জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-তে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে শিক্ষা প্রসারের কিছু উল্লেখ ছিল। তার উপর দীর্ঘ এই অতিমারির ফলে আমরা দেখছি, পুরোদস্তুর না হলেও খানিকটা লেখাপড়া অনলাইনেও সম্ভব। সে সব সূত্র ধরেই সম্ভবত এ বছরের বাজেট ডিজিটাল লেখাপড়ার উপর বিশেষ জোর দিয়েছে। প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি তাঁরা যে রেডিয়ো, টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেটের মাধ্যমেও পড়ুয়াদের সাহায্য করতে চান, সেটা বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন।
ডিজিটাল শিক্ষা প্রসারের পক্ষে কিছু আপাতগ্রাহ্য যুক্তি আছে। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে, যেখানে টেলিভিশন পৌঁছেছে, সেখানে সরকার-চালিত টেলিভিশন চ্যানেলে নিয়ম করে লেখাপড়া শেখানো যেতেই পারে। শুধু অতিমারির সময়ে নয়, স্বাভাবিক সময়েও। পিএম ই-বিদ্যা প্রকল্পের আওতায় এই উদ্দেশ্যে এত দিন বারোটি চ্যানেল ধার্য ছিল, বাজেটে সেটা বাড়িয়ে দু’শোটি করার কথা বলা হয়েছে। এই চ্যানেলগুলির মাধ্যমে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছেলেমেয়েরা মাতৃভাষায় লেখাপড়া শিখতে পারবে। মাতৃভাষায় উন্নত মানের ই-সহায়িকা পড়ুয়াদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। বৃত্তিমূলক পাঠ্যক্রমের জন্য থাকবে সাতশো পঞ্চাশটি ভার্চুয়াল ল্যাবরেটরি।
উচ্চশিক্ষাতেও প্রসারিত হচ্ছে ডিজিটাল শিক্ষা। বাজেট-প্রস্তাব অনুযায়ী ‘হাব অ্যান্ড স্পোক’ ধাঁচে তৈরি হবে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়। এই ব্যবস্থায়, একটা কেন্দ্র বেছে নিয়ে সেখান থেকে প্রথম শ্রেণির অধ্যাপকদের বক্তৃতা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্ররা নিজেদের জায়গায় বসেই বিশ্বমানের লেখাপড়ার সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে।
ডিজিটাল শিক্ষাই হয়তো দেশের ভবিষ্যৎ, কিন্তু এখনই তার জন্য আমাদের দেশ তৈরি কি? দেশে এখনও অনেক গ্রাম আছে, যেখানে ইন্টারনেট দূরের কথা, টেলিভিশন যোগাযোগই নির্ভরযোগ্য নয়। তারও আগের কথা, বিদ্যুৎ-সংযোগ। ২০১১-র জনশুমারি জানিয়েছিল, দেশের ৬৭.২% পরিবারে বিদ্যুৎ-সংযোগ আছে। বিজেপি সরকারের দাবি, দেশের ১০০% গ্রামে এখন বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। যদি সেটা সত্যি বলে ধরে নিই, তা হলেও মনে রাখতে হবে, গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছনো আর গ্রামের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছনো এক নয়। দেশের প্রতিটি পরিবারে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে কি না, জানার জন্য ২০২১-এর জনশুমারির ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অব ইন্ডিয়া (ট্রাই) অবশ্য জানাচ্ছে, ২০২১-এর জুন মাসে দেশে মোট ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ৮৩.৩৭ কোটি, অর্থাৎ ১০০ জন ভারতীয় প্রতি ৬১.০৬ জন গ্রাহক। এর মধ্যে শহরে বেশি (১০০ জন প্রতি ১০৫টি) গ্রামে কম (১০০ জন প্রতি প্রায় ৩৮টি), এবং কারও কারও একাধিক ইন্টারনেট যোগের পাশাপাশি কারও কারও আদৌ নেই, এ সব সমস্যা আছে। কিন্তু সব মিলিয়ে, অন্তত পরিসংখ্যানের দিক থেকে, দেশে ইন্টারনেট অন্তর্ভুক্তি নেহাত কম নয়। তা হলে কি এই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার ঘটানো সম্ভব?
ট্রাই-এর তথ্য অনুযায়ী, মোট ইন্টারনেট গ্রাহকদের ৯৭%-এরও বেশি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট পরিষেবা পেয়ে থাকেন। অতএব ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার ঘটাতে গেলে মূলত মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই সেটা করতে হবে। কিন্তু মোবাইল ফোনের অনেক সমস্যা। একে গ্রামে-গঞ্জে ভাল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না, ফোনের কথাগুলোই কেটে কেটে আসে। তার উপর, সাধারণ প্যাকেজে যেটুকু ডেটা ডাউনলোড করতে দেয়, তা দিয়ে নিয়মিত সরকারি ‘স্বয়ং প্রভা’ টিভি চ্যানেলে ঢুকে লেখাপড়া করা মুশকিল। সব থেকে বড় কথা, গরিব-ঘরের পড়ুয়াদের জন্যে মাথাপিছু একটা করে স্মার্টফোন থাকে না।
লকডাউনের সময় গ্রামে লেখাপড়ার জন্য স্মার্টফোনের ব্যবহার নিয়ে ‘অ্যানুয়াল সার্ভে অব এডুকেশন রিপোর্ট’ বা অসর-এর ২০২১ সালের সমীক্ষা থেকে জানতে পারছি, ভারতের গ্রামে ৩২.৪% পরিবারে একটিও স্মার্টফোন নেই। যে ৬৭.৬% পরিবারে অন্তত একটি স্মার্টফোন আছে, তাদের ২৭% পরিবার শিক্ষার উদ্দেশ্যে ছেলেমেয়েদের সারা ক্ষণ স্মার্টফোন দিচ্ছে। বাকিদের মধ্যে ২৬% বাড়িতে স্মার্টফোন থাকা সত্ত্বেও সেটি শিক্ষার উদ্দেশ্যে আদৌ লভ্য নয়, আর ৪৭% পরিবারে আংশিক ভাবে লভ্য। অর্থাৎ ভারতের গ্রামে যে পরিবারগুলি বাস করে, তাদের মোটামুটি অর্ধেক পরিবার বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য স্মার্টফোন দিচ্ছে না বা দিতে পারছে না। আরও ৩২% আংশিক ভাবে দিতে পারছে। এর উপর ভিত্তি করে কতটুকু ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার ঘটতে পারে?
আসলে, ডিজিটাল শিক্ষার প্রযুক্তি বিশেষ ভাবে পুঁজি-নির্ভর। এক দিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে উৎকৃষ্ট ইন্টারনেট বা টিভি সিগনালের ব্যবস্থা করতে হবে। তার জন্য বিনিয়োগ দরকার। বিনিয়োগটা যে হেতু বেসরকারি পরিষেবাদাতাদেরই করতে হবে, এবং যে হেতু লাভের সম্ভাবনা ছাড়া তাঁরা কোনও বিনিয়োগ করবেন না, তাই প্রশ্ন ওঠে, অদূর ভবিষ্যতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে ডিজিটাল শিক্ষার উপযোগী ভাল ইন্টারনেট অথবা টিভি সিগনাল পাওয়া যাবে কি? উল্টো দিকে, শিক্ষা-গ্রহীতাদের দিক থেকেও মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদিতে বিনিয়োগ দরকার। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ বেশির ভাগই গরিব। তাঁরা এই বিনিয়োগটা করবেন কী করে? আমাদের মতো শ্রম-উদ্বৃত্ত, পুঁজি-বিরল দেশে পুঁজি-নির্ভর ডিজিটাল শিক্ষা কতটা উপযুক্ত, তাই নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা প্রয়োজন।
উচ্চবিত্ত-ঘরে অবশ্য বেসরকারি ডিজিটাল শিক্ষা বেশ কিছু দিন হল চালু হয়ে গেছে। টেলিভিশনের পর্দায় বলিউডের তারকারা বিমোহিত ছাত্রকুলকে জানাচ্ছেন, অমুক অনলাইন টোল কিংবা তমুক ডিজিটাল পাঠশালায় না পড়লে ভাল করে লেখাপড়াই শেখা যাবে না। মনে হয়, এই সব ডিজিটাল পাঠশালা ভালই ব্যবসা করছে, নইলে বলিউডের রথী-মহারথীদের দিয়ে তারা বিজ্ঞাপন দেওয়াবে কী করে? প্রাইভেট টিউশনের পরিপূরক এই পাঠশালাগুলো অবস্থাপন্ন-ঘরের ছাত্রদের জন্য। কিন্তু এদের বিকল্প হিসাবে সরকার যদি বিনাপয়সার ডিজিটাল পাঠশালা খুলতে চায়, উপযুক্ত সরঞ্জামের অভাবে গরিব ছাত্ররা তার সুবিধা নিতে পারবে না।
আসল কথা, অধিকাংশ ভারতবাসীর কাছে শিক্ষার সমস্যাটা সম্পূর্ণ আলাদা। ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে বা এনএসএস-এর শিক্ষা সংক্রান্ত শেষতম রিপোর্টটি দেখলে দেশের চিত্রটা খানিকটা বোঝা যাবে। জুন ২০১৭ থেকে জুন ২০১৮ পর্যন্ত করা সমীক্ষার ভিত্তিতে এনএসএস জানাচ্ছে, ভারতের গ্রামে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সি পুরুষদের ৬৩.২%, এবং মেয়েদের ৭৬% মাধ্যমিক অবধি পৌঁছনোর আগেই স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। এর মধ্যে আবার পুরুষদের ২২.২% এবং মেয়েদের ৪১.২% একেবারে নিরক্ষর। গ্রাম ও শহর মিলিয়ে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সের ৫৫.২% পুরুষ এবং ৬৭.৫% মহিলার শিক্ষার মান মাধ্যমিকের নীচে, যার মধ্যে ১৮.১ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৪.৫% মহিলার অক্ষর পরিচয় ঘটেনি। স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব’-এ এই পরিসংখ্যানগুলো লজ্জাজনক বইকি।
ডিজিটাল শিক্ষা চালু হলে স্কুল-ছুট কমবে? নিরক্ষরতা? আসলে স্কুল-ছুট কিংবা নিরক্ষরতার সমস্যা মেটাতে গেলে গ্রামে আরও স্কুল দরকার, পড়াশোনার মানে উন্নতি দরকার। এ সবের জন্য শিক্ষার বরাদ্দ বাড়াতে হবে। হিসাব করে দেখলাম, এ বছরের বাজেটে মোট খরচের মাত্র ১.৪% স্কুলশিক্ষায় বরাদ্দ করা হয়েছে, উচ্চশিক্ষায় ০.৯৬%। ডিজিটাল শিক্ষার ঢাক না পিটিয়ে বরং লেখাপড়া শেখানোর পিছনে সরকার আর একটু খরচ করলে ভাল হত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy