২০০৮-এর আর্থিক সঙ্কটের ঠিক আগে এই সব প্রাক্শর্ত থাকা সত্ত্বেও ভারত তার সব থেকে বেশি বৃদ্ধির কাল দেখেছিল।
ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিভিন্ন পূর্বাভাস একটি আশাব্যঞ্জক স্তরে গিয়ে একত্রিত হচ্ছে। মন্দা কাটিয়ে তেজি অবস্থায় উপনীত হওয়ার বিষয়টি নাকি ৮.৩ শতাংশ (বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসেবে) এবং ১০.৫ শতাংশের (সরকারি হিসেবে) মধ্যে থাকবে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের (আইএমএফ) হিসেব মোতাবেক তা ১০.৫ শতাংশের আশেপাশে থাকবে বলে জানা গিয়েছে। বেশ কিছু বিনিয়োগ-ব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদের পূর্বাভাসও এর মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে। অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের বছরের এই পরিসংখ্যানকে যদি মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি)-র পাশে ফেলে তুলনা করে দেখা গেলে বাৎসরিক বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে মোটামুটি হিসেবে মাত্র ১ শতাংশ। অতিমারির কারণে গত দু’বছরের জিডিপি-র হার ছিল ৭.৩ শতাংশ। গত দু’বছরের বিশ্বের জিডিপি-র সঙ্গে বা জায়মান বাজার অর্থনীতির সঙ্গে এই তুলনা সামান্য নেতিবাচক বলে মনে হতে পারে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক জানাচ্ছে, এই বছরটি গত ৮০ বছরের বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাসে পুনরুজ্জীবনের সেরা বছর হতে চলেছে। সেদিক থেকে দেখলে ভারত গত ৪০ বছরে এর থেকে কিছুটা উজ্জ্বল ছবি দেখাতে সমর্থ হয়েছিল।
এই প্রেক্ষিতেই প্রশ্ন, আর্থিক পুনরুজ্জীবনের পরে কী? দেশের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পূর্বাভাস দিয়েছেন, ২০২২- ’২৩ অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৬.৫ থেকে ৭ শতাংশ এবং তার পরে ৮ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসেব কিন্তু অন্য কথা বলছে। তা হল— বৃদ্ধির হার ৭.৫ শতাংশ থেকে ৬.৫ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করবে। আইএমএফ-এর হিসেব আরও কিছুটা আশাব্যঞ্জক। তাদের হিসেব মাফিক আগামী বছর বৃদ্ধির হার অন্তত পক্ষে ৮.৫ শতাংশ হবে। এই সব পরিসংখ্যানগুলি যথেষ্ট মাত্রায় পুনর্বিবেচনা করলেও বোঝা যায়, চলতি হিসেবের সঙ্গে তাল রেখেই গৃহীত। বিশেষত, আইএমএফ এ ব্যাপারে সব থেকে বেশি আশাবাদী। তারা আগামী বছরের বৃদ্ধির হিসেবকে ৮.৫-এ রেখেছে। এই বছরে ভারতের ক্ষেত্রে তাদের পূর্বাভাস এপ্রিল মাসে ছিল ১২.৫ শতাংশ। যা জুলাই নাগাদ কমে ৯.৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকতে পারে। এ কথাও মনে রাখা দরকার, অতিমারির আগের তিন বছরে সরকারি হিসেবে বৃদ্ধির হার ছিল গড়ে মাত্র ৫.৮ শতাংশ ।
সুতরাং, অতীতের খতিয়ান নেতিবাচক হলে এই আশাবাদের পিছনের ব্যাখ্যাটি ঠিক কী? মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টার আগামী বছর বৃদ্ধির হার বেড়ে ৮ শতাংশ হওয়ার পূর্বাভাসের পিছনে সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কার পরিকল্পনা তথা পদক্ষেপের কিছু ইতিবাচক ফল লাভের অনুমান কাজ করেছে। তিনি তেমন পদক্ষেপ বা পরিকল্পনার একটি তালিকাও দিয়েছেন। বৃদ্ধির এই পূর্বাভাসের পিছনে ক্রিয়াশীল আরও একটি বিষয় হল বিশ্ব অর্থনীতির গতিছন্দের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। আইএমএফ-এর পুর্বাভাস অনুযায়ী ২০২২ সালে বিশ্ব অর্থনীতির বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৪.৯ শতাংশ। চলতি বছরে যা ৬ শতাংশ। এ সমস্ত কিছুই বর্তমান প্রবণতার চাইতে বেশ উঁচুতে। বিশ্ব পণ্যসংক্রান্ত বাণিজ্য দুই অঙ্কের বৃদ্ধি দেখতে পারে এবং ভারতের রফতানি বাণিজ্যে এক বিরাট তেজি ভাব আসতে পারে । ২০০৮-এর আর্থিক সঙ্কটের ঠিক আগে এই সব প্রাক্শর্ত থাকা সত্ত্বেও ভারত তার সব থেকে বেশি বৃদ্ধির কাল দেখেছিল।
ইতিবাচক দিক থেকে দেখলে সংগঠিত ক্ষেত্রে উৎপাদনজনিত লাভ অসংগঠিত ক্ষেত্রকে সরিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। যদি অতিমারি দূর হয়। তেমন ক্ষেত্রে কর্পোরেট লভ্যাংশের পাশাপাশি কর ও রাজস্ব থেকেও আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা যথেষ্ট। অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডের ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়াও লাভের দিকেই ইঙ্গিত করছে বলা যায়।
তবে এ সব সত্ত্বেও যে কথাটি বাকি থাকে, তা হল এই যে, এই সব ‘আশা’ পূরণ করতে উদ্যোগী হতে হবে। প্রথমেই মনে রাখা প্রয়োজন, সরকারের তরফে ‘আগামীতে ঘটতে চলেছে’ গোছের ভবিষ্যদ্বাণী করার কিছু পূর্ব-উদাহরণ রয়েছে (এর মধ্যে দুই অঙ্কের বৃদ্ধির বিষয়টিও আছে)। দ্বিতীয়ত, সংস্কার পদক্ষেপের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া ঘটেছে। মনে রাখা দরকার, এখনও পর্যন্ত দেউলিয়া সংক্রান্ত আইন, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ, বিদ্যুৎ সংক্রান্ত ক্ষেত্রের সংস্কার (‘উদয়’), পরিবহণ (বিশেষত রেলপথ) পরিকাঠামোয় বিপুল বিনিয়োগের বিনিময়ে অতি অল্প লাভ ইত্যাদি এই প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ‘তখন’ আর ‘এখন’-এর মধ্যে দ্রুত বৃদ্ধির বিষয়টিরও তুল্যমূল্য বিচার করা প্রয়োজন। ২০০৮-এর আগের বছরগুলিতে বিনিয়োগে যে উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল, পরবর্তীতে জিডিপি-র বিনিয়োগ ক্ষেত্রে বিপুল ধস নামে (প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ)। উৎপাদনের আরেকটি অনিবার্য উপাদান (শ্রম) বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিয়োগ অনুপাতের দ্রুত পতনের কারণে।
এই সব পরিসংখ্যানকে পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে ঠিক যে ভাবে কর্পোরেট ঋণস্তরকে সঠিক মাত্রায় আনা হয়েছে সে ভাবেই। কিন্তু সংগঠিত ক্ষেত্রের লাভমুখী পুনরুজ্জীবন ততক্ষণ যথেষ্ট নয়, যতক্ষণ না ক্ষুদ্র ও মাঝারি ক্ষেত্রগুলি পায়ের তলায় জমি পাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, কোনও রকম আইনি রক্ষাকবচ না থাকায় জোম্যাটো এবং উবরের মতো মধ্যস্থতাকারী ব্যবসা তাদের পরিষেবা প্রদানকারীদের যথেচ্ছ ভাবে শোষণ করবে এবং লাভের খেলায় হার-জিতের সমীকরণের উপরেই জোর দেবে। এ ধরনের প্রবণতা ভোক্তা জগতের পুনরুদ্ধার ঘটাবে না। নতুন বিনিয়োগ ছাড়া এ ক্ষেত্রে কোনও উপায়ই সামনে খোলা নেই। এক যদি না সরকার তার ঋণের মাত্রার কথা মাথায় রেখে এই দায়িত্ব নেয়। মাঝারি রকমের বৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে একটা ধাপ টপকে যদি ভাবা যায়, তা হলে বেসরকারি ও সরকারি বিনিয়োগ, দেশজ চাহিদা এবং রফতানি ইত্যাদি অর্থনীতির সবক’টি অভিমুখকেই উন্মুক্ত রাখতে হবে। সরকার তার নিজের বিনিয়োগের উপরেই বৃদ্ধি সংক্রান্ত বাজি রেখেছে, এমতাবস্থায় রফতানির ছবিটিও উজ্জ্বল। চারটি অভিমুখের মধ্যে এই দু’টিই হল সর্বপ্রধান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy