শেয়াল আর কুমির গেল আলু চাষ করতে। মাটির উপর যা গজাবে কুমির পাবে, মাটির নীচেরটা শেয়াল। ঠকে গিয়ে কুমির ভাবল, এ বার ধান চাষের সময় আমি নেব নীচের ভাগ। এ বারও সে ঠকল।
গল্পটা স্কুলবইয়ে আছে। ছুটির পাঠশালায় স্বেচ্ছাশিক্ষক দিদিমণির উঠোনভরা পড়ুয়া সকলেই এ গল্প জানে। জিজ্ঞেস করলাম, এই শেয়ালটা তো দুষ্টু, বন্ধুকে ঠকাল। ভাল শেয়াল হলে কী করত? এক জন বলল, সমান-সমান ভাগ করত। দেখলাম সবাই একমত।
গ্রাম্য শিশু, গেম থিয়োরি জানে না। জানে না, প্যাঁচ কষাকষি চলে গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে, শ্রেণিতে-শ্রেণিতে। যে লেখাপড়ার আশায় রবিবারের খেলা ফেলে এসেছে, সেখানেই ওরা বংশানুক্রমে ঠকে আসছে।
ভারতে সাক্ষরতার হার ২০১১-তে ধুঁকতে ধুঁকতে ৭৪% ছুঁয়েছে। ২০২১-এ জনগণনা হয়নি, কাজেই হালের সংখ্যা অজানা, হয়তো ৮০%। প্রাথমিকে ভর্তি ১০০%-এ পৌঁছেছে ২০০৩-এ (সংবিধানে লক্ষ্য ছিল ১৯৬০)। স্কুলছুটের হার সাম্প্রতিক ইউনেস্কো স্কোরকার্ড অনুসারে আফ্রিকার বহু দেশ তথা নেপাল আর বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ। সমান চিন্তার, যারা স্কুলে যাচ্ছে তারা শিখছে ভীষণ কম: ক্লাস সিক্সের সিকিভাগ ছাত্র ক্লাস টু-এর পড়া পারছে না। স্কুলশিক্ষার আন্তর্জাতিক সমীক্ষা ‘পিসা’য় ২০০৯-এ ভারতের স্থান ছিল ৭৩টি দেশের মধ্যে ৭২তম। সতর্ক ভারত সরকার তার পর ও-মুখো হাঁটেনি, ২০১৯-এ কথা ওঠা সত্ত্বেও।
স্বাধীনতার পর সাধারণ নাগরিক নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, সংবিধান সহায়— এ বার তাঁদের সন্তানেরা লেখাপড়া শিখবে। সরকারপুষ্ট স্কুলব্যবস্থা কিন্তু বাড়ল শম্বুকগতিতে। যাঁদের সঙ্গতি আছে তাঁরা সন্তানদের পাঠাতে লাগলেন অসরকারি স্কুলে, প্রায়ই ইংরেজি মাধ্যমে। স্কুলব্যবস্থা দ্বিখণ্ডিত হল শ্রেণিভাগের ফাটল বরাবর।
তার পর এক-এক ভাগেও ফাটল ধরেছে। পুরনো ইংরেজি স্কুলগুলি আজ নিষ্প্রভ। তাদের টেক্কা দিচ্ছে নতুন কিছু বিলাসবহুল মহার্ঘ প্রতিষ্ঠান; তাদেরও অনেকগুলি দেশের বোর্ড-কাউন্সিলের বদলে কেমব্রিজ, ব্যাকালরিয়াট প্রভৃতি আন্তর্জাতিক ছাতার নীচে ভিড়ছে। এ দিকে গ্রামে-মফস্সলে গজিয়ে উঠেছে প্রচুর নিরেস ইংরেজি স্কুল। অপর প্রান্তে সাধারণ সরকারি স্কুলেও যাদের ঠাঁই হয়নি, তাদের জন্য চালু হয়েছিল অল্প রসদের শিশুশিক্ষা কেন্দ্র, পঞ্চায়েত দফতরের অধীনে। এত দিনে সেগুলি শিক্ষা দফতরের আওতায় এসেছে, কিন্তু মূল স্কুলব্যবস্থায় অঙ্গীভূত হয়নি।
রকমারি স্কুলের গোলকধাঁধায় অভিভাবকরা স্বভাবতই ধন্দে পড়েন— কেবল অল্পশিক্ষিতেরা নন, উচ্চশিক্ষিত বিত্তবানেরাও। ফলে মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায় টাকার অঙ্ক। সত্যিই তো, অনেক ক্ষেত্রে সবচেয়ে মহার্ঘ প্রতিষ্ঠানটিই সবচেয়ে ভাল, অন্তত মন্দের ভাল; আবার কখনও মর্মান্তিক ভাবে মন্দ। ফসল কখনও মাটির নীচে, কখনও উপরে।
স্কুলব্যবস্থার জট ছাড়াতে কেন্দ্র-রাজ্য সমান উদাসীন। স্কুলশিক্ষায় কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ২০১৬-১৭’য় ছিল সমগ্র বাজেটের ২.২%, এ বারের বাজেটে (গত বছরের মতোই) ১.৫%। শিক্ষা মন্ত্রকের সরাসরি ছত্রছায়ায় অধিকাংশ স্কুল কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, যার মূল উপভোক্তা সরকারি কর্মী ও সমশ্রেণির মানুষ। গ্রামীণ ছাত্রদের নবোদয় স্কুল তুলনায় অপ্রতুল। বহু কাল আগে দিল্লির সরকার সত্যিই দেশভর স্কুলের উন্নতির জন্য ‘অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড’ চালু করেছিল, বাংলার তৎকালীন সরকার তা হেলাফেলা করেছে।
আজ দিল্লির সব উদ্যোগ ‘টোকেনিজ়ম’-এর চূড়ান্ত। তার পরাকাষ্ঠা ‘পিএমশ্রী’-র মতো অভিনব উদ্ভাবন। এতে দেশের ১৫ লক্ষ স্কুলের মাত্র ১৪,৫০০ পাঁচ বছর উন্নয়নের অনুদান পাবে, তারও ৪০% দেবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য। এগুলির আদলে বাকি লক্ষ লক্ষ স্কুলও উন্নীত হবে, কার টাকায় তা অনুক্ত। পরিবর্তে নামের আগে ‘পিএমশ্রী’ বসবে, যথা ‘পিএমশ্রী হেয়ার স্কুল’, ‘পিএমশ্রী রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়’। পশ্চিমবঙ্গ-সহ কয়েকটি রাজ্য এই বিচিত্র কড়ারে অসম্মত হওয়ায় কেবল এই প্রকল্প নয়, ‘সমগ্র শিক্ষা অভিযান’-এর সব টাকা আটকে দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ স্কুলশিক্ষা বাবদ প্রায় সব কেন্দ্রীয় বরাদ্দ।
এই অবিশ্বাস্য কাহিনির পর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। স্পষ্টতই ভারত সরকারের শিক্ষা বাজেটের উদ্দেশ্য লেখাপড়া নয়, প্রধানমন্ত্রী ও শাসক দলের প্রচার।
আর রাজ্য সরকার? শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির ধারাবাহিক উদ্ঘাটনের পর এ প্রশ্নও নিষ্প্রয়োজন। শিক্ষকের অভাব ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে, বিশেষত মফস্সলে, সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞান শিক্ষায়। ছাত্রদের মুখ চেয়ে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা পড়িয়ে চলেছেন, অভিভাবকেরা চাঁদা তুলে শিক্ষক আনছেন। গবেষণাগার ও গ্রন্থাগারের দশা শোচনীয়। কিছু স্কুলবাড়ি ভেঙে পড়ছে, কোথাও আবার জমকালো ভবন— রাজনৈতিক কৃপাদৃষ্টি যেখানে যতটুকু পড়েছে।
এটাই আসল ব্যাধি, কী কেন্দ্রের, কী রাজ্যের। শিক্ষাকে দেখা হচ্ছে নিছক রাজনৈতিক মুনাফার বিচারে। (আর্থিক মুনাফা যোগ হলে কথাই নেই।) এই অঙ্কে শিক্ষার স্থান নগণ্য, কারণ শিক্ষার মেওয়া সবুরে ফলে। নগদ বা উপহার বিতরণের তাৎক্ষণিক লাভের পিছনেই টাকা খরচ হয়। হয় শিক্ষাক্ষেত্রেও, সাইকেল থেকে ট্যাবলেট ইত্যাদি সামগ্রী দানে। পাতার বাহারে ফসলের চিন্তা উবে যায়।
মানতে হবে, গরিব দেশে কিছু কিছু বাস্তব সাহায্য অপরিহার্য। মিড-ডে মিল অসংখ্য ছেলেমেয়েকে স্কুলমুখো করে এবং লেখাপড়ার ন্যূনতম প্রাণশক্তি জোগায়। কন্যাশ্রী প্রকল্প রাজ্যের মেয়েদের পরিপূর্ণ বিকাশের সহায়। কিন্তু এ তো কেবল শিক্ষাদানের জমি তৈরি করা। লেখাপড়াতেই যদি দুর্লঙ্ঘ্য ঘাটতি থেকে যায়, সেটা পূরণ হবে কী ভাবে?
সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েদের ফলপ্রসূ শিক্ষার সুযোগ দিন দিন কমছে। শাসকের দৃষ্টিতে শিক্ষায় লাভবান হয় ব্যক্তিবিশেষ, গোটা সমাজ নয়, ওটা ‘কমন গুড’ নয়, ‘প্রাইভেট গুড’। সরকার তবে তাতে টাকা ঢালবে কেন? শিক্ষা, বিশেষত অর্থকরী শিক্ষার জোগান দ্রুত চলে যাচ্ছে অসরকারি হাতে, বিপণন হচ্ছে বিশাল মূল্যে। আইআইটি প্রমুখ কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানেও আজ পড়ার খরচ বিপুল। মধ্যবিত্তেরা ধারকর্জ করে সন্তানদের পাঠাচ্ছেন, নিম্নবিত্তেরা পড়ছেন আতান্তরে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানে অল্প খরচে ভাল শিক্ষা পেলে কে যাবে দুর্মূল্য অসরকারি কেন্দ্রে? এই সমান্তরাল ব্যবস্থার অমোঘ শর্ত সরকারি বিদ্যায়তনের অবনমন: অর্থবরাদ্দ শোচনীয় ভাবে কমিয়ে, বিধিনিষেধের বোঝা চাপিয়ে, শিক্ষকপদ অনির্দিষ্ট কাল খালি রেখে। স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছরে গড়া উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা অশেষ ত্রুটি সত্ত্বেও পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছিল, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাচ্ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, সব শ্রেণি ও বিত্তের ছাত্রদের সেখানে প্রবেশ ছিল অবাধ। সেই পথ বন্ধ করে আজকের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা বিভক্ত ও দিক্ভ্রান্ত।
সম্প্রতি যোগ হয়েছে আর এক উপসর্গ। অতিমারির সময় অনলাইন কোচিং সংস্থাগুলি ফুলেফেঁপে উঠেছিল; আজ বাজার স্বভাবতই পড়তির দিকে। অথচ এরা এখন ‘এজুকেশন ইন্ডাস্ট্রি’র আদরণীয় অঙ্গ। কে না জানে, ভারত সরকার দরদি শিল্পবান্ধব। দেশ জুড়ে স্কুল বোর্ড এমনকি ইউজিসি-ও তাই সোৎসাহে বৈদ্যুতিন শিক্ষা আলিঙ্গন করছে।
বিদ্যাচর্চায় বৈদ্যুতিন মাধ্যমের পরম উপকারী ভূমিকা আছে, এই প্রবন্ধকারও তাতে শামিল। কিন্তু আর্থসামাজিক পরিস্থিতি নির্বিচারে সেটা সর্বত্র চাপিয়ে দেওয়া অবিমৃশ্যকারিতা। আরও বড় কথা, এমনটা সুস্থ শিক্ষণপদ্ধতির বিরূপ। তার চূড়ান্ত নজির মাল্টিপল চয়েস প্রশ্নের আগাছার মতো বিস্তার। বৌদ্ধিক বিকাশ ধ্বংসকারী এই মুখস্থ-সর্বস্ব কম্পিউটার-বান্ধব পদ্ধতি যেন অশ্বমেধ যাত্রায় বেরিয়েছে: দখল করেছে সব ক’টি সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা, সাধারণ স্নাতক কলেজে ভর্তি পর্যন্ত। ছাত্রদের স্নায়ুর চাপ বহু গুণ বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কোচিং-এর বাজার। আরও কোণঠাসা হয়েছে নিম্নবিত্ত ছাত্রেরা এবং রাজ্যস্তরের সরকারি স্কুলের ছাত্রেরা (দুই গোষ্ঠী অনেকটা সমার্থক)। প্রবল প্রতিবাদ করেছে তামিলনাড়ু, অন্যান্য বিরোধী রাজ্যও খানিক খানিক। ‘এক দেশ এক প্রবেশিকা’র জনমুখী প্রতিশ্রুতি বাস্তবে অসার: আবার সেই ফসলের বদলে পাতা-শিকড়।
আমাদের পাড়ার রামু (নাম পরিবর্তিত) খুচরো শ্রমিক, মাসিক আয় সাত-আট হাজার। তার মেয়ে প্রথম শ্রেণিতে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে। বাজারের স্বপ্নমাখা মন্ত্রণা তাকে বুঝিয়েছে, সাধারণ কলেজে পড়লে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। নম্বরের জোরে সে ঢুকেছে হোটেল ম্যানেজমেন্টের এক সম্ভ্রান্ত প্রতিষ্ঠানে, যার চার বছরের খরচ ছয় লাখ টাকা। রামু কুড়িয়ে-বাড়িয়ে পঁয়ষট্টি হাজার জোগাড় করেছে। আর সম্বল গ্রামে এক ফালি জমি। সেটা বিক্রি বা বন্ধকের পর ‘দেখা যাক কী হয়’।
এই ছেলেমেয়েগুলি যা চাইছে, মধ্যবিত্তের সন্তানের পক্ষে তা তুলনায় সহজলভ্য, প্রায় গতানুগতিক, মেধা কিছু কম হলেও। বললেই প্রতিবাদ উঠবে: মোটেই না, আমাদের ছেলেমেয়েদের কম স্ট্রাগল করতে হচ্ছে? সোজা উত্তর: হ্যাঁ, ঢের কম, একটা মৌলিক স্তরভেদ আছে। বাংলায় এই প্রবণতা কম, পশ্চিম বা দক্ষিণ ভারতে অনেক বেশি রামুর সন্তান এই আবর্তে পড়ে। ভাগ্যপরীক্ষায় জিতে হাজারে এক জনের স্বপ্নপূরণ হয়। এস্টাব্লিশমেন্ট তার সাফল্য শিখণ্ডী করে নিজেকেই বাহবা দেয়: ‘দেখ, আমাদের জমানায় মেধার কেমন কদর!’ আর দশ-বিশ জন প্রশিক্ষণের মাঝপথে মাঝারি মাপের একটা কিছু জুটিয়ে নেয়। বাকিরা পায়ের তলার মাটি খুইয়ে নামে গিগ ইকনমির খুচরো রোজগারের জলকাদায়। যারা ঝুঁকি না নিয়ে ‘সাধারণ’ কলেজে ঢোকে, বা লেখাপড়া ছেড়ে দেয়, তাদেরও আশ্রয় সেই গিগ ইকনমি।
এর ফলে দেখা দিয়েছে এক সর্বনাশা নতুন লক্ষণ। কয়েক দশক ধরে গরিব মানুষ শিক্ষার স্বপ্ন দেখেছে, সে জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, তা মধ্যবিত্তের অকল্পনীয়। এই সাধনায় চিড় ধরিয়েছে নতুন শতকের আর্থনীতিক ধারা, শিক্ষার নতুন অর্থনীতি যার অঙ্গ। আজ তারা বলছে, লেখাপড়া শিখে লাভ কী? বরং তার মায়া কাটিয়ে শ্রেণিসুলভ জীবনযাত্রার ভবিতব্যে ফিরে যাই। শিক্ষার ফসলের বদলে ফের সেই পাতা-শিকড়।
এটাই কি শাসক তথা শিক্ষিত শ্রেণির সুপ্ত অভিপ্রায় ছিল? আজ চার দিকে বর্ণাশ্রমের মহিমাকীর্তন। যুগদর্শন বলছে বর্ণাশ্রম এক সুশৃঙ্খল সুবিন্যস্ত সহাবস্থানের বিধান, বিদ্যায় দক্ষতায় বলে অধিকারে সমাজকে ছিন্নভিন্ন করে ভাগগুলো শ্রেণিবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়া। জাতীয় শিক্ষানীতির মুগ্ধকর ‘রেটরিক’-এর আড়ালে উঁকি মারছে এমনই এক উদ্দেশ্য।
অনেকেই বলবেন, ক্ষতি কী? ক’টা লোকের কতটুকু শিক্ষার দরকার? বাকিদের ভূতের পিছনে ছুটে লাভ? থাকুক না তারা সনাতন কাজে সনাতন অবস্থানে। নিজেদের সন্তানের কেরিয়ার সামলাতেই আমরা হিমসিম খাচ্ছি। পরের কথা ভাবার সময় আছে, না শিক্ষিত বেকারের ভিড় বাড়িয়ে লাভ আছে?
এর উত্তর: একমাত্র তাতেই লাভ। সব শ্রেণির সব নাগরিকের মেধার সদ্ব্যবহার করে সব স্তরের কর্মী-সংখ্যা বাড়লে পরিবর্ধক উৎপাদন বাড়বে, অর্থনীতিতে গতি আসবে, শিক্ষিতেরা আর বেকার থাকবে না। শিক্ষা তখনই অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে যখন তা সর্বজনীন ও সহজলভ্য। যে ব্যবস্থার পোশাকি নাম নলেজ ইকনমি, তাতে বিদ্যাচর্চাই অর্থশক্তিকে চালিত করে, উল্টোটা নয়।
একটা উদাহরণ দেখা যাক। ডাক্তারির প্রবেশিকা নিয়ে দেশ তোলপাড়। সরকারি মেডিক্যাল কলেজে আসন বাড়ছে শম্বুকগতিতে; লাফিয়ে লাফিয়ে অসরকারি প্রতিষ্ঠানে, যার দক্ষিণা প্রায়ই কোটির ঘরে। ভারতের তরুণেরা রাশিয়া, জর্জিয়া, কিরগিজ়স্তান, মায় নেপালে বাংলাদেশে ডাক্তারি পড়তে যাচ্ছে, ‘মাত্র’ বিশ-ত্রিশ লাখের বিনিময়ে। যাদের সে সঙ্গতিও নেই, তাদের একমাত্র আশা সরকারি কলেজে ঠাঁই পাওয়া, সঙ্গতিপন্ন ছাত্রদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়। এ দিকে সঙ্গতি থাকলে নিটে কম নম্বর এমনকি শূন্য পেলেও অসরকারি প্রতিষ্ঠানের দ্বার অবারিত। পাশ করে অবশ্যই যোগ দিতে হবে মহার্ঘ অসরকারি হাসপাতালে, টাকা উসুল করতে।
অর্থাৎ সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশের উত্তরোত্তর কম যোগ্য প্রার্থীদের হাতে দেশবাসীর চিকিৎসার ভার তুলে দেওয়া হচ্ছে; বাকি বৃহৎ অংশের মেধাবী ছাত্রদেরও প্রবেশ সীমিত। শিক্ষা স্বাস্থ্য অর্থনীতি, কোনও বিচারেই এটা আদর্শ ব্যবস্থা নয়। অনুরূপ ব্যবস্থা কিন্তু সব বিদ্যাক্ষেত্র ও কর্মক্ষেত্রেই কায়েম হচ্ছে, শিক্ষাকে দুমড়ে-মুচড়ে পোরা হচ্ছে এই নিষ্করুণ কাঠামোয়। এতে কোনও ক্ষুদ্র গোষ্ঠী পরম লাভবান হতে পারে, হচ্ছেও; কিন্তু বৃহত্তর অর্থনীতি থুবড়ে পড়বে, কারণ তার জন্য দরকার সব চাহিদায় সব স্তরে সব রকম নৈপুণ্যের কর্মী। তার সংস্থান না থাকলে মুষ্টিমেয় উচ্চাভিলাষীর দল কাচের ছাদে মাথা ঠুকে জখম হবে।
পুরো গল্পটাই কুমির আর শেয়ালের উপাখ্যান। আমার শেষ প্রশ্ন কিন্তু আরও মোক্ষম: কে কুমির কে শেয়াল? সকলেই চাইছি এক পাচ্ছি আর এক, অন্যের ঝোল নিজের কোলে টেনেও যেন পেট ভরছে না। শিক্ষায় অসাম্য ও বঞ্চনা বিধ্বস্ত করছে সমাজ আর অর্থনীতির পুরো পরিসর। তার চেয়ে ওই সরল শিশুটির কথামতো সমান-সমান ভাগ করলে কেমন হয়?
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy