আজকের অর্থনীতিতে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা বেসরকারি লগ্নি পুঁজির গুরুত্ব অপরিসীম। যে সমস্ত সংস্থা আমাদের প্রাত্যহিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে, বা যে সংস্থাগুলো আমাদের ভবিষ্যতের গতিপ্রকৃতি স্থির করে দিচ্ছে, তার প্রায় সবই গড়ে উঠেছে বেসরকারি পুঁজির মাধ্যমে। অ্যাপল হোক বা ফেসবুক, উবর হোক বা জ়োমাটো, বেসরকারি পুঁজি ছাড়া কোনও সংস্থাই টিকে থাকতে পারবে না। বোঝা যায়, এই মডেলে স্বভাবতই ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সংস্থাগুলোর কর্তাদের কী প্রবল প্রতাপ! তাঁদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের নির্দেশে শুধু আজকের পৃথিবী চলছে না, আগামী পৃথিবীও চলবে।
‘কর্তা’ শব্দটা না-ভেবে বলিনি, শব্দটা পুংলিঙ্গ বলেই ব্যবহার করেছি। আমেরিকার সর্ববৃহৎ পঞ্চাশটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সংস্থায় পার্টনারদের নব্বই শতাংশেরও বেশি হলেন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। এবং এঁদের মধ্যে সত্তর শতাংশেরও বেশি ডিগ্রি নিয়েছেন (মূলত এমবিএ ডিগ্রি) আমেরিকার প্রথম দশটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ডেমোগ্রাফি বা জনতত্ত্বের হিসাবে এঁদের মধ্যে স্বভাবতই মিল বিস্তর।
এই বেসরকারি পুঁজি পেয়ে উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের যে সমস্ত সংস্থা সাম্প্রতিক অতীতে জনসাধারণের জন্য শেয়ার ছাড়তে পেরেছে, তাদের সামগ্রিক মূল্য আজ পঞ্চাশ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। সংখ্যাটা তাক লাগানোর মতোই। কিন্তু, কোন ক্ষেত্রগুলিতে এই বেসরকারি পুঁজির রমরমা? গবেষণা দেখাচ্ছে, মোট বেসরকারি পুঁজির প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ যাচ্ছে কনজ়িউমার গুডস এবং সফটওয়্যার শিল্পে। আর কোন ক্ষেত্রগুলি প্রায় কিছুই পাচ্ছে না? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা, উষ্ণায়ন প্রতিরোধ ইত্যাদি। অর্থাৎ, পৃথিবীর বুকে মানবসভ্যতাকে সুস্থায়ী রাখতে হলে, এই গ্রহের বাসযোগ্যতার মেয়াদ আরও কিছু দিন বাড়াতে হলে যে যে ক্ষেত্রের গুরুত্ব অপরিসীম, সেখানে বেসরকারি পুঁজির ভূমিকা যৎসামান্য। তাৎক্ষণিক মুনাফার আশায় বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা বারংবার অদূরদর্শিতা দেখিয়ে চলেছেন।
এই যে অদূরদর্শিতা, এ অবশ্য শুধু বেসরকারি ক্ষেত্রেরই রোগ নয়। খোদ রাষ্ট্রের দিকেই অভিযোগের আঙুল তোলা যায়। কোভিড-পরবর্তী দুনিয়ায় ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অবস্থা কতটা অনুকূল, তা খতিয়ে দেখতে ব্লুমবার্গ পত্রিকা সম্প্রতি একটি সমীক্ষা চালায়— সমীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত তিপ্পান্নটি দেশের মধ্যে ভারত ৩৭তম স্থানে, ব্রাজিল ৪১, দক্ষিণ আফ্রিকা ৪৯, চিন ৫১, আর রাশিয়া রয়েছে ৫২তম স্থানে। একুশ শতকের শুরুতে এই পাঁচটি দেশকে চিহ্নিত করে বলা হয়েছিল যে, আগামী পৃথিবীর প্রগতির চাবিকাঠি রয়েছে এদের হাতেই, যাদের একত্রে বলা হয় ‘ব্রিকস’। অথচ, এই পাঁচটি দেশে অর্থনৈতিক অসাম্য তো বটেই, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যজনিত অসাম্যও ক্রমেই বেড়েছে গত দু’দশক ধরে। কোভিড-পরবর্তী পৃথিবীতে এই দেশগুলিকে যে ঘোর প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়তে হচ্ছে, তা বিনা কারণে নয়। মানব উন্নয়নে সামগ্রিক অসাম্যের সঙ্গে আর্থিক বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথে প্রতিবন্ধকতার কী কার্যকারণ সম্পর্ক, তা নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন— কিন্তু সম্পর্ক যে রয়েছে, সে কথা অনস্বীকার্য। আর্থিক অসাম্য একুশ শতকে বিশ্ব উষ্ণায়নের মতোই একটি ঘোরতর সমস্যা, কিন্তু সে কথা আমাদের রাষ্ট্রনেতারা এখনও বুঝছেন বলে মনে হয় না— অন্তত, কথাটি তাঁরা স্বীকার করেন না মোটে।
একুশ শতকের ধনতান্ত্রিক কাঠামোয় অসাম্য পরতে পরতে। শেয়ারহোল্ডিং-এর প্রসঙ্গে আসি। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে টয়োটা নামক সংস্থাটির চমকপ্রদ উত্থান জানিয়েছিল, বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত মুছে ফেলে জাপান কী ভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সেই টয়োটায় ব্যক্তিবিশেষদের হাতে মোট শেয়ার রয়েছে মাত্র এগারো শতাংশ, বাকি পুরোটাই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সংস্থা, ব্যাঙ্ক ও বাণিজ্যিক সংস্থার হাতে। অন্য দিকে, ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জ়াকারবার্গের হাতে রয়েছে সংস্থার প্রায় ত্রিশ শতাংশ শেয়ার। টেসলার ইলন মাস্ক, বা অ্যামাজ়নের জেফ বেজোস-এর মতো অন্য ধনকুবেররাও এমনই ক্ষমতাশালী।
অর্থপ্রাপ্তির ব্যাপারটি তো আছেই, কিন্তু ক্ষমতাই হল মূল কথা। যে কারণে ফেসবুকের মাধ্যমে ‘হেট স্পিচ’ দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়লেও ফেসবুক নড়ে বসে না; বাণিজ্যিক যুক্তি না থাকলেও ইলন মাস্ক টুইটার কেনার জন্য এক বিশাল অঙ্কের টাকার প্রস্তাব দিয়ে বসেন; বা অ্যামাজ়নের কর্মচারীরা ন্যূনতম মজুরিতে প্রাণপাত করলেও বেজোস মহাকাশ সফরে যান। এঁদের সংস্থাগুলিতে সমষ্টিগত মালিকানার পরিমাণ আরও বেশি হলে এই যথেচ্ছাচার ঘটত কি? ব্যক্তিবিশেষের এই ক্ষমতায়নের উদাহরণ এখনও হাতে গোনা, কিন্তু সেই কয়েকজনের হাতে যে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে, তা মানব ইতিহাসে বিরল।
আজ বিশ্ব জুড়ে মূল্যবৃদ্ধির যে আতঙ্কজনক আবহ, তার পিছনে শুধু চাহিদা-জোগানের অসাম্য নেই। রয়েছে আরও এক গূঢ় কারণ। বহু বছর ধরে উন্নত দেশগুলি মূল্যবৃদ্ধির উপর ভরসা রেখে একই সঙ্গে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও রাষ্ট্রীয় ঋণশোধ হাসিল করতে চেয়েছে। যে কারণে জাপানের সদ্যনিহত ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ‘আবেনমিক্স’ নিয়ে আমেরিকা ও ইউরোপ জুড়ে ধন্য ধন্য পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ঋণের বোঝা লাঘব করার প্রকৃষ্টতম পথটি হল বেসরকারি পুঁজির উপর যথাযথ শুল্ক আরোপ। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এই স্পষ্ট পথে পা রাখতে প্রায় প্রতিটি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের নেতারই সমান অনীহা।
যে গ্রিক শব্দ ‘অলিগার্কি’ ভাঙন-পরবর্তী রাশিয়ায় রাষ্ট্র ও পুঁজিপতির অশুভ আঁতাঁত বোঝাতে উঠে এসেছিল, সেই অলিগার্কি আজ প্রায় প্রতিটি দেশে বিদ্যমান। এবং, সে কারণেই পুঁজির উপর কর বসাতে নেতাদের এত অনীহা। গত বছরেই আমাদের দেশে প্রথম বারের জন্য আদায়কৃত কর্পোরেট ট্যাক্সের পরিমাণ নন-কর্পোরেট ট্যাক্সের চেয়ে কমে যায়। কিন্তু এ কোনও ব্যতিক্রমী খবর নয়— শেষ ন’বছরে মোট আদায়ে কর্পোরেট করের পরিমাণ কমেছে তেরো শতাংশেরও বেশি। আমেরিকাতেও রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প হোন বা স্বঘোষিত ডেমোক্র্যাট জেফ বেজোস, কর ফাঁকির পরিমাণ বহু বিলিয়ন ডলার। এবং, এই অনাদায়ি করের জন্য দায়ী যথাযথ পরিকাঠামো না থাকা। বছরের পর বছর ধরে সেই পরিকাঠামো না তৈরি হওয়ার কারণ হয় অদূরদর্শিতা ও দুর্নীতির সহাবস্থান।
এই অদূরদর্শী ও বিকৃত অর্থব্যবস্থা থেকে আশু পরিত্রাণের কোনও পথই নেই। কিন্তু হাল ছেড়ে না দিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার, নইলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুখ বা স্বস্তি কোনওটাই রেখে যেতে পারব না।
ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স বিভাগ, কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি, ইংল্যান্ড
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy