ঘোর দুর্বিপাকের মধ্যে এসে পড়ল দিনটা। দুর্দিন অন্তরে, বাহিরে। ইতিমধ্যে বাংলা ছবি আন্তর্জাতিক আঙিনায় প্রায় ছিন্নমূল। দিশি ছবির বাজারেও তার প্রভাব ক্ষীণতর। আর্ট করার আহাম্মকি না করে বরং অস্তিত্বরক্ষার তাগিদই এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারের নিগড় ছিলই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনাকালে পাল্টে যাওয়া যাবতীয় হিসেবনিকেশ।
আমরা ভাবীকাল সত্যজিৎ রায়ের থেকে কী নিয়েছি, নিচ্ছি আর কোনটা সযত্নে পরিহার করছি? জন্মশতবর্ষে এই কথাটুকু অন্তত শুরু হওয়া জরুরি।
১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে জ্যোতির্ময় দত্তকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “চলচ্চিত্রেও নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের সময় এসেছে। এবং নোবেল পেলে তো ভালই হয়।” মার্চে হাসপাতালে শুয়েই তিনি পান ‘অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড ফর লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট’। অস্কার, যা তাঁর কথাতেই ‘সিনেমার নোবেল প্রাইজ়’।
এই অস্কার প্রাপ্তি, আর ২৩ এপ্রিল তাঁর প্রয়াণ এবং পরের দিন দূরদর্শনে লাইভ শেষযাত্রা বাঙালিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। বহুমুখী উৎসাহ ও সৃষ্টির কেন্দ্রে থাকা মানুষটি প্রায় ঐশ্বরিক ধ্রুবতারা হয়ে ওঠেন। ঠিক যেমনটি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
আনন্দবাজার পত্রিকা-র সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে লেখা হয়, “এই হাহাকার, এই শূন্যতা, একান্ন বছর আগেকার আরেকটি মৃত্যুকে স্মরণ করাইয়া দেয়। সেদিন বিদায় লইয়াছিলেন রবীন্দ্রনাথ।... রবীন্দ্রনাথ যদি তাঁহার বহুমুখী প্রতিভা লইয়া উনিশ শতকের ভারতীয় রেনেসাঁসের এক সার্থক পরিণতি, তবে সত্যজিৎ রায়ও সেই ধারার এক উজ্জ্বল উত্তরসূরি।”
এই রেনেসাঁসের প্রথম চিহ্ন অনতিক্রম্য যুক্তি। চিন্তায়, গল্পে, নাট্যে, চিত্রনাট্যে, কম্পোজ়িশনে, আলোয় এমন কিছুই করা চলবে না, যা যুক্তির জ্যামিতি অগ্রাহ্য করে। দ্বিতীয় চিহ্ন প্রকাশের সংযম, যা আদ্যন্ত নাগরিক, যা আবেগায়িত অতিরেক বরদাস্ত করে না। তৃতীয় চিহ্ন, চিন্তার উদারতা এবং আন্তর্জাতিকতা। চতুর্থ— একরোখা আত্মমর্যাদাবোধ, যার কেন্দ্রে রয়েছে নিজের প্রতি বিশ্বাস, যাকে হয়তো অহমিকা বলে ভ্রম হয়।
এহেন এক রেনেসাঁস পুরুষের কাছে এ কালের শিল্পীরা কোন মন্ত্রটি নিতে চাইছেন? তাঁর আপসহীন উৎকর্ষের, না রুচিশীল মাঝারিয়ানার? আন্তর্জাতিক ফেস্টিভ্যালে শিরোপা আদায়ের, না কি ঘরোয়া বাঁশবনে ‘সুস্থ বিনোদন’-এর তুলসীমঞ্চ স্থাপনের? স্বাধীনচেতা এককের, না কি প্রতিষ্ঠিত প্রযোজনা-পরিবেশনা সার্কিটে নিজেকে অধিষ্ঠিত করার?
প্রতি ক্ষেত্রেই, সম্ভবত, দ্বিতীয়টি।
আশির দশকের শুরুতে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন, উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর চিত্রভাষায় সত্যজিতের প্রভাব টের পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রির উপরে তাঁদের তত প্রভাব ছিল না, বরং আন্তর্জাতিক মানচিত্রে দাগ কাটার ঝোঁক ছিল। সেই ছবিটা পাল্টে যায় পরের দশকে। ১৯৯৬ সালে মুক্তি পায় ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি উনিশে এপ্রিল, চলনে-বলনে তার সত্যজিতের ছাপ। জাতীয় পুরস্কার পাওয়া তার অনুঘটক মাত্র, কিন্তু তার আসল সাফল্য নাগরিক বাঙালিকে প্রেক্ষাগৃহে ফিরিয়ে আনা, এবং পরবর্তী এক ঝাঁক চিত্রপরিচালকের উঠে আসার রাস্তা করে দেওয়া। ঋতুপর্ণদের পোঁতা সেই চারা এখন ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম নিয়ামক শক্তি।
আসলে সত্যজিৎ শুধু আইকন নন, তিনি রোল মডেল। ছাপোষা বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা কোন পথে প্রতিভা সম্বল করে ছবি তৈরির বিপুল লগ্নি করতলগত করতে পারে, সেই রাস্তা তাঁরই দেখানো। ইদানীং ঘুরে দাঁড়ানো বাংলা ছবির অন্তরের চরিত্রটিও আসলে সত্যজিতের রচে দেওয়া। তার কিছুটা নাগরিকতা, তবে নগরকেন্দ্রিকতাই বেশি।
সত্যজিতের নাগরিকতা কেমন? আদ্যন্ত গ্রামীণ গল্প নিয়ে তাঁর পথের পাঁচালী ছবিতে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত সর্বজয়া চরিত্রটি যেমন। দৃষ্টি প্রক্ষেপ থেকে সংলাপ, সংযত বিষাদে নগর তাঁর প্রতি পরতে। অপরাজিত থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাপুরুষ থেকে ‘কলকাতা ট্রিলজি’— নাগরিকতা তাঁর অধিকাংশ সেরা কাজের শিরদাঁড়া। যদিও সেই প্রশ্নাতুর আধুনিকতা যা অজ পাড়াগাঁ থেকে দার্জিলিঙের ম্যাল, সর্বত্র অন্তর্দৃষ্টির অস্বস্তি জাগিয়ে রাখে, তার বদলে এখনকার কাজে বাইরের রংদার খোলটিরই যেন কদর বেশি।
অবশ্য তারও কিছু যুক্তি আছে। পথের পাঁচালী নামে কার্যত ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ (ব্যবসায়িক প্রযোজক নেই) ছবি দিয়ে যাঁর যাত্রা শুরু, তিনিই লিখে গিয়েছেন, পরিচালককে “যেমন দেখতে হবে শিল্পের দিক, তেমনি দেখতে হবে ব্যবসার প্রয়োজনটা, জনসাধারণের চাহিদাটা।” লিখেছেন, “শুধু আর্ট করে ইন্ডাস্ট্রি বাঁচবে না...।” কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তিনি নিজে এই চাহিদার কোনও তোয়াক্কাই করেননি। অসঙ্কোচে মোটা দাগের ভারতীয় দর্শককে তুলোধোনা করেছেন। সেই সঙ্গে বলেছেন, “আই ডু হোয়াট আই ওয়ান্ট টু ডু।” সিনে সোসাইটি পত্তনের দিন থেকে সারা জীবন চেয়ে এসেছেন দর্শকের চেতনার উন্নতি, সেই লক্ষ্যে সিনেমার নির্মাণ ও চর্চা।
এমন একটি লোক প্রযোজকের টাকা ফেরাতেন কী করে? দু’চারটে পরশপাথর, নায়ক, অরণ্যের দিনরাত্রি হয়তো বক্স অফিসে সফল। প্রবল বাজারসফল গুপী-বাঘা আর ফেলুদা। কিন্তু সে সব তো হাতে গোনা। সত্যজিৎ নিজেই বলেছেন, স্বদেশে তাঁর বাজার সীমিত। কিন্তু তাঁর ছবি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রায় নিয়মিত পুরস্কার এনেছে, নগদও এনেছে। প্রযোজকের জন্য বাড়তি এনেছে যশ। কিন্তু সেই পন্থা অধিকাংশ পরিচালকের সাধ্যের অতীত। ভাবশিষ্যেরা তাই শহুরে বাংলা ছবিকে চাঙ্গা করেছেন ঠিকই, হালফিলের বিশ্ব চলচ্চিত্রের আঙিনায় প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছেন।
সময়টাও আমূল পাল্টেছে। সত্যজিৎ এক সময়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, সিনেমা হলে বিভিন্ন রকমের ছবির টিকিটের দাম একই হয় কী করে? মাল্টিপ্লেক্সে এখন ছবি আর শোয়ের সময় অনুযায়ী টিকিটের দাম বাড়ে-কমে। আজীবন অলীক অবাস্তব হিন্দি ফিল্মকে ঠেস দিয়ে এসেছেন তিনি, গল্পে সংলাপে ইন্টারভিউয়ে। সেই বলিউডও অনেক পাল্টে গিয়েছে। স্টারডমের জায়গায় উঠে এসেছে অতিসাধারণকে কেন্দ্রে রেখে বিচিত্র গল্পের সমাহার, দেখে তাঁর ‘পটলবাবু’ হয়তো শান্তি পেতেন, রোলও পেতেন বেশি।
প্রেক্ষাগৃহের সিংহদুয়ার এখন প্রায় বন্ধ হয়ে খুলে গিয়েছে টিভি, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন স্ট্রিমিংয়ে ছবি দেখার ছোট-ছোট চোরা দরজা— একান্ত ব্যক্তিগত। যে কোনও ওয়েব কনটেন্ট শাসন করতে পারে যে কোনও ভিউটাইম, সিনে সোসাইটি মুভমেন্টের দিনেও যা কল্পনার অতীত ছিল। পুঁজি সরে যাচ্ছে পর্দা থেকে ওয়েবের দিকে। সেন্সর না থাকায় ‘সাহসী’ হচ্ছে গল্প, ট্রিটমেন্ট।
কিন্তু আসল গল্পটা হয়তো তৈরি হচ্ছে তারও বাইরে। ১৯৯২ সালে অসুস্থ সত্যজিৎকে অস্কার দেওয়ার ছবি কলকাতা থেকে হলিউডের মূল মঞ্চে পৌঁছে দেওয়ার জন্য দু’টি উপগ্রহের ব্যবস্থা করে আমেরিকা। শেষ সাক্ষাৎকারে তাঁর শেষ কথা ছিল— “আধুনিক প্রযুক্তি দারুণ জিনিস, তাই না?”
তখনও কেব্ল টিভি আসেনি, কেবল দূরদর্শন। ঘরে-ঘরে কম্পিউটার ঢুকতে আরও অন্তত দশ বছর, গুগল ইউটিইউব ‘সিধুজেঠা’ হয়ে ওঠেনি, স্মার্টফোন ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ আর ভিডিয়ো কলিং তো প্রায় সাই-ফাই! কিন্তু প্রযুক্তির প্রতি সত্যজিতের এই মুগ্ধতা ছিল আজীবন। কারণটাও সহজবোধ্য। তাঁর কথাতেই সিনেমা ‘যান্ত্রিক শিল্প’। প্রযুক্তির পরিবর্তন তার বাঁকবদল ঘটিয়েছে বার বার। ‘মুভি’ কথা পেয়ে ‘টকি’ হওয়া থেকে শুরু করে থ্রি-ডি পর্যন্ত এবং আরও কত শত প্রাযুক্তিক খুঁটিনাটি। শুধু দর্শন দিয়ে সিনেমার অন্তরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।
আদ্যন্ত ইন্টারনেট-নির্ভর এই নতুন পরিসরও কিন্তু একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। এবং সেটা আদতে পুঁজিকে অতিক্রম করার চোরাগলি। সত্যজিতের মতোই আর এক জন, যিনি ছবিকে ভেঙে গড়ার তাগিদে প্রযুক্তির বহুবিচিত্র ব্যবহারে চির-উৎসাহী, সেই জঁ লুক গোদার মনে করছেন, এর ফলে স্বাধীন প্রতিস্পর্ধী ছবি তৈরির দরজা খুলে যেতে পারে। মন ও মেধা থাকলে এমনকি মোবাইলে ছবি বানিয়েও আপলোড করে দেওয়া চলে, যা মানুষ বিনা পয়সায় দেখতে পায় এবং বৃহৎ পুঁজি যাকে আটকাতে পারে না। প্রশ্ন হল, এই নয়া পরিসরে শুধু প্রতিভা সম্বল করে ভবিষ্যতের কোনও মানিক নিজস্ব পথের পাঁচালী তৈরি করে ফেলতে পারবেন কি? না কি সেটা কেবলই বিপ্লবের ইউটোপিয়া?
সাধনার ব্যাঘাত জেনে বুদ্ধ যে ভাবে মারকে অগ্রাহ্য করেছিলেন, সত্যজিৎও দলীয় রাজনীতি সে ভাবেই এড়িয়ে চলেছেন আজীবন। রাজনীতিতে অপ্রত্যক্ষ থাকার পন্থী তিনি। জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে তাঁর কাম্য রাজনৈতিক পরিবেশ সম্পর্কে সত্যজিৎ বলছেন— “যে পরিবেশে আমি, আই উইল বি ফ্রি টু ওয়ার্ক অ্যাজ় আই লাইক— কমপ্লিটলি।... একনায়কত্বে আমার ভীষণ আপত্তি— যত ফ্যাসিস্ট তত রেট্রোগেড।”
এটাই গোড়ার কথা। আমরা কি তা নিচ্ছি, না কি এড়িয়ে যাচ্ছি? শিল্পীর পরীক্ষা হয় দুঃসময়ে। হতে পারে, সেটাই শিল্পের জন্য সুসময়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy