Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus

স্কুল পুরোপুরি খুলুক এখনই

স্কুল খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল ঠিকই।

অম্লান বিষ্ণু
শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২১ ০৬:০৫
Share: Save:

এবার যদি স্কুল না খোলে, তা হলে আমার বাচ্চাদের আর সুস্থ রাখা যাবে না। পড়াশোনা চুলোয় যাক, ওরা কারও সঙ্গে ঠিক করে কথা বলতেও ভুলে গিয়েছে।”— বললেন মমতা মাহাতো, ঝাড়গ্রামের এক আদিবাসী-অধ্যুষিত গ্রাম কুমারী-র বাসিন্দা। মমতার দুই সন্তানের এক জন তৃতীয় শ্রেণিতে, অন্য জন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। শিক্ষক জানাচ্ছেন, “এখানকার বেশির ভাগ মানুষই দিনমজুরি করে কোনও ক্রমে সংসার চালান। কিন্তু মায়েরা বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে যথেষ্টই গুরুত্ব দেন।” একই অভিজ্ঞতা কলিকাতা অনাথ আশ্রম প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও। কিছু দিন আগে একটি বাচ্চার মা শিক্ষককে ফোন করে বলেন, “স্যর, ছেলেটাকে আপনি এক বার নিয়ে যেতে পারেন? ও স্কুল খোলা নিয়ে প্রতি দিন বাড়ি মাথায় তুলছে। সব কিছু যখন খুলে গিয়েছে, স্কুলই বা আর বন্ধ থাকবে কেন?” অকাট্য প্রশ্ন। নির্বাচনী প্রচার, পুজো, প্রতি দিন বাসে-ট্রেনে মানুষের বাদুড়ঝোলা হয়ে কাজে যাওয়া— সেখানে সংক্রমণ বাড়ার কথা উঠছে না, কিন্তু স্কুল খোলা নিয়েই যত আতঙ্ক?

স্কুল খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল ঠিকই। একটা সময় পর্যন্ত স্কুল বন্ধ রাখার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন বহু চিকিৎসক। শিশুদের জীবনের কথা ভাবা অবশ্যই জরুরি। এবং, সেই চিন্তা থেকেই স্কুল খোলার দাবিও ওঠে। শিশুদের জীবন মানে শুধু রোগের হাত থেকে বেঁচে থাকা নয়, নিরক্ষরতা ও অশিক্ষার হাত থেকেও বাঁচা। এই দুটো দিককেই এক সঙ্গে গুরুত্ব দিতে বলে সুস্থ সমাজচিন্তা।

করোনা আক্রান্ত ১৯০টির দেশের মধ্যে ১৪১টি-তেই পঠনপাঠন শুরু হয়েছে। ভারতেও শিক্ষক-অভিভাবকেরা মনে করছেন, রাজ্যে পুজোর আগে স্কুল খুললেও খুব সমস্যার কারণ ছিল না। এ রাজ্যের বিশিষ্ট চিকিৎসকরাও স্কুল খোলার পক্ষেই সওয়াল করছেন। ইউনিসেফ-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, করোনা অতিমারিতে বিশ্বব্যাপী ১৬০ কোটি শিশু পড়াশোনার বাইরে চলে গিয়েছে। সত্যিই তো, দেড় বছর ধরে বাচ্চাদের প্রায় নিরক্ষর থেকে যাওয়ার যে সংক্রমণ চলছে, তা আটকাবে কে? চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শের সঙ্গে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, এই দেড় বছরে বাচ্চাদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করার জন্য সরকারি ব্যবস্থার পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। স্কুল খোলার পক্ষে মতামত দিতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় এই কথাগুলোই বার বার বলে আসছেন সমাজসচেতন বিদ্বজ্জনরা।

এর পরেও অনেকে হয়তো স্কুল খোলার ব্যাপারে আমেরিকায় সাম্প্রতিক সংক্রমণ বৃদ্ধির উদাহরণ দিতে চাইবেন, কিন্তু একশো বছরের ইতিহাসে আমেরিকা ব্যাকটিরিয়া ও ভাইরাস প্রতিরোধে অনেক বার নাস্তানাবুদ হয়েছে। প্রায় একশো বছর আগে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে সে দেশে বহু মানুষ মারা যান। সেই সময়েও সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল অনেক দিন। ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়েও প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ মারা যান। সে দেশের ‘সেন্টারস ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’-(সিডিসি)-র তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-২০’তে দেড় কোটি মানুষ ফ্লুয়ে আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গিয়েছেন ৮,২০০ জন। মৃতদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাও কম নয়। সিডিসি-র আশঙ্কা, আগামী দিনে ফ্লুয়ে আক্রান্ত হয়ে বছরে গড়ে ১২,০০০ মানুষ মারা যেতে পারেন আমেরিকায়। সুতরাং, অন্যান্য যত বিষয়ে তারা এগিয়ে থাকার গর্ব করুক না কেন, স্বাস্থ্য বিষয়ে তাদের জাতীয় নীতি ও নাগরিক সচেতনতার ক্ষেত্রে সমস্যা আছে।

ইউরোপের ফ্রান্স, জার্মানি তো বটেই, এমনকি ইটালিতেও স্কুল খুলেছে। নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সর্বত্রই স্কুল খুলে গিয়েছে। চিন গত বছর সেপ্টেম্বরেই স্কুল খুলেছিল। ইন্দোনেশিয়া, জাপানেও স্কুল খুলেছে। স্কুল খোলার উদ্যোগকে ইতিবাচক বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। কোভিডের তৃতীয় ঢেউয়ে বাচ্চাদের সংক্রমণ বাড়বে— এই তত্ত্বটাই এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। অনেক শিশুরোগবিশেষজ্ঞই তত্ত্বটিকে নস্যাৎ করেছেন। এমনকি যাঁরা এই তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন, তাঁরাও এখন ঢোঁক গিলছেন! ‘তৃতীয় ঢেউ’ কথাটাকেই যথেষ্ট সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। সুতরাং, ঠিকঠাক পরিকল্পনা-সহ এখনই স্কুল খোলা এবং সব ক্লাসের লেখাপড়া চালু করার সিদ্ধান্ত বোধ হয় আরও অনেক ভয়াবহ সামাজিক সংক্রমণ আটকানোর প্রাথমিক দাওয়াই হতে পারে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের করোনা সংক্রমণ যাতে না হয়, সেই বিষয়ে যাবতীয় সতর্কতা মেনেই স্কুল পরিচালনা করতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে একটা অংশ প্রথম থেকেই বিকল্প পঠনপাঠন চালু রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার সামাজিক ভাবে অনেক রকম উদ্যোগ দেখা গিয়েছে, বাচ্চাদের লেখাপড়া জারি রাখার, অন্তত লেখাপড়ার সঙ্গে সংযোগটুকু রক্ষা করার। অবশ্য আমি নিজে প্রাথমিক শিক্ষক হিসাবে সলজ্জ ভাবে স্বীকার করি, শিক্ষকদের মধ্যে একটা অংশ ছুটি কাটাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের মনেও স্কুল খোলার ব্যাপারে আগের থেকে তাগিদ হয়তো বেড়েছে। সম্প্রতি শিক্ষক ইউনিয়নগুলি স্কুল খোলার পক্ষে যে জোরালো দাবি তুলেছে, এটা অন্তত আংশিক ভাবে শিক্ষকদের মনোভাবের প্রতিফলন।

ইউনিসেফ-এর হিসাব বলছে, লেখাপড়া বন্ধ থাকায় যে ক্ষতি হল, তা শিশুদের ভবিষ্যৎ আয়ের নিরিখে ১০ লক্ষ কোটি আমেরিকান ডলারের সমান। কিন্তু এ ক্ষতি অসীম— শিক্ষার পরিমাপে টাকা শুধু যে অতি অপ্রতুল একটা মাপকাঠি তা-ই নয়, বিভাজনের উপাদান হিসাবে পরিত্যাজ্যও বটে। যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল, সব শিশুকেই অক্ষরের অধিকারী করে তোলা, তাদের জীবনকে সুস্থ ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে দেওয়া— তাতে টাকার অঙ্কে কোনও লাভ হোক বা না হোক। সে কারণেই ছেলেমেয়েরা আবার স্কুলজীবন ফিরে পাক, এটাই এখন মৌলিক দাবি। দৈহিক সুস্থতা জরুরি, কিন্তু বুদ্ধির সুস্থতাও সমান জরুরি। সে কারণেই স্কুল খোলা দরকার। আর বিলম্ব না করেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Education system
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy