Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Gramophone

বুকের মধ্যে বাজে যে গান

১৮৮৭ সালে এমিল বার্লিনার গ্রামোফোন আবিষ্কার করেন। বাংলাকে গ্রামোফোন জগতের সঙ্গে পরিচিত করান অবশ্য এক আমেরিকান মিউজ়িশিয়ান, এফ ডব্লিউ গেসবার্গ।

ঈশিতা ভাদুড়ী
শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৩ ০৬:১৭
Share: Save:

শামসুর রাহমানের কবিতা পড়ার আগে কানে শুনেছি, কাজী সব্যসাচীর কণ্ঠে— ‘স্বাধীনতা তুমি/ রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।/ স্বাধীনতা তুমি/ কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো/ মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা...’ বাবা রেকর্ড কিনতেন প্রচুর। সেই রেকর্ডে যখন কাজী সব্যসাচী, শম্ভু মিত্র, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বা উৎপল দত্তের কণ্ঠে বাংলার কবিদের কবিতা আবৃত্তি হত, তখনই হয়তো মনের মধ্যে কোথাও কবিতার বীজ বোনা হয়ে গিয়েছিল।

আমরা রেকর্ড প্লেয়ার বললেও অনেকেই সে সময় তাকে গ্রামোফোন বলতেন। আসলে তা ছিল আধুনিক রেকর্ড প্লেয়ারের পূর্বরূপ। ১৮৮৭ সালে এমিল বার্লিনার গ্রামোফোন আবিষ্কার করেন। বাংলাকে গ্রামোফোন জগতের সঙ্গে পরিচিত করান অবশ্য এক আমেরিকান মিউজ়িশিয়ান, এফ ডব্লিউ গেসবার্গ। তিনি ছিলেন গ্রামোফোন কোম্পানির প্রথম রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার। ১৯০০-১৯০৭ সময়কালে তিনি বহু বার কলকাতা ও ভারতের অন্যান্য রাজ্যে আসেন। ১৯০২ সালে প্রথম ভারতীয় শিল্পী হিসাবে গওহর জানের রেকর্ড তৈরি করেন, সাত ও দশ ইঞ্চি ব্যাসের একটি রেকর্ডে তাঁর গানগুলি রাখা হয়। এই রেকর্ডই তাঁকে অল্প দিনের মধ্যে খ্যাতি এনে দেয়, কাগজে ছবি ছাপা হয়। এ ভাবেই ভারতে দ্রুত গ্রামোফোন রেকর্ডের বিস্তার হয়। গ্রামোফোন রেকর্ড তৈরির ক্ষেত্রে প্রথম ভারতীয় উদ্যোক্তা হেমেন্দ্রমোহন বসু ১৯০০ সালে টমাস আলভা এডিসন-এর তৈরি একটি ফোনোগ্রাফ রেকর্ডিং মেশিন সংগ্রহ করেন। ফরাসি সংস্থা ‘প্যাথে’-র সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। হেমেন্দ্রমোহন ‘হিজ় মাস্টার’স ভয়েস’ থেকে যন্ত্রপাতি ভাড়া করে স্থানীয় প্রখ্যাতদের কণ্ঠস্বর রেকর্ড করতেন। পরে তিনি নিজেই কলকাতায় একটি রেকর্ডিং সংস্থা চালু করেন। গ্রামোফোন তৈরি ও বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন হারমোনিয়াম নির্মাতা এম এল শ’ তথা মানিকলাল সাহা। তিনি ছিলেন লন্ডনের নিকল রেকর্ডস ও নিকলফোনের প্রথম ও প্রধান এজেন্ট। পরে তিনি বিখ্যাত ইন্ডিয়ান রেকর্ড ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে গ্রামোফোন ও রেকর্ড বাঙালি পরিবারের একটি মর্যাদার বিষয়ে পরিণত হয়।

‘হিজ় মাস্টার’স ভয়েস’-এর রেকর্ড শুধু বাবা নয়, আমিও কিনেছি অনেক। এডিসনের পোষা প্রিয় কুকুরকে গ্রামোফোনের চোঙের সামনে বসিয়ে মোনোগ্রাম করে নাম হয় ‘হিজ় মাস্টার’স ভয়েস’, সংক্ষেপে এইচএমভি। ১৮৯৮-এ জার্মানিতে গড়ে ওঠে বিশ্বের প্রথম গ্রামোফোন কোম্পানি। বিশ শতকের প্রথম দশকে কলকাতায় বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গ্রামোফোন কোম্পানি ছিল হিজ় মাস্টার’স ভয়েস, কলাম্বিয়া, প্যাথে। তবে এইচএমভি-রই রমরমা ছিল।

কোথায় হারিয়ে গেল তারা! “তুমি কি কেবল-ই স্মৃতি, শুধু এক উপলক্ষ্য, কবি?/ হরেক উৎসবে হৈ হৈ / মঞ্চে মঞ্চে কেবল-ই কি ছবি?” শম্ভু মিত্রের কণ্ঠে বিষ্ণু দে-র ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ?’ শুনেই তো চিনলাম কবি ও আবৃত্তিকার দু’জনকেই। কাজী সব্যসাচীর ভরাট গলায় ‘এখনও নজরুল’ কবিতায় “তোমার বুকের মধ্যে নাকি হাত রাখেন ঈশ্বর/ মুখের ওপর উপচে পড়ে আলোর তরঙ্গ,” শুনে কৈশোরেই জানলাম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। সাত ইঞ্চি ব্যাসার্ধের ছোট্ট রেকর্ডগুলো শুনে কত অনুভব জাগত হৃদয়ে! উৎপল দত্ত যখন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে পড়েন নাজ়িম হিকমতের ‘জেলখানার চিঠি’: “তোমার শেষ চিঠিতে/ তুমি লিখেছো/ মাথা আমার ব্যথায় টনটন করছে/ দিশেহারা আমার হৃদয়...” বেদনা আর মায়া জড়ানো সেই স্বরের আবেদন ছুঁয়ে যেত কিশোরী হৃদয়। ফিরোজ়া বেগমের কণ্ঠে ‘আমার সকল চাওয়া বিফল হল’, দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় ‘সে যে বাহির হল আমি জানি’, রেকর্ডে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মান্না দে, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, বেগম আখতার শুনে কেটেছে আমাদের শৈশব, কৈশোর, যৌবনও। এল পি রেকর্ডে সুচিত্রা মিত্রের ‘কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি’, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ও যে মানে না মানা’ যে মায়ার আবেশ ছড়াত, তার রেশ কাটেনি আজও। ‘আকাশের অস্তরাগে আমারই স্বপ্ন জাগে’ যখন বাজত, সে গান তখন আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের থাকত না, শ্রোতারই হয়ে যেত একান্ত ভাবে। শাপমোচন, চিত্রাঙ্গদা বা চিরকুমার সভা-র চরিত্ররা যখন এল পি রেকর্ডে গান গেয়ে, কথা বলে উঠত, তখন রক্তে জেগে উঠত শিরশিরানি। কবে যে তা হারিয়ে গেল জীবন থেকে!

এর পর ক্যাসেট এল। মাঝে মাঝে তার টেপ ছিঁড়ে যাওয়া, সে আর এক যন্ত্রণা। ক্যাসেট বিলুপ্ত হওয়ার আগেই এসে গেল সিডি, তার পর ডিভিডি, এমপিথ্রি প্লেয়ার। এখন এগুলোও ইতিহাস। ল্যাপটপেও তো আজকাল আর ডিভিডি ড্রাইভ থাকে না, পেন ড্রাইভের যুগ। এখন অ্যাপ-ভিত্তিক গান শোনার চল; স্পটিফাই, ইউটিউব কত কী হয়েছে। আমাদের বেড়ে ওঠা থেকে প্রৌঢ় হওয়ার এই সময়ে কত কিছুর বদল হল। কিন্তু প্রাণের মধ্যে রেকর্ডে এখনও বাজে যে গান, সে যাবে কোথায়!

অন্য বিষয়গুলি:

Gramophone
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy