Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
Savitribai Phule

এই দুঃসময়ে তাঁকে মনে পড়ে

ফুলে-দম্পতির নারীশিক্ষা আন্দোলন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।

সমীরণ বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২১ ০৪:২৫
Share: Save:

আঠারো বছরের হেডদিদিমণি ব্যাগে রাখতেন বাড়তি শাড়ি। রাস্তায় এত লোক কাদা ছুড়ত যে, স্কুলে গিয়েই শাড়ি বদলাতে হত। গোবর, পাথর, পচা ডিমও ছুড়ে মারত। হেডদিদিমণি বলতেন— “তোমাদের গোবর পাথর, আমার কাছে ফুল।”

তিনি ভারতীয় নারীবাদের জননী। আধুনিক ভারতের প্রথম শিক্ষিকা সাবিত্রীবাই ফুলে। তাঁর জন্ম ১৮৩১-এর ৩ জানুয়ারি। পিতার নাম খণ্ডজি নেওসে পাটিল। মাত্র ৯ বছর বয়সে ১২ বছরের জ্যোতিরাও ফুলের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর।

আত্মীয়া সগুনাবাইয়ের উৎসাহে, জ্যোতিরাও বা জ্যোতিবার চেষ্টায় বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সাবিত্রীবাই ছিলেন সেই বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী। জ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ বন্ধুসম স্বামীকে উদ্বুদ্ধ করেছিল তাঁর শিক্ষাকে বহু দূর নিয়ে যেতে। তিনি আহমেদনগরের মিস ফারারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পুণের নর্মাল স্কুল থেকে টিচার্স ট্রেনিং ডিগ্রি নেন।

তাঁদের স্কুল ফের খুলল ১৮৫১-য়। সাবিত্রী এই স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা হয়েছিলেন। ১৮৫১-র শেষে সাবিত্রী ও জ্যোতিবা ফুলে তিনটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, মোট ছাত্রী-সংখ্যা দেড়শোর আশেপাশে। তাঁরা মোট ১৮টি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সাবিত্রী স্কুলে সর্বসাধারণের জন্য গ্রন্থাগার তৈরি করেন। স্কুলে দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা শুরু করেন (মিড-ডে মিল), শিক্ষার্থীদের অৰ্থসাহায্যের ব্যবস্থা করেন (স্টাইপেন্ড)। অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য ‘পেরেন্ট-টিচার মিটিং’ চালু করেন। খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষাদানের পদ্ধতির কথা বলেন এবং বিদ্যালয়ে এই পদ্ধতি চালু করেন। ছাত্রীদের থাকার হস্টেলও তৈরি করেন। সবার জন্য শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। আধুনিক ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার অনেক পদ্ধতি ও নীতি তাঁকে দেখেই অনুপ্রাণিত।

ফুলে-দম্পতির নারীশিক্ষা আন্দোলন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। পুণে অবজ়ার্ভার পত্রিকা লিখেছিল, “মেয়েদের স্কুলে ছাত্রীরা অনেক ভাল শিখছে সরকারি স্কুলের ছেলেদের চাইতে। সরকার কিছু করুক, নইলে আমাদের মাথা নিচু হয়ে যাবে।” ব্রিটিশ সরকার তাঁদের সংবর্ধনার আয়োজন করেন।

সাবিত্রীবাইয়ের ছাত্রী লক্ষ্মণ কারাদি জয়া বলেছিলেন, “মায়ের চেয়েও বেশি স্নেহ দিয়েছেন তিনি।” মহাড়ু সহাড়ু ওয়াগোলে বলেন, দরিদ্রের মুখে অন্ন জোগাতেন। কেউ ছেঁড়া কাপড়ে এলে নিজের বাড়ি থেকে শাড়ি এনে দিতেন। এতে তাঁদের খরচ বেড়ে যেত। জ্যোতিবাকে বলতেন, মৃত্যুর পর কী-ই বা নিয়ে যাব?

সে সময়ে নারীসমাজের চালিকাশক্তি, দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমাজসংস্কারক তিনি। সত্যশোধক সমাজের সম্মেলনের সভানেত্রী, সেখানে শামিল হয়েছিলেন ৯০ জন মেয়েকে নিয়ে। সামাজিক বাধানিষেধ উপেক্ষা করে বিয়ের আগে পুত্রবধূকে বাড়িতে এনে রেখেছিলেন। যাতে ছেলে-বৌয়ের বন্ধন দৃঢ় হয় (আজকের মা-বাবারা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন)। তাঁর দত্তক পুত্র যশোবন্ত ছিলেন বিধবার গর্ভজাত। যশোবন্তের সঙ্গে লক্ষ্মীর বিয়ে সম্ভবত আধুনিক ভারতের প্রথম অসবর্ণ বিবাহ।

১৮৬৩ সালে ফুলে-দম্পতি ‘বালহত্যা প্রতিবন্ধক গৃহ’ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে প্রায় ৩৫ জন ব্রাহ্মণ বিধবা আশ্রয় পান। আশেপাশের গ্রামের অস্পৃশ্য মানুষেরা তাঁদের বাড়ির কুয়ো থেকে পানীয় জল নিয়ে যেতেন। তাঁদের পাশে থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সাবিত্রীবাই।

১৮৮৭-তে জ্যোতিবা ফুলে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন। তাঁর শরীরের একটি দিক অসাড় হয়ে যায়। সাবিত্রীবাইয়ের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ১৮৯০-এ জ্যোতিবার মৃত্যু হয়। স্বামীর শেষকৃত্য নিয়েও ব্রাহ্মণ্যবাদের লাল চক্ষুকে উপেক্ষা করেন তিনি। নিজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে স্বামীর মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যান। সম্ভবত ভারতে প্রথম নারী হিসেবে স্বামীর চিতায় অগ্নিসংযোগ করে বিরল নজিরও গড়েন।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সমাজবিপ্লবী। পুণেতে প্লেগ তখন মহামারির আকার ধারণ করেছে। মায়ের কথায় যশোবন্ত সেনাবাহিনীর ডাক্তারি থেকে ছুটি নিয়ে ক্লিনিক খুললেন। সব জেনেও সাবিত্রীবাই নিজের পিঠে করে প্লেগ রোগী নিয়ে এলেন ক্লিনিকে। ছোঁয়াচে রোগ তাঁকেও ধরল। প্লেগেই মারা গেলেন তিনি, ১৮৯৭ সালের ১০ মার্চ।

জীবদ্দশায় বহু বার সম্মানিত হয়েছেন। পণ্ডিতা রমাবাই, আনন্দীবেন জোশী, রমাবাই রণদে— সে কালের শিক্ষিতা মেয়েরা তাঁর স্পর্শ পেয়েছেন। ২০১৪-য় মহারাষ্ট্র সরকার পুণে ইউনিভার্সিটির নাম বদলে সাবিত্রীবাই ফুলের নামে রেখেছে। তাঁর ১৮৬তম জন্মদিনে গুগল সম্মান জানিয়েছিল ‘ডুডল’-এ। তাঁর জীবনসংগ্রামের ইতিহাস, নারীশিক্ষার আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ভারতের মানুষ যতই জেনেছেন, ততই উঠেছে দাবি— তাঁর জন্মদিনটি শিক্ষক দিবস বলে পালিত হোক।

আশ্চর্য সমাপতনে, অতিমারি-কালেই শুরু হল তাঁর মৃত্যুর ১২৫তম বার্ষিকী। যে মহীয়সীরা অতীতের দুর্দিনে রুগ্‌ণ ভারতের মা হয়ে উঠেছিলেন, এমন দুঃসময়ে তাঁদের কথাই বড় বেশি মনে পড়ে। যেমন মনে পড়ে ভগিনী নিবেদিতাকে, তেমনই মনে পড়ে সাবিত্রীবাইকেও। প্লেগ মহামারিতে জীবন বিলিয়ে দিয়ে অসাধারণ এক সামাজিক ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।

অন্য বিষয়গুলি:

Savitribai Phule
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy