যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধৃত ছাত্র সত্যব্রতের বাবা প্রদীপ রায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
প্রদীপ রায়কে কি আপনারা চেনেন? আমি চিনলাম সম্প্রতি। প্রদীপ অবশ্য তেমন কেউকেটা নন যে, চিনতে হবে। আসলে প্রদীপ কেউ নন। আবার ‘কেউ’ বটেও। কেউ নন। কারণ, প্রদীপ কল্যাণীর বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ঠেলাগাড়ি করে পেয়ারা বিক্রি করেন। এমন তো কত জনই করেন। প্রদীপের বাড়ি নদিয়া জেলার হরিণঘাটার সন্তোষপুরে। সেখানে এক কামরার একটি ঘুপচি ঘরে বাস তাঁর। স্ত্রী রুমা সেলাইয়ের কাজ করেন। করতে হয়। কারণ, নইলে ছেলের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে পারবেন না। অর্থাভাব সত্ত্বেও বরাবর তাঁকে বেসরকারি স্কুলে পড়িয়েছেন এই দম্পতি। কারণ, ছেলেটি মেধাবী। যদিও প্রদীপ বলতে পারছেন না, তাঁর মেধাবী পুত্র কোন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে এখন। পুত্রকে সম্প্রতি চিনেছি আমরা। চিনেছে সারা রাজ্য।
সত্যব্রত রায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। আপাতত পুলিশি হেফাজতে। প্রদীপ তাঁর বাবা। সেই জন্যই এই আবহে তিনি ‘কেউ’ তো বটে।
যেমন আমরা চিনি মহম্মদ আসিফ আনসারিকে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। আসানসোলে আরিফের পরিবারের টিন আর টালির চালের বাড়ি। আরিফের বাবা রাস্তায় রাস্তায় কাপড় ফেরি করেন। মা দুরারোগ্য অসুখে ভুগছেন। তাঁদের ছেলে র্যাগিং করার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে জেনে পড়শিদের পরামর্শে উকিল নিয়ে কলকাতা এসেছিলেন। যদিও তাঁরা বিশ্বাস করেন না, তাঁদের ছেলে এমন কিছু করতে পারে।
ভুষিমালের ছোট একটি দোকান ছিল তাঁর। কিন্তু ছেলের পড়াশোনার জন্য নিজের সবেধন নীলমণি দোকানটি বিক্রি করতে হয়েছিল শেখ নাসিম আখতারের বাবাকে। এখন তিনি পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারির এক প্রান্তিক কৃষক। চাষবাস করে কিছু উপার্জন হয়। জমিটুকুই তাঁর ভরসা। তাঁর স্ত্রী, নাসিমের মা নুরজাহান আখতার স্বাস্থ্যকর্মী। সম্প্রতি নাসিমের দাদু মারা গিয়েছিলেন। তার পরে নাসিম মেমারির বাড়িতে গিয়েছিলেন। কলকাতায় ফেরার পর যাদবপুরে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের ছাত্রকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
একের পর এক নাম। সৌরভ চৌধুরী, মনোতোষ ঘোষ, দীপশেখর দত্ত, মহম্মদ আরিফ, অঙ্কন সর্দার, সপ্তক কামিল্যা, অসিত সর্দার, সুমন নস্কর, হিমাংশু কর্মকার, জয়দীপ ঘোষ। একের পর এক পরিবারের কাহিনি। কারও বাবা টিউশনি করে সংসার চালান। কারও প্রত্যন্ত গ্রামে অনটনের সংসার। কারও বাবা-মা ফাস্ট ফুডের দোকানের ব্যবসা করেন। কারও মফস্সল শহরে সোনার দোকান। কিন্তু র্যাগিং করা এবং তজ্জনিত কারণে এক সদ্যযুবার মৃত্যুতে ছেলে গ্রেফতার হওয়ার পর তাঁদের আর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। কারও বাড়ি ম্যাপের উল্টো প্রান্তে কাশ্মীরে। সেখান থেকে দাদা ছুটে এসেছেন কলকাতায়। কী জন্য? না, ভাইকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। হন্যে হয়ে ঘুরছেন। কারণ, বুঝতেই পারছেন না, ঘটনাটা কী ঘটেছে! কারও বাবা জমির কারবার করেন। মধ্যবিত্ত পরিবার। কারও পরিবার মধ্যও নয়, নিম্নবিত্ত। কারও বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত গ্রামে। কারও বাবা মারা গিয়েছেন। মা পড়ান গ্রামের শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে।
সারি সারি মুখ। বিস্মিত, নাচার, অসহায় মুখ। সে সব মুখে মাখামাখি হয়ে আছে মাপমতো অবিশ্বাসও!
যাদবপুরে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় ধৃত সৌরভ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। ২০২২ সালে অঙ্কে স্নাতকোত্তর পাশ করে গিয়েছেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনায় বাড়ি। বাবা টিউশনি করে অনটনের সংসার চালান। এলাকার স্কুলেই পড়াশোনা করেছেন সৌরভ। সেই স্কুলের ফার্স্ট বয় ছিলেন তিনি। করোনা অতিমারির সময় সেই স্কুল এবং গ্রামে স্যানিটাইজ়ার, মাস্ক বিলি করেছেন। সেই স্কুলের শিক্ষকেরা এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে, র্যাগিং করতে পারেন সৌরভ! অথচ, এই সৌরভকে র্যাগিংকাণ্ডের ‘কিংপিন’ বলে অভিহিত করেছে পুলিশ।
ধৃত মনোতোষ সমাজতত্ত্বের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। উজ্জ্বল হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরা তাঁর হাসিমুখ ছবি মনোতোষের ফেসবুকে রয়েছে সম্ভবত। বাড়ি হুগলির আরামবাগে। বাবা শান্তিনাথ জানেন না, কী কারণে গ্রেফতার হয়েছেন তাঁর ‘মুখচোরা’ ছেলে। মায়ের মনে হচ্ছে, তাঁর ছেলে ছাত্র রাজনীতি করেন। তাই তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে।
বাঁকুড়ার মাচানতলার বাসিন্দা দীপশেখর বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর বাবা-মা বলছেন, বিশ্বাস করেন না ছেলে এ কাজ করতে পারে! তবে তাঁরা প্রকৃত দোষীদের শাস্তি চান। ধৃত যাদবপুরের প্রাক্তনী সপ্তকের পরিবার তাঁর গ্রেফতারির খবর পাওয়ার পর থেকে বাড়িতে তালা মেরে নিরুদ্দেশে। তবে তাদের সোনার দোকানটি খোলা আছে। ধৃত প্রাক্তন অসিতের মা সুমিত্রা বলছেন, তাঁর ছেলে নির্দোষ। ধৃত সুমনের বাবা গৃহশিক্ষক। দিদি কলেজে পড়ান। সুমন কলেজে দর্শনশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তার পরে দর্শন নিয়েই স্নাতকোত্তর স্তরে লেখাপড়া করতে যাদবপুরে ভর্তি হয়েছিলেন। বাড়ি গেলে ভাইবোনদের সঙ্গে আড্ডা মারতেন, খুনসুটি করতেন। তিনি কাউকে র্যাগিং করতে পারেন এবং সে জন্য কারও মৃত্যু হতে পারে— বিশ্বাসই করতে পারছেন না তাঁর বাবা জগদীশ। উল্টে বলছেন, যৌথ পরিবারের সদস্য তাঁর পুত্র এ কাজ করতে পারেন না।
ধৃত হিমাংশু গণিতের ছাত্র। এখন ডাটা সায়েন্সে পিএইচডি করছেন। বাবা মারা গিয়েছেন। মা শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে পড়ান। ৮ বা ১০ হাজার টাকা মাসিক পারিশ্রমিক তাঁর। হিমাংশুর দিদি কলকাতায় পড়াশোনা করেন। হিমাংশুর গ্রেফতারির খবর পেয়ে তাঁর মামা কলকাতায় এসেছেন। তাঁর দাবি, বড়দের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা পর্যন্ত বলেন না ভীতু এবং সাদাসিধে হিমাংশু।
ধৃত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট জয়দীপের বাড়ি বর্ধমানের কেতুগ্রামে। গল্ফ গ্রিনের কাছে বিক্রমগড়ে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, ঘটনার দিন রাতে পুলিশকে মেন হস্টেলে ঢুকতে বাধা দিয়েছিলেন। যাদবপুরের ছাত্র সংগঠন ফ্যাসের ‘চেয়ারপার্সন’ পদে একদা প্রার্থী জয়দীপ পাশ করে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় এবং হস্টেলের সঙ্গে সম্পর্ক চোকাতে পারেননি। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ের উপর হামলার ঘটনাতেও নাম জড়িয়েছিল জয়দীপের। বাবা বংশীলালের মিষ্টির দোকান আছে। আছে চাষের জমিজমাও। ঘটনাচক্রে, জয়দীপের দাদা শুভদীপও যাদবপুরের প্রাক্তনী। ছেলের গ্রেফতারির খবর পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মা উত্তরা।
টুকরো টুকরো ঘটনা সব। টুকরো টুকরো ছবি। অসুস্থ, চিন্তিত, উদ্বিগ্ন এবং হতভম্ব অভিভাবকদের। কেউ বিশ্বাস করতে পারছেন না। কেউ খবর শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কারও দুরারোগ্য অসুখ তাঁকে আশার আরোগ্য থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে আরও কয়েক কদম। পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন প্রান্তের আরও প্রান্তিক পরিবার থেকে এই সমস্ত ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি ভেসে আসছে প্রতি দিন।
দেখতে দেখতে, পড়তে পড়তে, শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, ধৃতদের পরিবারও যেন কোথাও একটা বন্দি হয়ে পড়েছেন! এক অনির্দিষ্ট অন্ধকার বৃত্তের মধ্যে। পুলিশি হেফাজতে নিয়ে যাওয়ার সময় এক ধৃত পড়ুয়া প্রিজ়ন ভ্যানে ওঠার আগে মধ্যমা দেখিয়েছেন। সেই ভঙ্গি অশ্লীল তো বটেই। কিন্তু তার চেয়েও তার সঙ্গে বেশি করে মিশেছিল অবজ্ঞা— আমি এ সবে থোড়াই কেয়ার করি!
হয়তো তা-ই। হয়তো সত্যিই এ সবের তোয়াক্কা করেন না তাঁরা। হয়তো পাল্টা আখ্যান তৈরি করে নেন মনে মনে। যেমন আদালতে হাজির করানোর সময় ধৃত সৌরভ চিৎকার করেছেন, যাদবপুরের মেন হস্টেলে সে দিন রাতে কোনও র্যাগিং হয়নি। তিনি ‘গরিব’ বলে তাঁকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
‘ফাঁসানো’ হচ্ছে, সে দাবি সৌরভের নিজস্ব। কিন্তু এটা তো সত্যিই যে, এঁরা সকলেই গরিব ঘরের সন্তান। মেধার জোরে যাদবপুরে পড়তে এসেছেন। কিন্তু তাঁরা র্যাগিংকে কোনও অন্যায়, কোনও পাপাচার বলে ভাবতে শেখেননি। ভাবেন র্যাগিং হল বিশুদ্ধ মজা। মশকরা। হয়তো বহু যুগ আগে সেটাই ছিল। খানিক যৌনগন্ধী এবং খানিক নতুন ছাত্রদের অপারগতা নিয়ে খেলা করা। কিন্তু তার সঙ্গে দৈহিক কিছুর কোনও সংশ্রব ছিল না। যেটা এখন অহরহ হয়। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে যে এই ‘মজা এবং মশকরা’ শেখানো হয়েছিল, তার দায় কে নেবে? এর ফলে যখন র্যাগিংয়ের মতো অন্যের একটি ঘৃণ্য অপরাধে একটি ছাত্রের অকালমৃত্যু ঘটে যায়, তখন তার অভিঘাত তো একটি মৃত্যুতেই আটকে থাকে না। এক জনের প্রাণ যায়। কিন্তু আরও অনেকের জীবন, তাদের পরিবারগুলো অন্ধকারে ডুবে যায়। সারি সারি নাচার, অসহায়, বিস্মিত এবং দুঃখী মুখ ঘিরে ফেলে পরিপার্শ্ব।
সেই মুখগুলো কি ভাবছে, তাদের সন্তানদের কারা অন্যায়ের পরিবেশ তৈরি করতে দিলেন? কাদের দেখেও না-দেখার ফলে এই অন্যায়ের পরিসর তৈরি হল? যাঁরা এই গ্রাম-মফস্সল শহর থেকে আসা মেধাবী ছাত্রদের স্বাধীনতা এবং দায়িত্ববোধের ভারসাম্য শেখাতে পারলেন না, যাঁরা মধ্যমা দেখানোর ঔদ্ধত্য তৈরি হতে দিলেন, তাঁরা কি যাদবপুরের নিজস্ব অভিভাবক শ্রেণি? তাঁদের প্রশ্রয়েই তো যাদবপুরে আন্দোলনের পরিবেশ, পরিসর তৈরি হয়েছে। যে পরিবেশে অন্যান্য আন্দোলনের স্বাধীন কণ্ঠস্বর তৈরি হল, সেই পরিবেশে র্যাগিং প্রতিরোধে কোনও আওয়াজ উঠল না! যে ‘ঐতিহ্য’ বছরের পর বছর ধরে চক্রবৎ ঘুরে যাচ্ছে, মহাকালের সেই রথের চাকা কেউ থামানোর চেষ্টা করলেন না! এত শোরগোলের জন্য সেই রথচক্রে পিষ্ট হতে হল এক ছাত্রকে! তার পরেও মধ্যমা দেখানো হয়! দেখানো যায়! আশ্চর্য!
মনে হচ্ছিল, এই দুর্বিনয়, এই মধ্যমা দেখানোর অশ্লীল ঔদ্ধত্য কি এক দিনে তৈরি হয়? কারা এই পড়ুয়াদের দুর্বিনীত হতে সাহায্য করেছেন বছরের পর বছর? তাঁরাই কি এই ছাত্রদের একটু একটু করে নেশা ধরিয়ে দেওয়ার মতো একটু একটু করে দুর্বিনীত হওয়া ধরিয়ে দিয়েছেন? যেখানে সবলদের দলবদ্ধ হয়ে দুর্বলের উপর অত্যাচার করাটাই দস্তুর?
সেই অতিবিপ্লবের শিক্ষার প্রকাশই কি পুলিশের প্রিজ়ন ভ্যানে ওঠার সময় অবলীলায় মধ্যমা প্রদর্শন? সেই প্রদর্শনী দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল ওই নাচার, দুঃস্থ, অসহায় মুখগুলো আসলে এক স্বেচ্ছা-আরোপিত অভিভাবকত্বের শিকার। বিস্মিত এবং অবিশ্বাসী চোখগুলোয় যে হতবাক ভাব দেখছি, সেটা অহরহ এক অন্য জগতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
যে জগতে একইসঙ্গে রয়েছে যাদবপুরের অতিবিপ্লবী মধ্যমা। তার বিপ্রতীপে রয়েছেন এক পুত্রহারা আশাকর্মী মা। রয়েছেন এক বেসরকারি ব্যাঙ্কের করণিক পিতা এবং হতবাক ছোট ভাই। সেই তিন জোড়া অশ্রুসিক্ত জীবনের সঙ্গে একই সারিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিছু স্তম্ভিত, বিস্মিত, অবিশ্বাসী এবং হতবাক মুখ।
মরা মাছের মতো নিষ্পলক চোখে সেই দৃশ্য দেখছে এই সমাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy