বিক্ষুব্ধ: চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে জুনিয়র ডাক্তার ও ছাত্রদের বিক্ষোভ, ১১ অগস্ট। বিশ্বনাথ বণিক।
আর জি কর হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকের মর্মান্তিক মৃত্যুতে শুধু এই রাজ্যই নয়, গোটা দেশ উত্তাল। এই ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আসতেই নানা প্রান্তে এই মুহূর্তে বিক্ষোভ সংগঠিত হচ্ছে। শুধু ডাক্তারি পড়ুয়া, চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট মহলই নয়, আগলভাঙা ক্ষোভ-আবেগ-সন্দেহের বিস্ফোরণ ঘটে গিয়েছে যেন। ঘটনার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করা হলেও, সে-ই এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে পুলিশিভাষ্য পাওয়া গেলেও— ক্ষোভ কিন্তু বিন্দুমাত্র প্রশমিত হয়নি।
পুলিশের প্রথম ভাষ্য অবশ্য বলেছিল, আত্মহত্যা। কেন বলেছিল, জানা নেই। মৃতদেহ পরীক্ষারও আগে সাধারণ দৃষ্টিতেই বোঝা যায়, আত্মহননের ঘটনায় এমন কিছু ঘটতে পারে না। তদুপরি, কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল বলছেন, “এই মুহূর্তে নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছে। পুলিশ স্বচ্ছতার সঙ্গে তদন্ত করছে।” স্বচ্ছতা? কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতারের পরে এই পুলিশই নানা প্রশ্নের জবাব কি কার্যত এড়িয়ে যায়নি? সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল— ধৃতের পেশা কী, সে কী করে হাসপাতালে ঢুকে গেল? প্রথমে কোনও মন্তব্য করতে না চাইলেও পরে কমিশনারের মন্তব্যটি ছিল প্রণিধানযোগ্য: “আমাদের কাছে ঘৃণ্য একটা ঘটনার অপরাধী ছাড়া ধৃতের আর কোনও পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ নয়।”
শুনতে বেশ মহৎ, এই মন্তব্য। তাঁর ভাষায়, ‘অত্যন্ত সংবেদনশীল পরিস্থিতি’। ঠিকই তো, এ-হেন পরিস্থিতির মধ্যে কি সব কথা বলা যায়? কিন্তু এটুকু কি বলা যায় না, এক জন সামান্য সিভিক ভলান্টিয়ার কী করে এমন প্রভাবশালী হয়ে উঠল? এখনও পর্যন্ত যে সব তথ্য সামনে আসছে তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ, তাতে স্পষ্ট কোনও প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় ছিল বলেই সঞ্জয়ের এই রমরমা। এক জন সিভিক ভলান্টিয়ার হয়েও সে পুলিশ ব্যারাকে স্থায়ী ভাবে থাকার অধিকার পায় কী করে? কী করে তার সঙ্গে সব সময় পুলিশের একটি মোটরবাইক থাকছিল? কলকাতা পুলিশের ওয়েলফেয়ার কমিটির এক জন সদস্য হওয়ার অধিকারও তার নেই, তা সত্ত্বেও সে কী ভাবে ওই ওয়েলফেয়ার কমিটির এক ‘দাদা’ হয়ে উঠতে পেরেছিল? সে নাকি এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে, কলকাতা পুলিশের বড় বড় অফিসারও তাকে সমঝে চলতেন! ওয়েলফেয়ার কমিটির মাথায় থাকা সেই প্রভাবশালীর ঘনিষ্ঠ বলেই কি সঞ্জয় রায় কলকাতার সরকারি হাসপাতালগুলিতে রোগী ভর্তি বা অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে ‘মসিহা’ হয়ে উঠেছিল? এ সব ক্ষেত্রে কিন্তু টাকাপয়সা লেনদেনের অভিযোগও উঠছে তার বিরুদ্ধে। সে কারও নির্দেশ বা ‘আশীর্বাদের হাত’ ছাড়াই এত বড় একটা সাম্রাজ্য তৈরি করে ফেলল? তার এই বিপুল ‘কর্মকাণ্ড’ কেন এত কাল ধরে কারও নজরে এল না?
এই পর্বের সারাৎসার, সিভিক ভলান্টিয়ার হলেও সে ‘সামান্য’ নয়। আজ কলকাতা শহরের বুকে একটি নামজাদা সরকারি হাসপাতালের এক কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত হওয়ার পরে এটুকু বোঝার মতো। মনে রাখতে হবে আমাদের, রাজ্য বা কলকাতা পুলিশের কিছু নিজস্ব ‘মেকানিজ়ম’ আছে। আছে নজরদারির ব্যবস্থা। এমন নয় যে, দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা অনিয়ম বা অরাজকতা কারও নজরে পড়ে না। পড়ে না একমাত্র তখনই যখন তা নজরদারির বাইরে রাখা হয়। বৃহত্তর তদন্তের জাল এ সব দিকেও বিস্তৃত হচ্ছে তো?
সঞ্জয় রায় গ্রেফতার হলেও এখনও পর্যন্ত কিন্তু নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না যে সে-ই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তা আরও তদন্তসাপেক্ষ এবং তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে আদালত। ব্যাপারটা অনেকের কাছে মনঃপূত না হলেও এটাই কঠোর বাস্তব। এ কথা বলার অর্থ এটা নয় যে, বিচারপ্রক্রিয়া চলবে বলে প্রতিবাদের ঝড় উঠবে না। সমাজের প্রতিটি স্তরে এই ভয়াবহ ঘটনার প্রতিবাদ হওয়াটা অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত ও জরুরি।
আমাদের দেশে বিচারপ্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। সে কারণেই ‘হাতেগরম’ বিচার সেরে ফেলতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি-সহ অনেকেই চাইছেন ‘এনকাউন্টার’ করে ধৃতকে মেরে ফেলতে। তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, “হাসপাতালে এই রকম অবাধ যাতায়াত কেন থাকবে? আমি মনে করি, এই রকম খুনি ও ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত বা ‘এনকাউন্টার’ করে মারা উচিত। এদের সমাজে থাকা উচিত নয়।” তাঁর বক্তব্য, গুরুতর অপরাধ ঘটলেও তার আইনি প্রক্রিয়ায় সময় লেগে যায়। সে ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশে যখন যোগী সরকার এই একই তত্ত্ব আওড়ায় ও তার প্রয়োগ ঘটায় তখন কেন এই রাজ্যের শাসক দল তার প্রতিবাদ করে? এই ধরনের ভাষ্যে আবেগতাড়িত জনগণের হাততালি পাওয়া যায় বটে, কিন্তু এই ‘এনকাউন্টার’ বা ‘বুলডোজ়ার’ তত্ত্বের অর্থ, গণতান্ত্রিক কাঠামোকে অস্বীকার করা। দেশের আইন-আদালতের অস্তিত্বকেই কার্যত অস্বীকার করা!
এই আর জি কর-কাণ্ডের মধ্যেই আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। খাস কলকাতায় নয়, পূর্ব বর্ধমানের ভাতারে, স্টেট জেনারেল হাসপাতালে। গভীর রাতে নিজের চিকিৎসা করাতে গিয়ে বিন্দুমাত্র অপেক্ষায় রাজি ছিলেন না এক সিভিক ভলান্টিয়ার। তিনি কর্তব্যরত এক মহিলা চিকিৎসকের দিকে তেড়ে গিয়ে হুমকি দেন, ‘জানেন তো, আর জি করে কী হয়েছে?’ অথচ, ওই চিকিৎসক সে সময়ে দুর্ঘটনাগ্রস্ত একটি শিশুর চিকিৎসায় ব্যস্ত ছিলেন। তিনি তাঁকে বসতেও বলেন। যদিও অভিযোগ পেয়ে পুলিশ এই সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করেছে।
এই ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ কেন? কারণ, প্রশ্নটা মানসিকতার। পুলিশের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে কাজ করলেই নিজেকে পুলিশ অফিসার ভেবে ফেলার মানসিকতা। নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে দেখার মানসিকতা। অবশ্যই সবাইকে এক গোত্রে ফেলাটা অসম্ভব। অমার্জনীয় অতিসরলীকরণ। সব পেশার মতো এই পেশাতেও ভাল-মন্দ রয়েছে। কিন্তু পুলিশের অভ্যন্তরেই প্রশ্ন উঠেছে, সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগের সময়ে আগে যে ভাবে সংশ্লিষ্ট তরুণ বা তরুণী সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হত, এখন আর তা হয় না। এখন অনেক ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য বা প্রভাবশালীদের আশীর্বাদধন্য হওয়াটাই প্রধান হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নিয়োগের পরে তাঁদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠছে। পুলিশি আইন অনুযায়ী এই সিভিক ভলান্টিয়াররা অনেক কিছুই করার অধিকারী নন। কিন্তু তাঁদেরই একাংশ যখন ধীরে ধীরে ‘প্রভাবশালী’ হয়ে ওঠেন তখন মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে, কোনও একটি জায়গায় নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ছে। প্রশাসনের বজ্রমুষ্টির প্রয়োজন হয়। সব কিছু গণভোটে হতে পারে না!
ঠিক যেমন, আর জি করের সুপার তথা উপাধ্যক্ষ সঞ্জয় বশিষ্ঠকে বদলি করে দেওয়া বা এই হাসপাতালের অধ্যক্ষ এবং অধ্যাপক পদ থেকে সন্দীপ ঘোষ ইস্তফা দিলেও পরিস্থিতির বদল হবে কি না তা নির্ভর করবে সর্বোচ্চ স্তরের প্রশাসনিক নজরদারির উপর! তা না হলে মানুষের সেবা করার জন্য ডাক্তারিতে আসা মেয়েরা আর কোনও দিন নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবেন না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy