সুন্দরবনের এক দ্বীপের লেজের ডগায় স্কুলবাড়ি। ২০০৪ সালের কথা। সদ্য স্কুল সার্ভিসের চাকরি পাওয়া দু’টি চোখ আটকে যায় দেওয়ালে ঝোলানো বিভিন্ন সাইজ়ের বেতের দিকে। মনে পড়ে, পথের পাঁচালী-র প্রসন্ন গুরুমহাশয়ের কথা। গুরু যেখানে শিক্ষাদানের ক্ষমতা ও উপকরণের অভাব বেতের সাহায্যে পূর্ণ করার চেষ্টা চালিয়ে যান।
কিছু পরেই প্রবল আর্তনাদ। টেনের ছাত্রকে প্রধান বা সহশিক্ষক বেদম প্রহার করছেন। কিছু বেশি দিন চাকরি করা শিক্ষক পাশ থেকে বলেন, পাশেই বাংলাদেশের সুন্দরবন। ছেলেটি ব্যাগে দেশি রিভলভার নিয়ে এসেছে। দালালের হাতে পৌঁছে দিতে পারলেই টাকা। বেতের বাড়ি যেন সপাং করে নিজেরই গায়ে পড়ে। মনে পড়ে, স্কুলের প্রথম প্রজন্মের হতদরিদ্র পড়ুয়াদের সেফটিপিনে স্ট্র্যাপ আটকানো হাওয়াই চপ্পল, বিবর্ণ ইউনিফর্ম। মা-বাবারা হাঁটুজলে মীন ধরেন বা শহরে বাড়ির ‘কাজের লোক’। মনে হয়, এই অবস্থায় অপরাধ যতই ভয়ঙ্কর হোক, বেত তার সমাধান নয়। ছোট থেকে সে এই স্কুলে পড়েছে। পাঠ্যপুস্তকে লসাগু, গসাগু-র বাইরে তাকে জীবনবোধের কতখানি শিক্ষা দিয়েছে এই স্কুল? উন্নতির কোনও শর্টকাট হয় না, এই কথাটা মনে রাখতে পারার মতো করে শিখিয়েছে কি? কিশোর হৃদয়ে ছাপ ফেলতে পারে, এমন ভাবে কি নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছে? বেত্রাঘাতের পক্ষে কি সম্ভব সেই ঘাটতি পূরণ করা?
যে কথাটা অভিভাবকরা প্রায়শই ভুলে যান তা হল, তাঁদের মুখের কথায় নয়, তাঁদের দেওয়া জ্ঞানে নয়, বাচ্চারা তাঁদের আচরণ দেখে শিখছে। বহু অভিভাবকেরই নালিশ, সন্তানের বই পড়ার অভ্যাস নেই। যিনি নিজে লেখাপড়া শেখার সুযোগ পাননি, তেমন অভিভাবকদের কথা বাদ দিই। কিন্তু, অন্য যে অভিভাবকরা এই অভিযোগ করেন, তাঁরা কি নিজেরা বই পড়েন? না কি, সন্ধে হতেই ডুবে যান চ্যানেলের নবরূপের বহুবিবাহ, পরকীয়া আর ষড়যন্ত্রের কাহিনিতে, আর আশা করেন যে, সে সময় আপনার গোপাল ও রাখাল সুকুমার বা বঙ্কিম-রবীন্দ্র সাহিত্যসমুদ্রে ডুবে থাকবে!
বাবা-মা হিসেবে আমরা দায়িত্ব পালন করি, কিন্তু সেই ছেলেটির মুখোমুখি বসি না, যার ইচ্ছে ফুটবল শেখার। ব্যবসায়ী অভিভাবক সন্তানকে অনিশ্চিত জীবনে পাঠাবেন না, তাই ছেলেটি ডাক্তারি পড়তে বাধ্য হচ্ছে। সেই মেয়েটির কথা কি মনে পড়ে, যে ক্রিকেট খেলতে চায়, অথচ সুকুমারবৃত্তি রক্ষার্থে মা বাবা পাঠিয়েছেন নাচের স্কুলে? প্রতিটি বিষয়ে দু’টি করে শিক্ষক রেখে ইঁদুরদৌড়ের সময় নষ্ট করতে দেওয়া হল না যাদের, জুতে দেওয়া হল ব্যস্ততম কোচিং ক্লাসে, সেটা তার কাজে লাগছে কি না, অভিভাবকরা কি সেই খোঁজ রাখেন? বাংলা পড়তে চাইলে ভবিষ্যৎহীনতার কথা তুলে পড়ুয়াকে নিরুৎসাহ করেন অভিভাবক। আবার তিনিই গদগদ চিত্তে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করেন। হিন্দিতে বই লিখে বুকার এসেছে বলে আজকের উল্লম্ফনেও মনে রাখবেন, একটিমাত্র ভাষা নেওয়ার ‘অপশন’ দেখলে ইংরেজি থাকলে বাংলার মতো হিন্দির দিকেও কেউ ফিরে তাকান না।
জনসংখ্যার অনুপাতে কাজের সুযোগ কমে আসছে বলে অভিভাবকেরা চিন্তিত। কিন্তু পরিত্রাণের উপায় হিসেবে বাচ্চাকে নোটের পাতা গিলিয়ে দিলে ‘তোতা-কাহিনী’র তোতা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তীব্র প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় নিজের উপর আস্থা, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের প্রয়োজন। টিউশন থেকে টিউশনান্তরে ভ্রমণ আর বিদ্যাবমনে পরনির্ভরশীল ছাত্র কি এগুলি অর্জন করতে পারে? রাজনৈতিক পালাবদলের ফলে সিলেবাসের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পর এগারো ক্লাসে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ়ের অনুবাদ পড়ানোর সময় শিক্ষকের নিশ্চয় খেয়াল হয়, এত দূর আন্তর্জাতিক মননের উত্তরাধিকারী করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সব ক’টা ধাপ পেরিয়ে এসেছে তো শিক্ষার্থী? ভাষা পড়তে পারলেই তো হয় না, বিষয় অনুধাবন করতে হয়। শিক্ষার্থীর অমনোযোগ, নেট আসক্তি— জানা কথা। একদা শিক্ষকের কাজটি প্রায় অঘোষিত জরুরি পরিষেবার মতো ছিল। সেই গুরুদায়িত্ব থেকে তাঁকে একটু একটু করে সরিয়ে শিক্ষার বাইরে বহু দায়িত্ব দিয়ে উত্তম করণিক তৈরির চেষ্টা চলছে। ফলে তিনি লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারছেন না।
১৯৮৫ সালে শান্তিনিকেতনে পড়তে আসা মেধাবী মেয়ে বলেছিল, সে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়বে। সেই আমলে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়া মেয়েটির ছেলে ট্যাটু শিল্পী হল আর তার বান্ধবী জার্মানির চিড়িয়াখানায় গরিলা দেখভালের দায়িত্ব নিল। এক বন্ধুর ছেলে স্কুবা ডাইভিং প্রশিক্ষক হল। অবাক হননি, কেউ কেউ ভেবেছিলেন সময় বদলেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বিচিত্র পেশার দুয়ার খুলে গেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। ইউক্রেন থেকে যে ছাত্রদের ফিরিয়ে আনা হল, তাদের বেশির ভাগই ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিল। গ্যালিলেও বিষয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন, তিনি ভালবাসতেন সঙ্গীত ও চিত্রকলা। নিজের ইচ্ছা অনুসারে চলতে পারলে চিত্রকর হতেন। ১৫৮১-তে সতেরো বৎসরে ঢুকলেন ডাক্তারি পড়তে। কারণ তাঁর অভিভাবকরা ভেবেছিলেন, এতেই অর্থাগমের বিপুল সম্ভাবনা।
পরের ছ’শো বছরেও অভিভাবকের মনের পরিবর্তন নেই। মারধর বন্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পান থেকে চুন খসলেই অভিভাবক ও শিক্ষকের কাছে অপমানের পথ খোলাই।
বৎসরান্তে ছাত্রদল আসে যায়, আমরা শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর পছন্দমতো বিষয় নির্বাচন, আনন্দ ও ক্ষমার দৃষ্টান্ত তৈরির বদলে চাপিয়ে দেওয়া বিষয়, অপরাধ ও শাস্তির মাপকাঠিটাকেই স্থির রেখে চলি।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy