সম্প্রতি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কোর্স চালু হয়েছে যার শিরোনাম ‘সন্ত্রাস দমন: অসম দ্বন্দ্ব ও প্রধান শক্তিসমূহের মধ্যে সহযোগিতার কৌশল’। এই পাঠ্যক্রমে ইসলামি জেহাদি সন্ত্রাসবাদকে ‘একমাত্র’ ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ বলা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কমিউনিস্ট রাষ্ট্র-পোষিত ত্রাসের সঙ্গেও একে যুক্ত করা হয়েছে। তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ঐতিহাসিক ও দার্শনিক দিক থেকে এমন পাঠ্যসূচির মধ্যে কতখানি ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তি আছে। সন্ত্রাসকে একদেশদর্শী ভাবে দেখা হচ্ছে এতে। দেশের নিরাপত্তাকেও বিরাট প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করানো হচ্ছে।
কাকে বলে ইসলামি জেহাদি সন্ত্রাস? জেহাদের অর্থ নিয়ে নানা অভিমত রয়েছে। ৯/১১-র পর থেকে গোটা দুনিয়া জেহাদকে ‘তরবারির যুদ্ধ’ বলে প্রচার করছে। এর পিছনে যুক্তির থেকে বেশি রয়েছে ইসলাম-বিদ্বেষ। ‘জেহাদ’ থেকে এসেছে ‘মুজাহিদ’ শব্দ, যিনি জেহাদে অংশ নেন তিনিই মুজাহিদিন। ইসলামের দর্শন পড়লে বোঝা যায়, যে সব ‘মুজাহিদ’ সন্ত্রাস চালায়, তাদের সঙ্গে ধর্মের যোগ প্রায় নেই বললেই চলে, ধর্মকে তারা নিজেদের হিংসার সমর্থনে অপব্যবহার করে মাত্র।
ইসলামের ইতিহাস ও দর্শনে সশস্ত্র জেহাদকে কোনও ভাবেই অনুমোদন দেওয়া হয়নি। সাধারণ মানুষকে হত্যা করা বা মানববোমার ব্যবহার ইসলামীয় নীতিশাস্ত্রের সম্পূর্ণ বিরোধী। ‘জেহাদ’-এর অর্থ সংগ্রাম বা প্রয়াস। তা যেমন জীবন সংগ্রাম হতে পারে, তেমনই হতে পারে সামাজিক মঙ্গলসাধনা। ইসলামীয় ধর্মতত্ত্বে জেহাদকে বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই বলা হয়েছে। ইসলামের দর্শন অনুযায়ী, জেহাদ হচ্ছে নৈতিক-সামাজিক ন্যায়-নীতি-নিয়ম প্রতিষ্ঠা। কোনও কোনও গবেষক এই শব্দটির দ্বারা অর্থনৈতিক উন্নয়নকেও বুঝেছেন।
ইসলামের সমস্ত শাখা বিচরণ করলে চার রকমের জেহাদের কথা পাওয়া যায়— চিন্তা জেহাদ, বাক জেহাদ, কর্ম জেহাদ এবং অস্ত্র জেহাদ। এই শেষেরটিকে বিভিন্ন মানুষ নিজেদের স্বার্থে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করে থাকেন। আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রতি-আক্রমণ করা যাবে না, আবার অন্য ধর্মের মানুষকেও আঘাত করা যাবে না— এ কথা হজরত মহম্মদের মদিনা সনদে স্পষ্ট করে বলা আছে— “তাদের সকল প্রকার নিরাপত্তা দেওয়া হবে… ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্পত্তি ও অধিকারে নিরাপত্তা থাকবে… ধর্মীয় ও বিচারব্যবস্থায় তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে…”। তৈমুর লং মুসলমান শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইকে, বাবর রাজপুতদের বিরুদ্ধে লড়াইকে ‘জেহাদ’ বলেছিলেন। গাঁধীজির অহিংস আন্দোলনকে বহু মৌলানা ‘জেহাদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। বোঝা জরুরি, জেহাদের পিছনে ধর্ম নয়, রয়েছে রাজনীতি— ক্ষমতার রাজনীতি। এই রাজনীতিই নিয়ন্ত্রণ করে ধর্মকে তথা ধর্মের ভাষ্যকে।
মুশকিল হল, জেহাদকে যদি তর্কের খাতিরে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ বলাও হয়, তা হলে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের অন্যান্য ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের কথাও বলতে হয়; নইলে সন্ত্রাস দমনের মতো পাঠ্যসূচি হয়ে দাঁড়ায় একপেশে ও বিদ্বেষী। হিন্দু শাস্ত্রের ‘ধর্মযুদ্ধ’ কিন্তু তথাকথিত জেহাদের থেকে আলাদা নয়। জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধের জন্য সেখানে চার বর্ণের একটি বর্ণ স্বীকৃত হয়েছে। ধর্মযুদ্ধে ক্ষত্রিয়কে উৎসাহিত করে শাস্ত্রে উদ্ধৃত আছে, রোগীর মতো শয্যায় ক্ষত্রিয় মারা গেলে তা অধর্ম, বীরের মতো ধর্মযুদ্ধে প্রাণ দিলেই ক্ষত্রিয়ের জীবন সার্থক—অধর্ম্মঃ ক্ষত্রিয়স্যৈষ যচ্ছয্যামরণং ভবেৎ/ বিসৃজন্ শ্লেষ্মমূত্রাণি কৃপণং পরিদেবয়ন্। কিন্তু এই সব বিষয়কে বিশ্লেষণাত্মক ভাবে পাঠ্যক্রমে না এনে কেবল ইসলামি সন্ত্রাসের কথা বলা বিজেপির ইসলাম-বিদ্বেষী কার্যক্রমেরই অংশ। আমেরিকা বা ব্রিটেন যখন সাম্রাজ্যবাদের নামে সন্ত্রাস চালায়, তখন কেউ তাকে খ্রিস্টীয় সন্ত্রাস বলে না, যদিও ক্রুসেডের মতো ধর্মযুদ্ধের কথা খ্রিস্টীয় দর্শনে আছে।
ভারতীয় শিক্ষায় ‘গৈরিকীকরণ’ বহু দিন ধরেই চলছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের পাঠ্যসূচি থেকে রামানুজনের ‘তিন শত রামায়ণ’ নামক প্রবন্ধকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যে প্রবন্ধ মহাকাব্যের বহুরৈখিকতাকে তুলে ধরে। সম্প্রতি মহাশ্বেতা দেবীর দলিত-নিগ্রহ নিয়ে লেখা গল্প ‘দ্রৌপদী’ ছেঁটে ফেলার কথা আমরা জানি। বাদ দেওয়া হয়েছে দুই দলিত লেখক বামা ও সুকৃথারানির লেখা। সমকামিতা নিয়ে লেখা ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। কিছু দিন আগে উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার রবীন্দ্রনাথের গল্প বাদ দিয়েছে উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যসূচি থেকে, ছেঁটে ফেলেছে রাধাকৃষ্ণনের প্রবন্ধ ‘দি উইমেনস’ এডুকেশন’। দর্শন বিভাগে পড়ানো হচ্ছে বাবা রামদেব ও আদিত্যনাথ যোগীর দর্শনচিন্তা।
অর্থাৎ, ভারতীয়করণ ছেঁটে ফেলে শিক্ষায় গৈরিকীকরণ করতে এই শাসক বদ্ধপরিকর। আরএসএস-এর আর এক ঘোষিত শত্রু কমিউনিস্টরা, যাদের ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেদের ন্যক্কারজনক ভূমিকা ভুলিয়ে দিতে শতবর্ষ-প্রাচীন আরএসএস তার ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর সাহায্যে জনমানসে এই ধারণা প্রোথিত করছে যে, মুসলমান-দলিত-কমিউনিস্ট মানেই দেশের শত্রু। তাদের তালিকায় সমকামীরাও যুক্ত হয়েছেন এ বার। শিক্ষার গৈরিকীকরণ করে আরএসএস-বিজেপি এই মিথ্যাকে আরও শক্তপোক্ত রূপ দিতে চায়। তাই পাঠ্যসূচির সংযোজন-বিয়োজন, এই সব বিকৃতি।
সবচেয়ে আশ্চর্য, এমন একটি কোর্স চালু করতে হলে স্বাভাবিক নিয়মে প্রচুর আলাপ-আলোচনা করতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা স্তরে। এ ক্ষেত্রে তা তো হয়ইনি, উপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপানো হয়েছে মাত্র। এই কোর্সের ‘উপযোগিতা’ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বদলে কথা বলছেন শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্করহিত শাসক দলের সাংসদ ও মন্ত্রীরা। এই ‘রাজনৈতিক পাঠ্যসূচি’ দেশের সার্বিক অকল্যাণ ডেকে আনতে পারে। সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে প্রতিবাদের সময় এসেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy