১৭৮৪ সালে বার্লিন জার্নালে ইমানুয়েল কান্ট লিখেছিলেন তাঁর সুবিখ্যাত প্রবন্ধ ‘হোয়াট ইজ় এনলাইটেনমেন্ট’। ক্ষুদ্র কিন্তু ক্ষুরধার ওই প্রবন্ধে কান্ট ব্যাখ্যা করেছিলেন ‘আলোকপ্রাপ্তি’র স্বরূপ। লিখেছিলেন: এই আলোকপ্রাপ্তির জন্য তেমন কিছু চাই না, চাই শুধু স্বাধীনতা। কেমন সেই স্বাধীনতা? তেমন ক্ষতিকারক কিছুই নয়। জনপরিসরে সর্ব বিষয়ে যুক্তি-বুদ্ধি ব্যবহারের স্বাধীনতা। “কিন্তু সর্বত্র আমি শুনতে পাই, আঃ! তর্ক কোরো না তো! সরকারি আমলা ধমক দিচ্ছেন, মন দিয়ে কসরত করো! তর্ক নয়। যাজকের কণ্ঠে জলদগম্ভীর নিদান, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর! আমাদের স্বাধীনতার উপর সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ কায়েম হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কী ধরনের নিষেধ আলো আটকে দিচ্ছে, আর কোন ধরনের নিষেধ আলোকযাত্রাকে এগিয়ে দিচ্ছে? এ ক্ষেত্রে আমার জবাব হল: যুক্তিতর্কের জন্য মুক্ত পরিসর রাখতে হবে। একমাত্র তা হলেই মানবজাতি উদ্ভাসিত হবে আলোকপ্রাপ্তির বিচ্ছুরণে।”
এক বছর ধরে কান্ট এই প্রবন্ধটি তৈরি করেছিলেন, অষ্টাদশ শতকের শেষপাদে। অথচ কী আশ্চর্য, বর্তমান ভারতের প্রেক্ষিতে কেমন অক্ষরে অক্ষরে সবটা মিলে যাচ্ছে! কান্ট লিখেছিলেন: মানুষ তার স্বেচ্ছা-আরোপিত অপরিণত সত্তা থেকে যখন মুক্তিলাভ করে তখনই সে আলোকপ্রাপ্তি নামক গন্তব্যের সন্ধান পায়। কিন্তু এই অপরিণত মন ও মগজ থেকে বেরিয়ে আসার পূর্বশর্ত হচ্ছে স্বাধীনতা। সে কোন স্বাধীনতা? তাঁর জবাব: সেই স্বাধীনতা যার প্রভাবে মানুষ গণপরিসরে যুক্তি-বুদ্ধির আশ্রয়ে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করতে পারে। কিন্তু এমন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করতে হলে সর্বপ্রথম লাগে তর্ক করার ইচ্ছা ও বৌদ্ধিক ক্ষমতা। সেই পরিবেশ তৈরিতে কারা এগিয়ে আসবেন?
সমাজের সেই ক্ষুদ্র বর্গের মানুষদের জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছিলেন ‘সংখ্যালঘু’। বলা বাহুল্য, এই ‘সংখ্যালঘু’ অভিধার সঙ্গে ধর্ম-বর্ণ-জাত ভিত্তিক পরিচিতির কোনও সংস্রব নেই। আসলে যাঁরা নিজের মতো করে ভাবতে পারেন, সেই ভাবনাকে নির্ভয়ে জনতার দরবারে পেশ করতে পারেন এবং নিজের মত ও পথ নিয়ে তর্ক করে যেতে পারেন, এমন মানুষের দেখা অতি অল্প সংখ্যায় মেলে। এঁরা তাই দেশে দেশে, কালে কালে সংখ্যালঘু।
অথচ এঁদের সম্মিলিত ধী-শক্তিই সভ্যতার প্রাণভোমরা। স্বাধীনতার অন্বেষণ তাই মূলত আলোকপ্রাপ্তির অনুশীলন। আমেরিকার প্রথম মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ২০২১-এর নির্বাচনের প্রাক্ মুহূর্তে টুইটারে লিখেছিলেন ‘আওয়ার ডেমোক্র্যাসি ইজ় অ্যাজ় স্ট্রং অ্যাজ় আওয়ার উইলিংনেস টু ফাইট ফর ইট’। গণতন্ত্র একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার অচলায়তন নয়, এ হচ্ছে এক নিরন্তর সংগ্রামের মুক্তধারা। স্বাধীনতার সঙ্গে ‘সার্বভৌমত্ব’-এর ধারণাটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, কিন্তু আমাদের কাছে সার্বভৌমত্বের বহিরঙ্গের চেহারাটিই শুধু ধরা পড়ে। অন্তরঙ্গ থেকে যায় অন্তরালে।
যে সার্বভৌমত্বের ধারণার সঙ্গে আমরা প্রতি দিনের জীবনে পরিচিত, তা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব। কিন্তু সার্বভৌমত্বের সদর ও অন্দরের চাল ও চলন আসলে ভিন্ন। পশ্চিমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সার্বভৌমত্বকে দেখেছেন। তাঁরা সমাজ, সংসার, আইন-আদালত, ন্যায়, ধর্ম ইত্যাদি যাবতীয় বিভঙ্গে আধুনিক সার্বভৌম রাষ্ট্রকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। রাষ্ট্রের জন্মবৃত্তান্তের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে সার্বভৌমত্বের বিভিন্ন ধারণার গভীর সংযোগ। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে আদর্শ অবস্থায় নাগরিক হবেন সার্বভৌম। নাগরিকরা তাঁদের অর্জিত ও পুঞ্জীভূত সার্বভৌমত্বের সামান্য অংশ রাষ্ট্রকে দান করেছেন বলেই তো রাষ্ট্র নামের প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হল! রাষ্ট্র তো নাগরিকদের জন্ম দেয়নি। নাগরিকরাই রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন। এটাই ঐতিহাসিক সত্য। ফলে রাষ্ট্র নাগরিক বাছাই করতে পারে না, নাগরিক তাঁর রাষ্ট্র বাছাই করবে। কিন্তু রাজ্যে রাজ্যে এনআরসি-খাতা করে অনাগরিক তৈরি করার জন্য কেন্দ্রের যে-প্রকল্প আমরা দেখছি এতে তো রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে চুক্তির খেলাপ হচ্ছে। রাষ্ট্র তার নীতি প্রণয়নে ‘সাধারণ ইচ্ছাপত্র’ (জেনারেল উইল)-এর কথা বেমালুম ভুলে যাবে? এ কথা বোঝার জন্য বেশি দূর যাওয়ার দরকার কী? ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাটি স্মরণে আনলেই চলে।
জানা কথা ক’টি নতুন করে বলার কারণ মূলত দু’টি। প্রথম কারণ কান্ট নিজেই, তিনশো বছর পূর্ণ হল তাঁর, এই বছর। দ্বিতীয় কারণটি দেশের স্বাধীনতার চলমান ‘অমৃতকাল’, যখন নাগরিকদের ভুলিয়েই দেওয়া হয়েছে যে, সিকি-শতাব্দী ধরে স্বাধীনতার কোন অভিজ্ঞান স্মরণ করবে তাঁরা। সঠিক কাজ হত ‘স্বাধীনতা-হীনতায়’ বাঁচতে না চেয়ে যাঁরা কাড়াকাড়ি করে ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ প্রাণ বলিদান করেছিলেন তাঁদের কথা দেশময় ছড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু এতে যে সঙ্ঘ পরিবার অস্বস্তিতে পড়বে! তাই ঠিক হয়, এ বার দল বেঁধে ‘আমরাই’ লিখব স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। মনে পড়ে যায় পূর্ব পাকিস্তানে আয়ুব খানের শাগরেদদের রবীন্দ্রসঙ্গীত লেখার প্রকল্পের কথা!
এবেলা পুরনো প্রশ্নটিকে আবার নাড়াচাড়া করা যেতে পারে। আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম কেন? শুধু কি ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম? না কি আমরা নির্ভয়ে নিজের মতো করে ভাবতে চেয়েছিলাম, সেই ভাবনা প্রকাশ করার স্বাধীনতা চেয়েছিলাম? আমরা শাসকের গাত্রবর্ণ বদলে দেওয়ার স্বাধীনতা চাইনি, শাসকের ভাবনার শাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম। অথচ তা হল না।
এক দশক আগে এক বক্তৃতায় রোমিলা থাপর তুলেছিলেন মোক্ষম প্রশ্ন। ‘টু কোয়েশ্চেন, অর নট টু কোয়েশ্চেন? দ্যাট ইজ় দ্য কোয়েশ্চেন।’ উত্তর, হ্যাঁ, আমরা প্রশ্ন করব। নিরেট নির্মম শাসনযন্ত্রের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করবে আমাদের নাগরিক প্রশ্নমালা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy