—প্রতীকী চিত্র।
এগিয়ে থাকা অর্থনীতির বিভিন্ন দেশ মুদ্রাস্ফীতি বিষয়ে তাদের লক্ষ্যমাত্রা ২ শতাংশেই আবদ্ধ রাখতে চায়। কিন্তু আমেরিকায় ‘কনজিউমার প্রাইস ইনফ্লেশন’ (নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বা পরিষেবা পাওয়ার বিনিময়ে ভোক্তারা যে মূল্য প্রদান করেন, তার সূচক) এই মুহূর্তে ৩.৭ শতাংশ। ইউরো ব্যবহারকারী দেশগুলিতে তা ৫.৬ শতাংশ, ব্রিটেনে ৬.৮ শতাংশ এবং জাপানে তা ২.৯ শতাংশ। জার্মানিতে একেই অর্থনীতির বৃদ্ধি শূন্য। তার উপরে এই সূচক সেখানে ৪.৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।
ভারতে মুদ্রাস্ফীতির হার এমনিতেই অন্যান্য এগিয়ে থাকা অর্থনীতির দেশগুলির তুলনায় যথেষ্ট বেশি— প্রায় ৫ শতাংশ। অবশ্য এ দেশের আর্থিক নীতি ৪ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে। সেই তুলনায় এই হার তেমন মারাত্মক নয়। আগামী ত্রৈমাসিকে এই পরিসংখ্যান তেমন প্রভাব ফেলবে বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কও মনে করছে না।
এই সব তথ্য হাতে রেখে বলা যায়, মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা তখনই নির্ধারণ করা হয়, যখন বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক (আদৌ সেটা সম্ভব কি না, জানা নেই) থাকে। সেই সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করার সময় চাহিদার ওঠানামা ছোট ছোট চক্রে আবর্তিত হওয়াই কাঙ্ক্ষিত। যাতে আর্থিক নীতি তার মোকাবিলা করতে পারে। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং কোভিড অতিমারির মতো অস্বাভাবিক সময়ে সর্বত্রই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি তাদের স্বাভাবিক নিয়ম-কানুন মুলতুবি রাখে এবং ‘ভিন্ন ভাবে’ সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে বলে জানায়। সাম্প্রতিক সময়ে তেমন কোনও বড় সঙ্কট নেই। কিন্তু এই মুহূর্তেও স্বাভাবিক নিয়ম-কানুন মোতাবেক বিষয়টির মোকাবিলা করা যাবে বলে মনে হয় না।
সাম্প্রতিক সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম হল ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত এবং নতুন করে ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা। এর ধাক্কায় খনিজ তেলের বাজারে এবং কিছু খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের দামের ক্ষেত্রে উথাল-পাথাল ঘটতে পারে। বিশ্ব যদি একযোগে পারস্পরিক ভাবে প্রতিযোগী ক্ষেত্রে ভেঙে যায়, তা হলে এমন সমস্যা অব্যাহত থেকে যাবে। জলবায়ুগত পরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রেই আবার মূল্যবৃদ্ধি ঘটায়। সুতরাং চাহিদায় ঘাটতি থাকলেও পণ্যমূল্য বাড়বেই। এমন পরিস্থিতিতে যদি আর্থিক নীতির কাছে উত্তর চাওয়া যায়, তা হলে নীরবতা ছাড়া কিছু মিলবে না। যাঁরা এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁরা ‘দীর্ঘমেয়াদের প্রেক্ষিতে মূল্যবৃদ্ধি (সুদের হারও)’-মার্কা জিগির তুলে ঘটনার আসল গুরুত্ব লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করবেন।
কিন্তু এতে যা ক্ষতি হবে, তাকে লুকোনো যাবে না। আমেরিকা এবং চিনের পরিস্থিতি ভাল হলেও বিশ্ব অর্থনীতির গতিতে মন্থরতা নজর এড়াচ্ছে না। ঋণ মহার্ঘ হয়ে পড়ায় ব্যাঙ্ক এবং সংস্থাগুলির হিসেব-নিকেশের খাতায় যে চাপ পড়ছে এবং তা থেকে সমস্যার পুর্বাভাস যে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা অনস্বীকার্য। পুঁজির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় তার সঙ্গে তাল রেখে অধিকতর মুনাফার আশায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রটিও আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। অতিরিক্ত মাত্রায় ঋণের বোঝা যে সব দেশের ঘাড়ে রয়েছে, তারা বর্ধিত হারে সুদ গুনতে গিয়ে অন্যদের থেকে বেশি বিপন্ন বোধ করছে। বিশ্ব জুড়ে পুঁজি নিরাপত্তা খুঁজতে থাকায় প্রান্তিক বাজারগুলিতেও ঘোলাজল তৈরি হচ্ছে। কারণ, তার পিছনে কাজ করছে আর্থিক পুঁজির উপর বিবর্ধিত সুদের হার। এর ফলে ভারতের বাজারও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিভিন্ন দেশে সরকারি ঋণপত্রের দাম রেকর্ড পরিমাণ স্পর্শ করেছে। যদি কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি তাদের আদেশনামা বলবৎ রাখে এবং ২ শতাংশ হারে মুদ্রাস্ফীতিকে লক্ষ্যমাত্রা হিসাবে স্থির রাখে, তা হলে ঋণপত্রের দাম আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ব্যাঙ্কগুলি একযোগে এই মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। কারণ, ইতিমধ্যেই বর্ধিত মূল্যের উপর আরও বেশি দাম চড়তে থাকলে গোটা অর্থনীতিতে তার চাপ অনুভূত হবে। মোদ্দা কথায়, তারা এ কথা মেনেই নিয়েছে যে, নির্দেশ বলবৎ রাখার জন্য যে পরিকাঠামো বা প্রয়োগকৌশল প্রয়োজন, তা তাদের হাতে নেই। সুতরাং তারা এক রকম অবান্তর কথাবার্তা বলে পাশ কাটাতে চাইছে।
আর্থিক নীতিও এই মুহূর্তে একটি বাঁকের মুখোমুখি। রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ (ইউএনসিটিএডি) তার বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংক্রান্ত বার্ষিক রিপোর্টে সম্প্রতি সমস্ত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ককে তাদের পূর্বকথিত ২ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা ত্যাগ করতে বলেছে এবং নীতি নির্ধারণের সময় ঋণ-সঙ্কট, অসাম্যের ক্রমবৃদ্ধি এবং অর্থনীতির গততে শ্লথতার মতো বিষয়গুলিকে মাথায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছে। যখন ৪ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তখন ভারতের জন্যও তারা একই নির্দেশ জারি করেছিল। যুক্তি হিসাবে দেখানো হয়েছিল, মুদ্রাস্ফীতির পিছনে বিভিন্ন কারণ ক্রিয়াশীল থাকে। অতিরিক্ত চাহিদা সেগুলির মধ্যে অন্যতম। সুতরাং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাতে তেমন কোনও নীতি নির্ধারণের অস্ত্র নেই, যার প্রয়োগে সে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে। কেউ কেউ এমন কথাও বলেছিলেন যে, এ ব্যাপারে চেষ্টা করাটাই ভুল হবে। কারণ, সামূহিক অর্থনীতির অন্যান্য লক্ষ্যও সমান গুরুত্বপুর্ণ। ইউএনসিটিএডি-ও একই কথা বলে।
তবে ভারতের অবস্থান অনেকের চাইতেই ভাল জায়গায় রয়েছে। ভারতের মাথায় ঋণের বোঝা বিপুল নয়। এ দেশের অর্থনীতির বৃদ্ধিও বেশ ভাল। এই পরিস্থিতিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তার সুদের হার বাড়াতেই পারে এবং ৪ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা স্থির রাখতেই পারে। আগামী তিনটি ত্রৈমাসিকের মধ্যে এই লক্ষ্য পূরণ হবে না বলে জানানোর পরেও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক খানিকটা আশান্বিতই রয়েছে বলা যায়। এই পরিস্থিতেও যেটুকু মন্দের ভাল, তা উঠে আসছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আদেশনামার নমনীয়তার কারণেই। সেখানে ৪ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার দু’দিকেই ২ শতাংশ করে পার্সেন্টেজ পয়েন্টে ছাড় রাখা হয়েছে। কিন্তু এই ছাড়ের বিষয়টিই প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অজুহাত হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এখন প্রশ্নটি নিজের দিকেই ঘুরে যায়, যদি এ কথা বলা যায় যে, ২০১৯ থেকে এখনও পর্যন্ত যখন তা পূরণই হয়নি, তখন এই লক্ষ্যমাত্রার প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? আর যদি কোথাও কখনও এই লক্ষ্যমাত্রা কাকতালীয় ভাবে পূরণও হয়ে যায়, তা হলে কী হবে? ভারত এবং অন্যত্র, কোথাওই কি মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা আদৌ কাজ করে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy