আলোকোজ্জ্বল: প্রধানমন্ত্রী এসে পৌঁছনোর আগে কাশী বিশ্বনাথ ধাম, ১২ ডিসেম্বর। পিটিআই।
কুষ্মাণ্ড ঋষির ছেলে মণ্ডপাখ্য কুসঙ্গে পড়ে সম্পূর্ণ গেঁজে গিয়েছে। ফলে তার অর্থের দরকার। বাবার কাছে চেয়ে লাভ নেই। বন্ধুদের সঙ্গে সে পরামর্শ করল, রাজকোষে চুরি করতে হবে।
মণ্ডপাখ্য কিন্তু বন্ধুদের চুরির ভাগ দিল না, সব অর্থ নিয়ে সেই রাতেই এক নারীর কাছে গেল। খাটের নীচে তাম্রপাত্রে চমৎকার তরল, মণ্ডপাখ্য এক নিশ্বাসে পান করল। তার পর সেই নারীকে জিজ্ঞাসা করল, কী এই শ্রান্তিবিনাশিনী পানীয়! কাশীখণ্ডের ভাষায়, “বেশ্যা কহে মাধ্বী আছে তোমার কারণ। পান করি রতিশ্রান্তি কর নিবারণ।।” মুনিপুত্র তা হলে অজ্ঞাতসারেই গণিকাগৃহে?
নিজের ভাগ্যকে ধিক্কার দিল মণ্ডপাখ্য। ভোর হতেই বাকি দুই ইয়ার এসে হাজির। তারা নিজেদের ভাগ চায়, নয়তো গণিকাসঙ্গে ঋষিপুত্রের রাত্রিযাপনের কাহিনি রাষ্ট্র করে দেবে। মণ্ডপ কী আর করে! মেয়েটিকে বলল, যে অর্থ দিয়েছি, তার এক ভাগ রাখো। বাকি তিন ভাগ এখনই ফেরত দাও, খুব প্যাঁচে পড়েছি। মেয়েটি কিছুই ফেরত দিল না, উল্টে বলল, কামশাস্ত্রে তুমি মূর্খতম। “লক্ষ স্বর্ণসম এক চুম্ব মম। কিছু ধন দিয়া তোর এত পরাক্রম। ওরে দ্বিজ, ত্যাগ কর আমার সদন।” চুরির ভাগ না পেয়ে রাস্তায় মণ্ডপকে ফেলে পেটাল দুই ইয়ার। মণ্ডপ সংজ্ঞা হারাল। খবর পেয়ে সে দিনই সর্বসমক্ষে পুত্রকে ত্যাজ্য করলেন ঋষি।
শিব এ বার পার্বতীকে বললেন, “গল্প এটুকুতেই শেষ নয়। দ্বিতীয় ভাগটা বলি, শোনো।” কাশীধামে যে সব পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়, তা নিয়ে স্বামীর কাছে শুনতে চেয়েছিলেন স্ত্রী।
চুরি, লাম্পট্য ও বিশ্বাসঘাতকতার এই গল্পের পরবর্তী অংশে মণ্ডপ জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখল, তার সামনে রাস্তা দিয়ে কিছু লোক চলেছে। মণ্ডপ জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কোথায় যাচ্ছ? উত্তর এল, “পঞ্চকোশী পরিক্রমায়।” পাঁচ ক্রোশ জুড়ে বিশ্বনাথধামের পরিক্রমা, “কর্দ্দমেশে যাত্রিগণ সে দিন রহিল।” কর্দ্দমেশ মানে এখনকার কাঁধোয়া গ্রামের কাছে মন্দির। সেখানে স্নান ও শিবলিঙ্গের পুজো করলে সব পাপ থেকে মুক্তি। সেখান থেকে ভীমচণ্ডী। ভবিষ্য-ব্রহ্মখণ্ডের বয়ান, এখানে ঘোররূপা ভীমচণ্ডী দেবীর অবস্থান। করোনাকালের আগেও বিশ্বনাথ মন্দিরের কাছেই ব্যস্ত কচৌরি গলিতে ভাঙা ইটের পাঁজা, জেসিবি মেশিনের মাঝে দেখেছি ভীমশঙ্কর লিঙ্গ। এখন কী অবস্থা জানি না!
মণ্ডপাখ্যের গল্পে ফিরে আসি। ভীমচণ্ডী দর্শনের পর দিন বরুণা নদীতে স্নান। কবির ভাষায়, “গঙ্গাতীরে স্থিত সর্ব্বদেবতা পূজিল। বিশ্বেশ্বর দরশন অর্চ্চন করিল।” অর্থাৎ গঙ্গাবক্ষে স্নান সেরে মণিকর্ণিকার সদ্যনির্মিত করিডর দিয়ে শর্টকাট রাস্তায় বিশ্বনাথ মন্দিরে গেলেই চলবে না। ঠিকঠাক পুণ্যার্জনে তার আগে আরও অনেক কাশীবাসী দেবমূর্তি দর্শন করতে হবে। পার্বতীকে নিয়মটাও বলে দিয়েছেন শিব, “ঢুণ্ঢিরাজ পূজি, হবিষ্যাণ্ণভোজী হবে পূর্বদিনে।” ঢুণ্ঢিরাজ মানে গণেশ। তাঁর অধিষ্ঠান ছিল জ্ঞানবাপীর কাছে। শুধু গণপতি নন, শিবের নির্দেশ, “শ্রী লক্ষ্মীমাধব, নৃসিংহকেশব দ্বাদশ আদিত্য। কৃষ্ণরামত্রয় বিষ্ণু-শিবময় বহুরূপে নিত্য।।” সোমনাথ বা উজ্জয়িনীর থেকে কাশীর শিব গণতান্ত্রিক। বিষ্ণু থেকে সূর্য বা আদিত্য সকলেই তাঁর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
গণতান্ত্রিক এই গল্পের প্রথমাংশ পরিষ্কার। কাশীধামে শুধু মন্দির নয়, নগরসভ্যতায় যা যা থাকে— চোর-ছেঁচড়, গণিকা— সবই ছিল। নদীর ধারে, প্রশস্ত রাজবর্ত্মের বাণিজ্যকেন্দ্রে যা যা হয়ে থাকে! কপিলাবস্তুর শাক্য রাজপুত্র এই বাণিজ্যকেন্দ্রে থাকবেন না বলেই উত্তরে, রাজঘাটের দিক থেকে নদী পেরিয়ে মৃগদাব অরণ্য বা সারনাথে চলে যান। জাতকের অনেক গল্পে তাই বারাণসীর রাজা ব্রহ্মদত্ত ও সেখানকার বণিকরা ঘুরেফিরে আসেন। ইতিহাসে কাশী ষোড়শ মহাজনপদের অন্যতম। পরে ১০৯৩ খ্রিস্টাব্দে কনৌজের গহঢ়বাল রাজা গোবিন্দচন্দ্র কাশীকে তাঁর দ্বিতীয় রাজধানী করেন। গহঢ়বালরা হিন্দু অবশ্যই, কিন্তু এর সঙ্গে আজকের হিন্দুত্বের কোনও সম্পর্ক নেই।
এই গোবিন্দচন্দ্রের মন্ত্রী লক্ষ্মীধর ক্রিয়াকল্পতরু নামে একটি পুঁথি রচনা করেন। পরবর্তী কালে এই পুঁথি নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। বিশ্বনাথ নন, এই সময়ে প্রধান লিঙ্গ মধ্যমেশ্বর। সেটিকে কেন্দ্র করেই স্কন্দপুরাণ জানাচ্ছে যে, কাশীর আয়তন এক ক্রোশ। মৎস্যপুরাণ বলছে, দুই ক্রোশ। লিঙ্গপুরাণের মতে, পাঁচ ক্রোশ। পুরাণের অঙ্ক কোনও দিন মেলে না।
একটা হিসাব মেলে। মধ্যমেশ্বর। এখন তিনি কাশী স্টেশনের কাছে ফুটপাতের নামগোত্রহীন এক ছোট্ট মন্দিরে অধিষ্ঠান করেন। কাশীর পবিত্র মানচিত্র কখনও এক রকম থাকেনি। বারংবার সরে সরে গিয়েছে। লক্ষ্মীধর তাই পবিত্র কাশীর কথা বললেও পঞ্চকোশীর উল্লেখ করেননি। মণিকর্ণিকা, বিশ্বনাথ-সহ পাঁচ ক্রোশের পরিক্রমা জনপ্রিয় হয়েছে আরও পরে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি মণিকর্ণিকা, দশাশ্বমেধ থেকে বিশ্বনাথ মন্দির, জ্ঞানবাপী অবধি যেখানে নতুন করিডর উদ্বোধন করেছেন, শাস্ত্রমতে তার নাম অন্তর্গৃহ। পঞ্চকোশীর বাকি মন্দির ও রাস্তা বর্হিগৃহ। পুরনো মানচিত্রে পঞ্চকোশীর সব মন্দির মেলে না— কোথাও মন্দিরসংখ্যা ২৪, কোথাও বা ৪৪। কিন্তু অন্তর্গৃহ মোটামুটি এক। জয়পুরের সোয়াই মানসিংহ মিউজ়িয়ামে ১৭০০ সালের এক জরিপ মানচিত্র রাখা আছে। সেখানে মণিকর্ণিকা থেকে বিশ্বনাথ মন্দির, সব কিছু আছে।
আকবরের আমলে রাজা টোডরমল প্রথম এই জরিপ করান। প্রধানমন্ত্রী নতুন বিশ্বনাথ করিডর উদ্বোধনের দিন যতই ঔরঙ্গজেব বনাম শিবাজির কথা বলুন না কেন, আসলে তিনি আকবরের জরিপ-মানচিত্রই অনুসরণ করেছেন।
অন্তর্গৃহ নয়, কাশীতে নগরসংস্কার মানে উদ্যান, মন্দির, ধর্মশালা-সহ পঞ্চকোশী রাস্তার সংস্কার। ইনদওরের রানি অহল্যাবাইয়ের ঢের আগে নাটোরের রানি ভবানী প্রথম এই রাস্তার সংস্কার করেন। কপিলধারা, কর্দমেশ্বরের পুরনো মন্দিরগুলিও তাঁর হাতে পুনর্নির্মিত হয়। কাশীর দুর্গামন্দিরও তাঁর তৈরি। অতঃপর ওয়ারেন হেস্টিংস, জেমস প্রিন্সেপ থেকে ভূকৈলাসের রাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল অনেকে এই রাস্তা সংস্কার করান। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় সে দিন ইনদওরের অহল্যাবাইয়ের নাম থাকলেও নাটোরের রানির জন্য একটি শব্দও ছিল না।
নগরসংস্কার কি শুধু নতুন মন্দির আর তীর্থপথেই সীমাবদ্ধ? ১৭৮৭ সালে হেস্টিংসের উত্তরসূরি হিসাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বারাণসীর শাসক হিসাবে নিয়োগ করল জোনাথন ডানকানকে। দেখা গেল, শহরের জলাশয়গুলিতে লোকে ইচ্ছামতো মলমূত্র ত্যাগ করে। ১৭৯০ সালে কাশীতে এল পাবলিক টয়লেট। লোকজন ব্যাপারটা পছন্দ করল না, হরতাল ডাকা হল।
১৮৩০ সালে কলকাতা থেকে এলেন জেমস প্রিন্সেপ। ঘাট, মন্দির ইত্যাদির ছবি আঁকলেন। তাঁর চেষ্টাতেই ওই অঞ্চলের প্রথম জনশুমারি। এর পর কলকাতার হিন্দু কলেজে মাইকেল মধুসূদন দত্তের সহপাঠী ভোলানাথ চন্দ্র কাশী, প্রয়াগ ঘুরে ১৮৬৯ সালে ট্রাভেলস অব আ হিন্দু নামে একটি বই প্রকাশ করেন। কাশীতে অজস্র হিন্দু মন্দির ও দেবস্থান দেখে তিনি মুগ্ধ। আফসোস, শহরটায় ভাল আর্ট গ্যালারি, পাবলিক লাইব্রেরি নেই। “দেয়ার ইজ় নো হিন্দু ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে।”
নাগরিক উন্নয়ন এবং প্রাচীন ঐতিহ্য কী ভাবে মিশে থাকে, বিশ্বে হয়তো তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শনই কাশী। উচ্চতর আধুনিক পঠনপাঠনের জন্য বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি তৈরি হল যখন, তার একেবারে কেন্দ্রে তৈরি হল বিশ্বনাথের মূর্তি— কাশীতে বিশ্বনাথের সবচেয়ে বড় মূর্তিটি ওখানেই। নগরীর যে আরও কত গল্প! ১৮৬৭ সালে সেখানে প্রথম মিউনিসিপ্যালিটি। বিশ শতকে সেখানকার চেয়ারম্যান মোতিচাঁদ নগর উন্নয়নের জন্য ‘কাশী তীর্থ সুধার ট্রাস্ট’ তৈরি করেন। কাশীর পণ্ডিতদের সঙ্গে পরামর্শ করে বিশ্বনাথ মন্দিরের রাস্তা চওড়া করার পরিকল্পনা নেয় এই ট্রাস্ট। আজকের বিশ্বনাথের গলি তারই ফল।
কাশীর বাসিন্দারা কি শুধুই মন্দির চান? রাস্তা, পার্ক, আলো সব মিলিয়ে চমৎকার নাগরিক পরিষেবা দিয়েছিল ইংরেজরা। দশাশ্বমেধ ঘাটে গোধূলিয়া নামে ছোট্ট একটা নদী এসে পড়ত, সেখানে নদী বুজিয়ে হল রাস্তা। আজকের গোধূলিয়া মোড়। উত্তরে বরুণার পাশে ছোট্ট নদী মৎস্যোদরী বুজিয়ে তৈরি করা হল মচ্ছোদরী পার্ক ও মন্দাগিন। শুধু মণিকর্ণিকা বা দশাশ্বমেধ নয়, কাশীখণ্ডের ৬৯ অধ্যায়ের ১৩৯তম শ্লোক: গঙ্গা যখন মৎস্যোদরীতে মেশে, সব তীর্থ সেখানে অধিষ্ঠান করে। নদী বুজিয়ে রাস্তা, পার্ক হলেও জায়গাগুলি পুরাণে রয়েছে।
কয়েক বছর আগে স্থানীয় এক রিকশাওয়ালার সৌজন্যে মুসলিম মহল্লা সালেমপুরার মাঠে ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরটি দেখেছিলাম। স্কন্দপুরাণ-মতে, এটিই কাশীর প্রথম শিবলিঙ্গ। স্থানীয় মুসলমানেরাই দেখিয়ে দিলেন, “ওঙ্কারেশ্বর? চলুন, নিয়ে যাচ্ছি।”
তবু কারা যেন শুধু শিবাজি বনাম ঔরঙ্গজেব বলে। ইতিহাস কিছুই না জেনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy