ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইআইটি খড়্গপুরের ক্লাসরুমে দলিত-জনজাতি পড়ুয়াদের প্রতি এক শিক্ষকের অশালীন মন্তব্য সম্প্রতি খবরে এসেছে। তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তির দাবিও উঠেছে, অভিযুক্ত শিক্ষক তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি, বিপুল ক্ষমতার কথা শুনিয়েছেন। শিক্ষক হিসেবে এই সবই নির্লজ্জ আচরণ। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই যে এক দল দলিত ও জনজাতি পড়ুয়ার জন্ম, বংশ, সংস্কৃতি-পরিচয়কে আক্রমণ ও লাঞ্ছনা করা হল, তা কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? না কি শিক্ষকমহলে এমন ঘটনা বার বার ঘটে? বছর পনেরো আগে কলেজ হস্টেলের খাওয়ার ঘরে শুনতাম, “অমুক দাদা বলছিল, আইআইটিতে কেউ পড়া না পারলে স্যররা জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি সংরক্ষণের সুযোগে এসেছ?” বহু পথ ও বিস্তর বাধা পেরিয়ে যে দলিত-জনজাতি শিক্ষার্থী আইআইটির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসছে, তাকে লাঞ্ছিত করার অর্থ তাঁর বহু প্রজন্মের লড়াইকে অস্বীকার করা। অসংবেদনশীল আমরা তা বুঝি না।
দেশের তথাকথিত উচ্চ মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সাধারণত শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না বললেই চলে। প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ুয়াদের কণ্ঠ দমিয়ে রাখতে রাষ্ট্র প্রায়ই আইআইটির দৃষ্টান্ত তুলে ধরে, জারি করে নিত্যনতুন ফরমান। মধ্যবিত্ত মনেও রাষ্ট্র চালিয়ে দেয় সেই নীতিপুলিশের বাক্য, ফলত পড়ুয়ারা যে সামাজিক শ্রেণি থেকে আসছে, তার একটি সম্মতি আদায় করে নেয় এই মর্মে যে, নীরবতা ও বিদ্যাভ্যাস পবিত্র কর্তব্য। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় দলিত-জনজাতি ছাত্রছাত্রীরা নানা ভাবে লাঞ্ছিত হয়। কখনও কখনও লাঞ্ছনাকারী নিজেও বুঝতে পারে না সে লাঞ্ছনা করছে, তা এমনই সহজ সামাজিক নিয়ম হয়ে গিয়েছে। অন্য দিকে, দলিত-জনজাতি মানুষ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে, শুধু এই কারণেই বহু শিক্ষকের প্রকাশ্য গাত্রদাহ দেখা যায়।
যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দৃঢ় ছাত্র আন্দোলনের পরিবেশ আছে, সেখানে দলিত-জনজাতি পড়ুয়ারা তাদের লাঞ্ছনার বিচার পায় তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি। সেই লাঞ্ছনার কথা সমাজে পৌঁছেও যায়। কিন্তু বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই নিত্য ঘটে চলা লাঞ্ছনা কোনও বৃহৎ চেতনা বা আন্দোলন তৈরি করতে পারে না, কারণ পড়ুয়াদের দাবি প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক মঞ্চ এই প্রতিষ্ঠানগুলোয় থাকে না। কয়েক বছর আগে আইআইটি চেন্নাইয়ে কিছু পড়ুয়া দলিত চিন্তাবিদ পেরিয়ার ও অম্বেডকরের নামে একটি পাঠচক্র তৈরি করে নিজেদের উদ্যোগে জ্ঞানচর্চা শুরু করলে প্রতিষ্ঠানের গাত্রদাহ হয়। ফৈজ আহমেদ ফৈজের লেখা ‘হম দেখেঙ্গে’ আইআইটি কানপুরে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠলে কর্তৃপক্ষ ক্রুদ্ধ হন, অসহিষ্ণু রাষ্ট্রের মতোই আচরণ করতে থাকেন।
প্রাথমিক শিক্ষায় যত্নবান হইনি বলেই আজ সমাজের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এত দূরত্ব। অভিযুক্ত শিক্ষক যে দলিত-জনজাতি পড়ুয়াদের পড়াচ্ছিলেন, তারা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পদে পিছিয়ে আছে বলে আইআইটি একটি প্রস্তুতি ক্লাসের ব্যবস্থা করে, সেখানে এই ছাত্রদের অসংরক্ষিত আসনে সুযোগ পাওয়া ছাত্রদের থেকে আলাদা করে, আইআইটির উপযুক্ত করে তোলার চেষ্টা করা হয়। এর ফলে দলিত-জনজাতি ছাত্রদের শুরু থেকেই এক বিশেষ পরিচয়-চিহ্নায়ন ও বৈষম্যের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। নিজেদের ‘ভাল’র জন্য তারা এতে আপত্তি করে না, যদিও এ পদ্ধতিও এক প্রকারের লাঞ্ছনা, প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই ‘অপর’ তৈরির প্রক্রিয়া। বুনিয়াদি শিক্ষা জোরালো হয়নি বলে, সমাজের সর্বস্তরে শিক্ষার বিস্তার হয়নি বলে দলিত-জনজাতি পড়ুয়াদের এই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রতিষ্ঠান তাকে দুর্বল মেধার বলে দাবি করে, প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ‘অপর’ করে তোলে। এই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরেও প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ও বাইরে তারা সমান মর্যাদা পায় না।
নিরন্তর চেতনা নির্মাণই এই পদ্ধতিগত অবদমন রোধে পথ দেখাবে। শিক্ষকদেরও এমন ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম দরকার, যেখানে তাঁরা বিভিন্ন জাতি-বর্ণ-শ্রেণি থেকে আগত পড়ুয়াদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারবেন। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটা বড় অংশের শিক্ষকরা আসেন নাগরিক উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে, ফলত দলিত-জনজাতি জীবনের প্রতিবেশ-বোধ তাঁদের থাকে না। অনেকেই বুঝতে পারেন না ক্লাসে ঠিক কতটা বৈচিত্রপূর্ণ সমাজের, ঠিক কতটা শোষিত সমাজের ছবি তিনি দেখছেন।
প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের হাতে পড়ুয়াদের মর্যাদাবোধ ভূলুণ্ঠিত হলে সামগ্রিক ভাবে শিক্ষাই ব্যর্থ হয়। অভিযুক্ত শিক্ষক এই সত্য অনুধাবন করতে পারেননি। তিনি কেবল পড়ুয়াদের মর্যাদাহানিই করেননি, ক্ষমতার অহং ও আজন্ম লালিত জাতিবিদ্বেষকে কদর্য ভাবে প্রকট করেছেন। এতেই প্রমাণিত, আমাদের গর্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সামাজিক সাম্যের পরিবেশ তৈরিতে আসলে ব্যর্থ।
তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy