বিশ্বভারতী পরিষদ্-সভার প্রতিষ্ঠা উৎসবে সভাপতি দার্শনিক ব্রজেন্দ্রনাথ শীল আশা প্রকাশ করেছিলেন, “এ দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু সেখান থেকে ‘কাস্ট আয়রন’ ও ‘রিজিড স্ট্যান্ডার্ডাইজ়ড প্রডাক্ট’ তৈরি হচ্ছে। শান্তিনিকেতন ‘ন্যাচারালনেস’-এর স্থান হয়েছে, আশা করি বিশ্বভারতীতে সেই ‘স্পন্টেনিইটি’-র বিকাশের দৃষ্টি থাকবে।” রবীন্দ্রনাথের ‘বিশ্বভারতী’ এই শতবর্ষে যে সমস্যার মুখোমুখি, তার ইঙ্গিত ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের এই ভাবনার মধ্যে মিশে ছিল। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ব্যঙ্গচিত্র ‘ইউনিভার্সিটি মেশিন’ ঔপনিবেশিক ভারতে শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্কটকে প্রকাশ করেছিল। ‘ইউনিভার্সিটি’ নামক কলে মনুষ্য নামক উপাদান ঢোকালে চমৎকার ছাঁচমানা প্রমিত চেহারার নানা মাপের কেরানি উৎপাদিত হবে, এই ছিল সেই ছবির বিষয়। রবীন্দ্রনাথ চাননি, তাঁর শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে এ ভাবে কলের মানুষ উৎপাদিত হোক। সেই ভাবনাই ব্রজেন্দ্রনাথের এই বক্তৃতায় প্রকাশিত— এক দিকে তিনি রেখেছেন রক্ষণশীল ছাঁচমানা সচরাচর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা, অন্য দিকে ভেবেছেন রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠানে প্রাকৃতিক স্বতঃস্ফূর্তির আবহে গড়ে ওঠা ভবিষ্যৎ আদর্শের প্রসঙ্গ। তাঁর মন ও মেধা, সন্দেহ নেই, রবীন্দ্রনাথের এই প্রাকৃতিকতা, স্বতঃস্ফূর্তি, ছাঁচভাঙা পাঠ্যক্রম ও বৈশ্বিকতার ধারণাকে সমর্থন করত।
এই ধারণার সূত্র ধরেই বিশ্বভারতীতে আছে অন্য রকম ইস্কুল, সঙ্গীত-নাট্য ও চিত্রকলা শিক্ষার বিবিধ আয়োজন, পল্লিচর্চা ও সামাজিক সহযোগ নির্মাণ শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যক্রম, বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা, ইউরোপীয় ভাষা এবং এশিয়ার দুই প্রাচীন সভ্যতা জাপান ও চিনের ভাষা শিক্ষার বিভাগ। এর পাশাপাশি বিজ্ঞান ও কলা বিভাগের প্রচলিত শিক্ষার আয়োজনও চোখে পড়বে। তাকালেই বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ যে হেতু ঔপনিবেশিক উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেননি, সে হেতু তাঁর প্রতিষ্ঠানে নানা বিচিত্র-বিদ্যার আয়োজন করেছিলেন। ঔপনিবেশিক পর্বে যে বিষয়-আশয় পড়ানোর মানে হয় না বলে মনে করতেন অনেকে, যে বিষয়-আশয়কে নেশনকেন্দ্রিক পৌরুষচর্চার বিরোধী বলে ভাবতেন বহু মানুষ, সে-বিষয়গুলিকেও বহুদর্শী রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিষ্ঠানে ঠাঁই দিতে দ্বিধা করেননি।
শতবর্ষী এই প্রতিষ্ঠানের মূল দায়িত্ব ও সমস্যা এখানেই নিহিত। এই বিচিত্র, বহুমুখী প্রতিষ্ঠানটি তো আর পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নয়— কাজেই এই বৈচিত্রকে সম্পদ হিসাবে রক্ষা করতে হবে, নির্মাণ-পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে সেই বৈচিত্রকে সময়োপযোগী করে তুলতে হবে। আবার স্বাধীন ভারতে যে হেতু কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে কতকগুলি বিষয় ও নিয়ম স্বীকার করতেই হয়, সে হেতু স্বাধীন-ভারতের শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রমিত বিধি আর রাবীন্দ্রিক আদর্শের বৈচিত্র, দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে হয় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে। আর পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে বিশ্বভারতীতে কাজ করা তাই কঠিন, সন্দেহ নেই। বিশ্বভারতীর কর্মের মূল্যায়ন করার সময়ও তাই শুধু প্রমিত বিধির দিকেই খেয়াল রাখলে চলবে না, এই প্রতিষ্ঠানের স্বাতন্ত্র্য যে বিবিধ-বিচিত্রের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে, তাকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
এই কঠিন কাজ করার সময় রবীন্দ্র শিক্ষাদর্শের কয়েকটি বিষয়কে মনে রাখা জরুরি। আইনজ্ঞরা আইনের অক্ষর ও আইনের অর্থ, দু’টি বিষয়ের কথা বলেন। ‘লেটার অব দ্য ল’ মানতে গিয়ে অনেক সময় ‘মিনিং অব দ্য ল’ মানা হয় না। রবীন্দ্রনাথ নিজে আইনের কঠোর অক্ষরের চাইতে আইনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকেই মান্য করতেন বেশি। বিশ্বভারতী সোসাইটির নিয়মাবলিতে সুস্পষ্ট ভাষায় এই প্রতিষ্ঠানের বহুত্ববোধকতাকে রক্ষা করার কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, পৃথিবীর দুই গোলার্ধের মধ্যে মুক্ত ভাবে মত বিনিময়ের মাধ্যমে বৈশ্বিক শান্তি সুদৃঢ় করতে হবে। রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে তাঁর প্রতিষ্ঠানে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ নানা মত নিয়ে এসেছিলেন। সাম্প্রতিক কালে অতিমারি যেমন আমাদের সামনে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে, তেমনই প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করতে পারে এমন নানা পথ তৈরির সাহস জুগিয়েছে। এখনকার বিশ্বভারতী এই সময় প্রতি মাসে নিয়মিত আন্তর্জালে যে বক্তৃতামালার আয়োজন করেছে, তা এই মত বিনিময়ের ও নানাত্ব রক্ষার সুযোগকে সুদৃঢ় করে। কত বিচিত্র-বিষয়ে বিচিত্র ভাবে পড়াশোনা করা যায়, তা শোনার সুযোগ পেয়েছেন পড়ুয়া ও শিক্ষকেরা। বিষয়ের প্রমিত রূপের পাশাপাশি প্রমিত পথ অতিক্রম করার ইচ্ছে জেগে উঠেছে।
এক দিকে যেমন অতিমারির সময় বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন ছিল, তেমনই দরকার ছিল এই প্রতিষ্ঠানের নিকটবর্তী মানুষের সঙ্গে সহজ সংযোগ তৈরি করার। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন তার পারিপার্শ্বিককে অবহেলা করেনি। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, যে বিশ্ববিদ্যার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার পার্শ্ববর্তী সমাজের যোগ নেই, সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা সফল হতে পারে না। এই রাবীন্দ্রিক ভাবনা হাল আমলে ‘কমিউনিটি-সার্ভিস’ শব্দে খানিক ধরা পড়েছে। অতিমারির সময় সাধারণ মানুষের ভাত-কাপড়ে টান পড়েছিল, ফলে প্রয়োজন ছিল অর্থ ও অন্যান্য প্রাত্যহিক সামগ্রী সরবরাহের। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকেরা গ্রামে গিয়েছেন, মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ কর্মী ও শিক্ষকদের সহযোগে প্রায় উনিশ লক্ষ টাকা এ-কাজে ব্যয় করার সুযোগ পেয়েছেন। করুণা করছি এই অহমিকা নিয়ে নয়, পাশে আছি এই সমমর্মিতা নিয়ে কাজ করেছেন তাঁরা। ভারত বিচিত্র দেশ— সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি কেবল আন্তর্জাতিক ও সর্বভারতীয় স্তরেই কাজ করবে না, স্থানিক প্রয়োজনও মেটাবে। চিত্রকর বিনোদবিহারীর ছবি দেখে সাঁওতাল মেয়ে মতামত দিতেন। বিনোদবিহারীও তাঁর মতামত শুনে ছবি সংশোধন করতে দ্বিধা করতেন না।
এই সহযোগের যে আদর্শ এই প্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠেছিল, তারই অন্য এক অভিমুখ এই অতিমারির সময় দেখা গিয়েছে। অনেকেই চান, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শ ভারত ও বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ুক। এই প্রতিষ্ঠানের ১৯২১-এর বিধির চারের এক-এ প্রয়োজন মতো অন্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণের কথা ভাবা হয়েছিল। বিশ্বভারতীর কাজের কেন্দ্র অবশ্য এখনও পর্যন্ত বীরভূমের শান্তিনিকেতন। তবে সম্প্রতি সম্প্রসারণের সুযোগ মিলেছে। সব কিছু বিধি মতো অগ্রসর হলে ও সংশ্লিষ্ট সরকারের নিয়মানুগ সহায়তা পেলে রামগড়ে বিশ্বভারতীর আর একটি ক্যাম্পাস গড়ে উঠবে। সেখানে সমস্ত বিভাগের কাজ না চালালেও পল্লি-সংগঠন, সামাজিক-সহযোগ নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় কাজকর্ম ও পড়াশোনা চালানো হবে।
এই উদ্যোগগুলি রবীন্দ্রশিক্ষাদর্শের মূলভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সন্দেহ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কল থেকে এক রকম ছাঁটা-কাটা মানুষ তৈরি রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য ছিল না— বিশ্বভারতীর সাম্প্রতিক এই প্রচেষ্টায় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বহুত্ববোধকতার পরিচয় মেলে। শতবর্ষের প্রেক্ষাপটে এখনকার বিশ্বভারতীর মূল্যায়নের সময় এই বহুত্বের দিকটা খেয়াল রাখা দরকার।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy