপ করে দেওয়ার জন্য দায়ীই বা কারা? যদি দেখা যায়, কোনও অপরাধের সময়ে সেই ক্যামেরা কাজ করেনি, তা হলে তার দায় কার? এ প্রশ্ন তোলা কি প্রয়োজনীয় নয়?
আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দায়বদ্ধতার অভাব। আমাদের ভাবখানাই এমন, ‘‘ইহাঁ সব কুছ চলতা হ্যায়।’’ কর্তব্যরত কোনও দায়িত্বশীল ব্যক্তি কি তাঁর দায়িত্ব হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে পারেন? প্যারিস অলিম্পিক্সের একটা ঘটনার কথা বলি। অন্তিম পঙ্ঘাল। কুস্তিগির। তিনি ব্যক্তিগত ইভেন্টে হেরে যাওয়ার পর গেমস্ ভিলেজ ছেড়ে হোটেলে চলে গিয়েছিলেন। তার পর বোনকে নিজের পরিচয়পত্র দিয়ে বলেছিলেন, ভিলেজ থেকে তাঁর জিনিসপত্র নিয়ে আসতে। বোনও চলে গিয়েছিলেন দিদির নির্দেশ মেনে ভিলেজে তাঁর জিনিসপত্র আনতে। ফরাসি পুলিশ তাঁকে আটকে দেয়। পরে ভারতীয় দল অন্তিমকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। ভাবা যায়! এমনটা করা সম্ভব? আমি আমার পরিচয়পত্র অন্য একজনকে দিয়ে দেব? এটা ভারতীয়দের পক্ষেই সম্ভব। ওই যে, ‘ইহাঁ সব কুছ চলতা হ্যায়’! ভাবখানা এমন, সব ঠিক আছে! এটাই মানসিকতা। তার শিকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছেন মহিলারা।
এই মানসিকতার আরও একটা লক্ষণ ইদানীং দেখতে পাচ্ছি। মূলত সমাজমাধ্যমে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মূল ধারার সংবাদমাধ্যমেও। সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ আছে, যার সঙ্গে এই ধরনের অপরাধ ঘটছে (এ ক্ষেত্রে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক পড়ুয়া), তাঁর নাম, ছবি, পরিচয়, ঠিকানা কোনও ভাবে প্রকাশ করা যাবে না। এমনকি, তাঁর বাবা-মা-পরিবারের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যদি এটা করা না-হয়, তা হলে সেটা আইনের চোখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরেই দেখছি, আরজি করের ওই যুবতী চিকিৎসকের নাম, ছবি, পরিচয়, তাঁর বাবা-মায়ের বর্ণনা সবই নির্বিচারে প্রকাশ করা হচ্ছে সমাজমাধ্যমে। যাঁরা পোস্ট করছেন, তাঁরা ভাবছেন, এটা করে ভীষণ রকমের একটা সহানুভূতি দেখানো হচ্ছে অত্যাচারিতের প্রতি। পাশাপাশি, তাঁরা নিজেরা কতটা সমাজ নিয়ে সচেতন, সেটাও বোঝানো যাচ্ছে। আদতে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেটাই আমরা ভুলে যাচ্ছি। এর পিছনেও ওই একই কারণ, এখানে সবকিছু হতে পারে। ‘ইহাঁ সব কুছ চলতা হ্যায়’!
সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশও কিন্তু একটা ভুল করে ফেলল। পুলিশ যাঁকে গ্রেফতার করেছে ‘অভিযুক্ত’ হিসাবে, তাঁর নাম, ছবি, পরিচয়, পরিবার— সব প্রকাশ করে দিল তারা। ভুল হয়ে গেল। তদন্তের কাজে বড়সড় একটা ক্ষতি হয়ে গেল। এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধী শনাক্ত করতে তদন্তের সময় ‘টেস্ট আইডেন্টিফিকেশন প্যারেড’ অর্থাৎ ‘টিআই প্যারেড’ করা হয়। সেটা কী? এক বা একাধিক ব্যক্তি হয়তো পুলিশের কাছে দাবি করলেন, তিনি অপরাধীকে অপরাধস্থলে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেছেন। তদন্তকারীরা এ ক্ষেত্রে ‘টিআই প্যারেড’ করান। যেখানে একাধিক জনকে ওই ব্যক্তির সামনে দাঁড় করানো হয়। তিনি তাঁদের ভিতর থেকে অপরাধীকে শনাক্ত করেন। যাঁকে তিনি অকুস্থলে দেখেছিলেন। এটা তদন্তের আদালতগ্রাহ্য একটা অংশ। আরজি কর-কাণ্ডে যে ভাবে ধৃত ব্যক্তির নাম, ছবি, পরিচয় প্রকাশ করে দিল সংবাদমাধ্যম, তাতে এই ‘টিআই প্যারেড’ কার্যত অসম্ভব হয়ে গেল। অভিযুক্তের আইনজীবী এই ‘টিআই প্যারেড’ নিয়ে যদি এই দাবি করেন, ‘‘আমার মক্কেলের ছবি আগে থেকেই সকলে দেখে ফেলেছেন। তাই আমার মক্কেলকে শনাক্ত করা বা চেনা সহজ হয়ে গিয়েছে।’’ তখন আদালত কী করবে? সংবাদমাধ্যমের একাংশের এই কাজ কি তদন্তকে বিঘ্নিত করল না?
আরও একটা বিষয় মনে রাখা উচিত ছিল। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির অপরাধ কিন্তু প্রমাণিত হয়নি। তিনি আইনের চোখে এখনও ‘অপরাধী’ নন। তিনি ‘অভিযুক্ত’। শব্দ দুটোর মধ্যে আইনি ফারাক রয়েছে। অপরাধ প্রমাণ হলে আদালত তাঁকে অপরাধী ঘোষণা করবে। সাজাও ঘোষণা করবে। ধরে নেওয়া যাক, এ ক্ষেত্রে এই অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পেয়ে গেলেন। তাঁর অপরাধ প্রমাণিত হল না। তদন্তের শেষে আদালত অন্য কোনও ব্যক্তিকে তথ্যপ্রমাণের কারণে অপরাধী নির্ধারণ করে সাজা ঘোষণা করল। তখন এই ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারের সামাজিক অবস্থান কী হবে? আদালত যাঁকে নিরপরাধ ঘোষণা করল শেষে, তাঁর এবং তাঁর পরিবারের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার কেড়ে নেওয়া হল না কি? সমাজমাধ্যম তো দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিচ্ছেই, মূলধারার সংবাদমাধ্যমও এটা করবে? আর একটু দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দেওয়া যেত না?
এখন আমরা বিভিন্ন মিছিলে পা মেলাচ্ছি। বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদের ঝড় তুলছি। আমাদের রাগ রাজপথে এসে পড়েছে। কিন্তু যত ক্ষণ না উপরোক্ত প্রশ্নগুলির সঠিক জবাব পাচ্ছি বা প্রতিটি ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা তৈরি করতে পারছি, তত দিন এই ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। সাময়িক প্রতিবাদের ঝড় উঠবে। সঠিক প্রশ্নগুলি সঠিক জায়গায় সঠিক ভাবে এবং সঠিক সময়ে করা প্রয়োজন। রাষ্ট্র এই প্রশ্নের উত্তরগুলি দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ। আজকের প্রতিবাদ যেন আমরা কাল ভুলে না যাই।
কবি নাজিম হেকমত লিখেছিলেন, ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড় জোর এক বছর।’ মনে রাখার দায়িত্ব আমার-আপনার। সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে কি আমরা প্রত্যেক নিপীড়িতার স্মৃতির উদ্দেশে এই প্রতিজ্ঞা করতে পারি যে, ‘আমরা ভুলব না’?
(লেখক পেশায় আইনজীবী। মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy