দু’টি অন্ধকার অপরিচ্ছন্ন ঘরে বন্দি তেরো জন মহিলা মনোরোগী। দায়িত্বে থাকা নার্সরা বলেছেন, এটা ডাক্তারদের অলিখিত দাওয়াই। প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক বলেছেন, ইমারত সারাইয়ের কাজ চলছিল বলে এমনটা করা হয়েছে। মহিলা মনোরোগীদের এই নিষ্ঠুর ‘চিকিৎসা’র খবরে সমাজ বিচলিত হয়েছে। গণমাধ্যমের খবরের জেরে, দোষ আড়াল করার অজুহাতগুলো তেমন ধোপে টেকেনি। সরকারের তরফে পরিদর্শন হয়েছে, কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে, এবং সে কৈফিয়ত হাস্যকর রকমের অবান্তর বলে বাতিল হয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকের বদলির খবর জানা যাচ্ছে।
কয়েক বছর আগেও এ রকম অব্যবস্থার কিছু ছবি সামনে এসেছিল। শুধু কলকাতা নয়, রাজ্যে এবং দেশের অন্য অধিকাংশ মনোরোগ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানেই কম-বেশি একই রকমের ছবি। ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ সংস্থার এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছিল, পাভলভের মতোই এক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের এক জন মহিলা আবাসিকের কথা, যিনি আক্ষেপ করেছিলেন, সারা দিন চৌহদ্দির মধ্যে ঘুরে বেড়ানো বা বসে থাকা, খাওয়া-শোয়া আর প্রাত্যহিক কাজকর্ম— এগুলো ছাড়া আর কিছু করার নেই। চাইলেও খবরের কাগজ বা বই পাওয়ার উপায় নেই।
এমনিতেই ভারতের চিকিৎসা পরিকাঠামোয় রোগীর অধিকার বিষয়টিকে বিশেষ পাত্তা দেওয়া হয় না। চিকিৎসা পরিকাঠামো, তার প্রশাসন, চিকিৎসক, নার্স— এঁদেরই স্বাভাবিক ক্ষমতাকেন্দ্র বলে মেনে নেওয়া হয়। অন্য রোগীর হয়ে তাঁর পরিবার খানিক কথা বলার চেষ্টা করলেও করতে পারেন; কিন্তু মনোরোগীদের বেশির ভাগই যে হেতু পরিবার পরিত্যক্ত, তাই তাঁদের ক্ষেত্রে সেটুকু দর কষাকষিরও সম্ভাবনা থাকে না।
এমন নয় যে, মনোরোগী পুরুষদের প্রতি অন্যায় আচরণ হয় না। কিন্তু, প্রথমেই দু’পক্ষের ক্ষমতার ফারাক বোঝা যায়, যখন কোনও মহিলা মনোরোগী আবাসিক প্রথমে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিবার-প্রতিবেশী দ্বারা হাসপাতালে নির্বাসিত হন, এবং অচিরেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। মনোরোগের সঙ্গে লিঙ্গ পরিচয়টা যোগ হলে নিপীড়নের একটা বাড়তি মাত্রা যোগ হয়। এবং সেই লিঙ্গ ও যৌন পরিচয় যদি পুরুষ-নারী বাইনারি বা দ্বিত্বের বাইরে হয়, তা হলে যন্ত্রণা আরও অনেক বেশি।
মনোরোগীর হয়ে কথা বলার সবচেয়ে বড় সহায় হয়ে উঠতে পারতেন চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক, নার্সরা। প্রয়োজনের তুলনায় মনোরোগের চিকিৎসায় পরিকাঠামোর স্বল্পতার কারণে চিকিৎসক-নার্সদের কাছে সব সময় যথাযথ সংবেদনশীলতা আশা করা যায় না, একে যদি একটা যুক্তি বলে মেনে নেওয়াও হয়, কোনও ক্রমেই এই কথাটি মানা যায় না যে, মনোরোগীর বিপরীতে চিকিৎসক বা নার্স ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করবেন। চিকিৎসার প্রত্যাশাটুকু ওখানেই নাকচ হয়ে যায়।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মনোরোগের চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি অংশ ‘শাস্তি’-কে চিকিৎসার ধরন হিসেবে বিশ্বাস করছেন বলেই মনোরোগীদের উপর এই নৃশংসতার ছবি ঘুরে ঘুরে সামনে আসছে। এই শাস্তি যে অবৈধ, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরাও বিলক্ষণ জানেন, ফলে এই শাস্তির বন্দোবস্ত লুকিয়ে করতে হয়। এই ভ্রান্ত, অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাসকে লুকোনোর জন্য প্রয়োজন হয় মনোরোগ চিকিৎসার ইমারত, হাসপাতালের বাহ্যিক সৌন্দর্যায়নের আড়ম্বর। সেই সব আড়ম্বরের আড়াল থেকে কখনও কখনও ছিটকে বেরিয়ে আসেন বিবস্ত্রা মনোরোগী, শোনা যায় অসহায়ের আর্তনাদ। সেই আর্তি এবং নগ্নতা, দুটোই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়ে ওঠে চিকিৎসা নামক ক্ষমতার চোখে। ক্ষমতাদর্পী চিকিৎসার এই হিংস্র ভানটাকে আড়াল করতে, হিংসার দায়টা চাপানো হয় মনোরোগীর উপর।
ফলে চিকিৎসার নামে হিংস্রতার এক দুষ্টচক্র চলতেই থাকে। এ ভাবে মনোরোগের চিকিৎসায় পাকাপাকি ভাবে হিংসার প্রয়োগ আমদানি করা হয়। চিকিৎসার নামে এই হিংস্র নৃশংসতাকে সামাজিক ভাবে মান্যতা দেওয়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। মনোরোগীদের জন্য মনুষ্যেতর একটা বর্গের ধারণা তৈরি করার প্রয়াস চলে। চিকিৎসার নামে হিংস্রতার সমর্থনে জনমত তৈরির চেষ্টা হয়। চিকিৎসক সমাজের সার্টিফায়েড এই মতের বিরুদ্ধে সুস্থ হয়ে ওঠা মনোরোগীকেও তাঁর লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। মনোরোগীর অধিকারের দাবিটা তৈরি হওয়ার আগেই, তাঁকে অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী করে তোলা হয়।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহায়তায়, সুস্থ বা প্রায়-সুস্থ, কিন্তু পরিবার পরিত্যক্ত, মনোরোগীদের সমাজের মূলস্রোতে পুনর্বাসন দেওয়ার জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তাঁরা যাতে স্বনির্ভর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন, সেটাই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। এই ধরনের প্রকল্প ভারতে এই প্রথম। এ রকম একটা প্রকল্প তখনই সফল হওয়া সম্ভব, যখন বৃহত্তর সমাজ এঁদের অধিকার বিষয়ে সহমর্মিতা দেখাতে পারে। প্রশাসনিক ভাবে হয়তো কোনও নজরদারির ব্যবস্থা করা যেতে পারে, কিন্তু দায়িত্বটা সমাজের। পাভলভের কালকুঠুরিতে মহিলা মনোরোগীদের বন্দি করে রাখার ব্যাপারে বৃহত্তর সমাজে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে, সেটা হয়তো খানিক আশা জাগায়। আশা এই যে, বৃহত্তর সমাজ এই মানুষদের স্বাবলম্বী জীবনের অধিকারের স্বীকৃতি দেবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy