Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
সকলে শেখাই, সকলে শিখি
School Reopening

অগণিত শিশু লেখাপড়া না শিখে বড় হবে, এটা হতে দেব কেন

এমন ক্ষেত্রে প্রায় কখনওই আশার কথা বলার থাকে না। আশ্চর্যের বিষয়, এ-বার কিন্তু আছে, অন্তত এই রাজ্যে।

সুকান্ত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৫:৩১
Share: Save:

যখন ছাপা কাগজ বেরোয় না প্রজাতন্ত্র দিবসের পর দিন তখন অনলাইন আনন্দবাজারে পড়লাম অতিমারির সময় সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ নিয়ে পাথরখাদান কর্মী ডোমা-র আক্ষেপ। তাঁর দুশ্চিন্তা প্রকাশ পেয়েছে প্রতিবেদকের ভাষায়: কেউ কি এগিয়ে আসবে না বিকল্প নিয়ে? পরিসংখ্যান দেখলে উদ্বেগ ঘনীভূত হয়। পশ্চিমবঙ্গে বছরে প্রায় ১৭ লক্ষ শিশু প্রাথমিকে ভর্তি হয়, সারা ভারতে পৌনে তিন কোটি। গত দুই ব্যাচের শিশুরা এক দিনও স্কুলে যায়নি, আগের ব্যাচগুলিরও শিক্ষালাভে ভয়াবহ ঘাটতি। স্থূল আন্দাজে বাংলায় আধ কোটি, সারা ভারতে ৮ থেকে ১০ কোটি বাচ্চার সম্পূর্ণ নিরক্ষর হয়ে বেড়ে ওঠার প্রবল আশঙ্কা।

এমন ক্ষেত্রে প্রায় কখনওই আশার কথা বলার থাকে না। আশ্চর্যের বিষয়, এ-বার কিন্তু আছে, অন্তত এই রাজ্যে। সত্যিই একটা কার্যকর ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন হয়েছে। শিক্ষক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি অন্যান্য শিক্ষিত নাগরিক যথেষ্ট সংখ্যায় এগিয়ে এলে ডোমার সন্তানদের মতো সাধারণ ঘরের, প্রান্তিক সমাজের শিক্ষাবঞ্চিত শিশুরাও লিখতে-পড়তে শিখবে, ভবিষ্যৎ গড়ার পথে অন্তত কয়েক কদম এগোতে পারবে, চাই কি স্বপ্নও দেখতে পারবে এক-আধটু। সমাধান প্রস্তুত, কিন্তু ডোমার বিলাপের মতোই সাইবার-বাতাসে ভাসছে। তাকে শক্ত জমিতে প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।

খুব সাধারণ স্তরের, প্রায়ই প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের ‘শিক্ষা আলোচনা’ বলে একটা সংগঠন আছে। রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলায় তার বিস্তার। এঁরা সরব আন্দোলন করেন না বলে এঁদের কথা বিশেষ কেউ জানে না। কিন্তু অনেক বছর ধরে এঁরা ঘরের খেয়ে বুনো মোষ তাড়িয়ে শিক্ষণ পদ্ধতি ও শিক্ষা পরিচালনা নিয়ে আলোচনাচক্র অনুষ্ঠিত করছেন, শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে তথ্যগর্ভ রিপোর্ট তৈরি করেছেন। অতিমারির সময় সাধারণের সন্তানের লেখাপড়ার হাল নিয়েও এঁদের একটা মূল্যবান সমীক্ষা আছে। কেবল রিপোর্ট লিখে ক্ষান্ত না হয়ে এ-বার এঁরা হাল ফেরাবার উপায় তুলে ধরেছেন, রীতিমতো খুঁটিয়ে ছক কষে ওয়েবসাইট সাজিয়েছেন (shikshaalochana.com)— যাতে সকলে তা নাগালে পান এবং প্রয়োগ করতে পারেন।

ওয়েবসাইটটির আসল রসদ রীতিমতো পরিপাটি; বিন্যাস যেটুকু অগোছালো, আশা করা যায় তা ঘষামাজা করতে পেশাদার সংস্থার সাহায্য উদ্যোক্তারা অচিরে পাবেন এবং নিতে ইতস্তত করবেন না। প্রথম পাতার নীচের দিকে আছে তাঁদের সবচেয়ে জরুরি অবদান: কোভিড পরিস্থিতিতে প্রাথমিক ছাত্রদের শিক্ষাদানের ‘উদ্ভাবনী রূপরেখা’।

পরের পাতায় পাওয়া যাবে ছ’টি হাতবই। প্রথম তিনটি প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের জন্য, আজকের বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রচলিত ক্লাসঘরের বাইরে পাঠদান-প্রণালীর বিবরণ। সত্যিকারের মূল্যবান ও অভিনব সংযোজন পরের তিনটি হাতবই, যেখানে প্রশিক্ষণহীন স্বেচ্ছাশিক্ষকদের জন্য সহজ ও প্রাঞ্জল ভাবে বাংলা-অঙ্ক-ইংরেজি শেখানোর বিশদ পদ্ধতি মেলে ধরা হয়েছে, সহজে ও নিখরচায় তার ন্যূনতম সরঞ্জাম তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আরও বিরল ও উপকারী আটত্রিশটি ভিডিয়ো (আরও নাকি তৈরি হচ্ছে), যাতে এক-একটা পাঠ কী ভাবে শেখাতে হবে, তা হাতেকলমে দেখানো হচ্ছে।

এই প্রয়াস আলগা ভাববিলাসের প্রকাশ বা শখের শিক্ষকের জোড়াতালি নয়। হাতবইগুলি তৈরি করেছেন অভিজ্ঞ শিক্ষকরা, বৈজ্ঞানিক শিক্ষাবিধি মেনে ধাপে ধাপে সাজিয়ে, অনুমোদিত পদ্ধতি অনুসারে, অথচ সকলের জন্য সহজবোধ্য করে, পরিকাঠামোর বহর কমিয়ে।

এই হাতবই ও ভিডিয়োর সাহায্যে সাধারণ শিক্ষাপ্রাপ্ত যে-কোনও মানুষ শিশুদের কার্যকর ও বৈজ্ঞানিক ভাবে মৌলিক শিক্ষা দিতে পারবেন। কাজটা আরও ব্যাপক আর পোক্ত হবে যদি স্বেছাসেবক সংগঠনগুলি এগিয়ে আসে, বা এক-একটা স্কুলের অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের জন্য সম্মিলিত ভাবে এমন কোনও ব্যবস্থা করেন, অবশ্যই শিক্ষকদের পরামর্শ নিয়ে বা তাঁদের সক্রিয় ভাবে যুক্ত করে।

বেশ কিছু জায়গায় স্থানীয় শিক্ষকরা নিজেরাই এগিয়ে এসেছেন। এমন উদ্যোগ যথেষ্ট ব্যাপক ও কার্যকর করা কিন্তু শিক্ষকদের একক বা প্রাথমিক দায়িত্ব হতে পারে না। সব শিক্ষক সমান তাগিদ বোধ করবেন না, কেউ কেউ এমনকি ব্যাপারটা আপদ বলে ভাববেন। কিন্তু সবচেয়ে আন্তরিক দায়িত্ববান শিক্ষকেরও স্কুলের চৌহদ্দির বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এমন কিছু সংগঠিত করার খানিক সমস্যা আছে, সীমাবদ্ধতা আছে, যেমন আছে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে কোনও স্কুলের। তাঁদের বাদ দিয়ে কাজটা করা যাবে না; কিন্তু মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে অভিভাবকদের, স্থানীয় সমাজের। তাঁরাই দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারেন, “আমরা চাই আমাদের বাচ্চারা এই ব্যবস্থায় লেখাপড়া শিখে বাঁচুক— স্কুল খোলা অবধি তো বটেই, সম্ভবত তার পরেও দু’বছরের ঘাটতি পোষাবার প্রয়োজনে। এই ব্যবস্থার নৈতিক দায়িত্ব আমাদের, কোভিডকালে স্বাস্থ্যের ঝুঁকিও আমরাই বিচার করে সন্তানদের রক্ষা করব।” অপ্রিয় হলেও বলতে হয়, আর এক বিপত্তি একমাত্র তাঁরাই ঠেকাতে পারেন: সোজা বাঁকা কোনও পথেই যেন এই ব্যবস্থা কোচিং বা টিউশনির পথ না খুলে দেয়।

এক দরদি শিক্ষা-সংগঠক সে দিন একটা দামি কথা বললেন। বললেন, শিক্ষার দুটো অবতার: একটা প্রাতিষ্ঠানিক, কার্যত সরকারি, অন্যটা সামাজিক। সরকারকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না; কিন্তু বিশেষ করে অতিমারির মতো অস্বাভাবিক অবস্থায় সমাজের ভূমিকা গুরুতর হয়ে ওঠে। এমন সময় স্থানীয় ভাবে, প্রায়ই দিনে-দিনে তাৎক্ষণিক বিচারে, পরিপার্শ্বের অবস্থা বুঝে সব মানুষে মিলে পথ কেটে এগোতে হয়। তাগিদ সেই মানুষগুলির: যেমন সমস্যা তেমনই তার উপযুক্ত বিশদ সমাধানও তাঁরাই সবচেয়ে ভাল বুঝবেন।

সরকারের সঙ্গে সংঘাতের প্রশ্নই ওঠে না। বরং মানতে হয়, যে ক’টি রাজ্য কোভিডকালে প্রাথমিক স্তরের শিশুদের সরাসরি শিক্ষাদানের কথা আদৌ ভাবছে, পশ্চিমবঙ্গ তাদের একটি। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তা স্বীকৃতও। এ ব্যাপারে পথিকৃৎ কর্নাটক সরকার, বহু দিন আগেই তাদের ‘বিদ্যাগম’ প্রকল্প দিয়ে। বিলম্বে হলেও পশ্চিমবঙ্গে ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ চালু হয়েছে কচিকাঁচাদের জন্য। আশা করা যায়, এই প্রকল্প রূপায়িত হবে সত্যিই পাড়ার স্তরে, বিশেষত অভিভাবকদের যুক্ত করে: না হলে নানা সমস্যা দেখা দিতে বাধ্য। আরও আশা করব, শিক্ষণ-সামগ্রী ও নির্দেশাবলির খোঁজে চাকার পুনরাবিষ্কারে কালক্ষেপ না করে উপরোক্ত তৈরি ওয়েবসাইটটির সদ্ব্যবহার হবে, অবশ্যই দরকার মতো বাড়িয়ে ও সংস্কার করে।

বাংলায় আমরা সৌভাগ্যবান, এমন একটা সম্পদ আমাদের হাতের মুঠোয়। কিছু কিছু সংগঠন ইতিমধ্যেই এটি দেখে উৎসাহিত, কেবল ব্যবহার নয়, সংযোজনের কথা ভাবছে। কিছু সচেতন ব্যক্তি উদ্বুদ্ধ হয়েছেন স্থানীয় ভাবে কিছু করতে। সংখ্যাটা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। বড়জোর পাঁচশো স্কুল ও সংগঠন এযাবৎ এই উদ্যোগে শামিল হয়েছে, উপকৃত হচ্ছে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার শিশু। রাজ্যে প্রাথমিক স্কুল আছে প্রায় ৮০,০০০; ছাত্রসংখ্যা আগেই বলেছি।

কোভিডের টিকার প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, এক জনও বঞ্চিত হলে আমরা সকলেই বিপন্ন। কথাটা জাতীয় জীবনের অধিকাংশ উপলভ্য ও পরিষেবার সম্বন্ধে খাটে, বিশেষত খাটে শিক্ষার মতো একটা সর্বজনীন মঙ্গলের ক্ষেত্রে। বিপুলসংখ্যক শিশু লেখাপড়া না শিখে বড় হলে অর্থনীতি তথা সামাজিক স্বাস্থ্য কতটা ব্যাহত হয়, তা আমরা দেখে অভ্যস্ত এবং অল্পবিস্তর নির্বিকার। অতিমারির ফলে ভবিষ্যতে সেই ঘাটতি নতুন মাত্রায় পৌঁছলে যে বিপর্যয় অনিবার্য, তাতে আমরা কেউ নির্বিকার থাকতে পারব না, শান্তিতে থাকতে পারবে না আমাদের কারও ছেলেমেয়ে।

যে যার মতো সকলের তাই আজই সচেতন ও সচেষ্ট না হয়ে গতি নেই। হাতের কাছে যেখানে যেটুকু যা সুযোগ যা রসদ আছে, তা-ই সমাদরে গ্রহণ করা যাক।

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

School Reopening Literacy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy