চিনকে ঠেকাতে কতটা তৈরী ভারতীয় নৌসেনা।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতীয় নৌসেনার খুব কর্মব্যস্ততার মধ্যে কাটছে। সদ্য ৭,৪০০ টন ওজনের ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধজাহাজ আইএনএস মর্মুগাও জলে ভেসেছে। তিন মাস আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতে প্রথম দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি যুদ্ধবিমানবাহী ৪৫,০০০ টন ওজনের জাহাজ ‘বিক্রান্ত’-কে আনুষ্ঠানিক ভাবে নৌসেনার হাতে তুলে দিলেন। নৌসেনা তার দ্বিতীয় নিউক্লিয়ার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ডুবোজাহাজ ‘আইএনএস অরিঘাত’-ও পেতে চলেছে। প্রাপ্তির দিনটি কেবল গোপন রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে ‘স্করপেন’ গোত্রের পঞ্চম ডুবোজাহাজ ‘আইএনএস বাগীর’ নৌসেনার হাতে এসেছে এবং আগামী বছরের গোড়ায় নতুন প্রযুক্তির কিছু ‘ফ্রিজেট’ গোত্রের যুদ্ধজাহাজ প্রাপ্তির কথাও জানা গিয়েছে।
আগে কখনও নৌসেনা এত কম সময়ের ব্যবধানে এতগুলি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধজাহাজ ও ডুবোজাহাজ হাতে পেয়েছে বলে জানা যায় না। গত বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালটিও নৌসেনার কাছে ছিল ঘটনাবহুল। ওই বছরে দু’টি স্করপেন গোত্রের ডুবোজাহাজ এবং একটি ডেস্ট্রয়ার নৌসেনার হাতে এসেছিল। এই সব ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, ভারতীয় নৌবাহিনীর সম্প্রসারণে নতুন গতির সঞ্চার ঘটছে। ঘটনা মোটেই মিথ্যে নয়। এর পাশাপাশি কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত থেকেও বিষয়টিকে বিচার করা প্রয়োজন। ২০২১ এবং ২০২২— এই দু’বছরের তুলনায় তার আগের দু’টি বছর অর্থাৎ ২০১৯ এবং ২০২০-তে কিন্তু নৌসেনার হাতে এসেছিল একটি মাত্র ডুবোজাহাজ এবং একটি ৩,৩০০ টন ওজনের ‘করভেট’ যুদ্ধজাহাজ। মনে রাখতে হবে, ২০১৮-য় কিন্তু নৌবহরে কোনও উল্লেখযোগ্য সংযোজন ঘটেনি। একটু পিছিয়ে গিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ২০১১ সাল থেকে বছরে গড়ে দু’টি করে বড় যুদ্ধজাহাজ সেনার হাতে আসাটাই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বিগত দশকের নিরিখে বিচার করলে এটি অবশ্যই উন্নতির একটি চিহ্ন। কিন্তু এ-ও মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটি যুদ্ধজাহাজ তৈরি করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। একেকটি ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিজেট বা করভেট বানাতে ৭ থেকে ৯ বছর লেগে গিয়েছে। চিন যা বানাতে এর অর্ধেক সময় নেয়। তার উপর আবার নৌসেনাকে হস্তান্তরের সময় জরুরি বহু আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়নি। যার মধ্যে ‘রাইট লং রেঞ্জ’, বিমান-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, ভারী টর্পেডো, অ্যান্টি-সাবমেরিন হেলিকপ্টার এবং ‘কেরিয়ার-বোর্ন’ বিমানের মতো বিষয় ছিল। সোভিয়েত রাশিয়া থেকে প্রাপ্ত ‘আইএনএস বিক্রমাদিত্য’-র মতো বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, যা ২০১৩ সালে নৌবাহিনীর হাতে আসে, তাকে বার বার সারাইয়ের জন্য ড্রাই ডকে পাঠাতে হয়। সম্প্রতি তার এক দীর্ঘমেয়াদি সারাইপর্ব চলছে। একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে, গত দু’বছরে ভারতের কোনও বিমানবাহী জাহাজে একটিও বিমান নামেনি।
তা সত্ত্বেও এ কথা কেউ বলতেই পারেন যে, ভারত অবিচল ভাবে তার নৌশক্তি বাড়িয়ে চলেছে। ৬,৬০০ টন ওজনের ফ্রিজেট যুদ্ধজাহাজগুলিতে ‘মডিউলার কনস্ট্রাকশন’ পদ্ধতি ব্যবহৃত হবে। অর্থাৎ জাহাজগুলি যেখানে থাকবে, সেখানেই তাদের যন্ত্রাংশ নিয়ে গিয়ে তাদের বানানো হবে। এতে জাহাজ নির্মাণের সময়কাল দু’বছর কমে আসবে। যেখানে মাজগাঁও ডক জাহাজ নির্মাণ সংস্থা ডেস্ট্রয়ার আর ফ্রিজেট গোত্রের যুদ্ধজাহাজের প্রধানতম নির্মাতা হয়ে রয়েছে, সেখানে গার্ডেনরিচ শিপবিল্ডার্স, কোচিন শিপ ইয়ার্ড এবং গোয়া শিপ ইয়ার্ড এখন আরও বড় এবং আরও জটিল জাহাজ নির্মাণে কিন্তু সমর্থ। বিশাখাপত্তনমের পরমাণু শক্তি-চালিত ডুবোজাহাজ নির্মাণের ক্ষেত্রটির কথাও এখানে মাথায় রাখতে হবে। এই তালিকায় যুক্ত করতে হবে চেন্নাইয়ের কাছে ‘লারসেন অ্যান্ড টুর্বো’-র তৈরি জাহাজের নকশা নির্মাণ সংস্থার নামটিও।
অবশ্য এই সব সংস্থার সঙ্গে চিনের জাহাজনির্মাণ শিল্পের গতির তুলনা টানা বৃথা। গত গ্রীষ্মকালেই চিন তার তৃতীয় বিমানবাহী রণতরীটিকে জলে নামিয়েছে, যা আয়তনে ভারতের দু’টি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের সম্মিলিত ক্ষেত্রফলের চেয়েও বেশ খানিকটা বড়। তার উপর এই জাহাজে এমন উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যার সাহায্যে অতি কম সময়ের ব্যবধানে আরও বেশি জ্বালানি ও আরও ভারী অস্ত্র-সহ যুদ্ধবিমান ওড়ানো সম্ভব। ইতিমধ্যেই মারাত্মক গতিসম্পন্ন ডেস্ট্রয়ার বানাতে সমর্থ হয়ে চিন ‘কিলার ড্রোন’ ও মানবচালিত যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, এমন মানবচালকহীন জাহাজ বানিয়ে নৌযুদ্ধের পরিকল্পনা করছে। বেজিং এই সংক্রান্ত নানা রকমের নির্মাণকাজ শুরু করেছে, যার মধ্যে ‘ইন্ডিয়ান ওশান রিম’-এর সদস্য ২০টি রাষ্ট্রকে ঘিরে একটি নৌঘাঁটি তৈরির প্রকল্পও রয়েছে। ফলে নিজের জলরাশিতেই ভারতীয় নৌসেনা অচিরে বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে পড়তে পারে।
তা সত্ত্বেও এ দেশে সীমিত প্রতিরক্ষা বাজেটের মধ্যে যে যথেষ্ট মাত্রায় নৌবহর নির্মাণের কাজ চলছে, এমন বলা যায় না। যদিও অগভীর জলে ডুবোজাহাজ ধ্বংস করতে সমর্থ ছোট জলযান তৈরির প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ভারতের ডুবোজাহাজ বহরের আয়তন মোটেই বিরাট নয়। তার উপর বেশির ভাগ জলযানই পুরনো। আশির দশকে নির্মিত। কিন্তু মাজগাঁওয়ের ডুবোজাহাজ কারখানা তার ষষ্ঠ ও শেষ স্করপেন ডুবোজাহাজটি বানিয়ে বাতিলের খাতায় নাম লেখাতে চলেছে। পরবর্তী ছ’টি ডুবোজাহাজের বরাত ফেলে রাখা হয়েছে। বার বার পিছিয়েও দেওয়া হচ্ছে। সম্ভাব্য নির্মাতা সংস্থাগুলি এ ব্যাপারে উদাসীন। কারণ, এই বরাতের শর্তগুলি তাদের কাছে লাভজনক তথা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি।
ইতিমধ্যে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি সকলকে চমকে দিয়ে জানালেন, ভারত তার নৌবহরের তৃতীয় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজটি বানাতে শুরু করে দিয়েছে। এর আগে বা পরে এমন নির্দেশ বা এ সংক্রান্ত বরাতের কথা ঘুণাক্ষরেও জানা যায়নি। মালয়েশিয়া, ব্রাজিল এবং ফিলিপিন্স থেকে আমদানির বরাতের নিলামে দর হাঁকাহাঁকিতে ভারত দাঁড়াতেও পারেনি।
এই মুহূর্তে নৌসেনার সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলি রয়েছে, তা আসলে বহুমাত্রিক। পর্যাপ্ত নয় এমন বাজেট, বরাত দানে গড়িমসি, শ্লথ নির্মাণকাজ, দুর্বল ডেলিভারি বন্দোবস্ত এবং সবার উপরে চিনের চ্যালেঞ্জ— সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ জটিল। নৌবাহিনীর হাতে যত বড় যুদ্ধজাহাজ, ডুবোজাহাজ যত দ্রুতই তুলে দেওয়া হোক না কেন, বিষয়গুলি যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়, তা বুঝতে কষ্ট হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy