কত নদী সমুদ্র পর্ব্বত উল্লঙ্ঘন করিয়া মানবের কণ্ঠ এখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছে— কত শত বৎসরের প্রান্ত হইতে এই স্বর আসিতেছে। এসো এখানে এসো, এখানে আলোকের জন্মসঙ্গীত গান হইতেছে।
বিচিত্র প্রবন্ধ, লাইব্রেরি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার প্রথম চাকরি, আধা-সরকারি প্রেসে। সেখানে একটা বিশাল লাইব্রেরি ছিল। অসাধারণ সেই লাইব্রেরি। কারিগরি বই ছাড়াও ছিল বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সংগ্রহ। সেখানে বিভিন্ন শিফ্টের কর্মীরা অবসরে এসে পছন্দমতো বই পড়তেন। বিরসবদন গ্রন্থাগারিক বীথিদির সঙ্গে আলাপ জমাবার চেষ্টা করে জেনে নিতেন বাড়ির জন্য এ বার কী কী বই নিয়ে যাওয়া যায়। কেউ কেউ বই না পড়লেও খবরের কাগজের প্রথম থেকে শেষ পাতাই পড়ে ফেলতেন। কারিগরি দক্ষতা বাড়াতে নিয়মিত প্রযুক্তিবিদ্যা বিষয়ক জার্নাল পড়ার অভ্যাস তো থাকতই। সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ তরুণী সেখানে কোনও রকম অশোভন ব্যবহার যে পায়নি, তা বুঝি ওই গ্রন্থাগার ছিল বলেই। সাতশো কর্মী সম্বলিত আদ্যন্ত পুরুষালি রুক্ষ পরিবেশে ছিল গ্রন্থাগার এক টুকরো মরূদ্যান।
আমাদের জীবনে গ্রন্থাগার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। জ্ঞানচর্চার একটা গণপরিসর তৈরি করেছে, সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক চেতনার ভিত গড়েছে। বড় লাইব্রেরির কথা ছেড়ে দিলেও পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট গ্রন্থাগারগুলি এক একটা ছোট ছোট জায়গায় ছোট ছোট করে আলো জ্বেলে রাখত। সেখানে রিডিং রুমে পড়ার জন্য সদস্য হওয়ারও প্রয়োজন ছিল না। এই ভাবে এক একটি ছোট গ্রন্থাগার এক একটি অঞ্চলের অসচ্ছল মানুষের পাঠক্ষুধা মেটাত। বাড়ির মেয়েদের জন্যেও এই গ্রন্থালয়গুলি ছিল মুক্তির ইশারা।
আশাপূর্ণা দেবীর লেখায় পাই, “চৈতন্য লাইব্রেরির সঙ্গে আমার বাল্যস্মৃতি নিবিড়ভাবে জড়িত। আমার মা এই লাইব্রেরি থেকে বরাবর বই আনিয়ে পড়তেন। তখনকার দিনে অবশ্য মেয়েদের পক্ষে নিজে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই নির্বাচন করে নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। ক্যাটালগ থেকে নাম নিয়ে বাড়ির ছেলেদের দিয়ে বই আনিয়ে নেওয়া হত। মায়ের দৌলতে আমরাও চৈতন্য লাইব্রেরির বই-এর পাঠিকা ছিলাম।”
আমাদের শৈশবে দেখেছি, মফস্সলেও ছোট গ্রন্থাগারগুলিতে এলাকার বাচ্চাদের জন্য নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হত। একটা ছিল হাতের লেখা প্রতিযোগিতা। দুর্বোধ্য হস্তাক্ষরের জন্যে আমি কোনও কালে সে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে না পারলেও, বন্ধুদের সাফল্যে খুশি হতে তো কোনও বাধা ছিল না।
সেই ছোট ছোট গ্রন্থাগারগুলো বন্ধ হয়ে গেল এক এক করে। আলো নিবে যাওয়ার মতো। আমরা খেয়ালই করলাম না কত ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। নৈবেদ্যর চালকলার উপরে সন্দেশের মতো বড় লাইব্রেরিগুলো আছে এখনও, তা ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ফারে আমাদের হাতের মুঠোয় জ্ঞান ভান্ডার, বই পড়তে চাইলে ডিজিটাল লাইব্রেরি, ই-বই, পিডিএফ, কিন্ড্ল কত কিছু। কিন্তু এই তথ্যের অমিতাচারের আড়ালে ধস যে কতটা নেমেছে বুঝতেই পারিনি।
গ্রন্থাগারিক ঐক্যমঞ্চের বিশ্বজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, রাজ্যের ২৪৮০টি সরকারি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং অনুদানপ্রাপ্ত সাধারণ গ্রন্থাগারে রয়েছে প্রায় ৩৯০০ শূন্য পদ। অনুমোদিত পদের প্রায় ৭০ শতাংশ শূন্য, নিয়োগ নেই। রাজ্যের ৬৫২৭টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ২৫০০টিতে গ্রন্থাগারিক আছেন। ১০০০ পদ শূন্য, যা মোট অনুমোদিত পদের প্রায় ৪০ শতাংশ।
বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেডিক্যাল কলেজে ও পলিটেকনিকে লাইব্রেরিগুলির দরজা গ্রন্থাগারিকের অভাবে পাঠকের কাছে বন্ধ। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পাড়ার পুরনো গ্রন্থাগারগুলির। সেগুলি পুরনো, নোনা ধরা দেওয়ালের মধ্যে ভাঙাচোরা তাকে বহু মূল্যবান বই নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হয়তো এক জন গ্রন্থাগারিককে চারটে লাইব্রেরি দেখতে হয়। তাই তিনি ঘুরিয়েফিরিয়ে গ্রন্থাগার খোলেন। বিশেষত, অতিমারির সময়ে দীর্ঘ দিন গ্রন্থাগার বন্ধ থাকায় বইগুলি কী অবস্থায় আছে, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ খুলেছে, পড়তে এসে অস্থায়ী গ্রন্থাগার গড়ে তোলার প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল আমাদের হাতে। ইনডেক্স কার্ড বা সূচক তালিকা তৈরি, গ্রন্থসূচি তৈরি করতে গিয়ে বুঝেছিলাম গ্রন্থাগারের দেখাশোনার জন্য গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের ডিগ্রিধারী স্থায়ী বৃত্তিকুশলী কর্মীদের দরকার। এ সব আনাড়ির কর্ম নয়।
সেই গ্রন্থগার কর্মীর নিয়োগ না হওয়ায় বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির আলোকবর্তিকা গ্রন্থাগারগুলি আজ ধ্বংসের মুখে। আমরা জানি, যুগে যুগে গ্রন্থাগার কী ভাবে অজ্ঞতা ও হিংসার শিকার হয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা গ্রন্থাগারের প্রভূত ক্ষতি করেছিল। উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরির প্রায় ১৮,০০০ বই যুদ্ধকালীন ক্যাম্পের রান্নায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেছিল। তখন আরও অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য এবং মূল্যবান বই ক্ষতির মুখে পড়েছিল।
গ্রন্থাগারিকের নিয়োগ না হলে আমাদের জ্ঞানচর্চার গণপরিসরে অন্ধকার নেমে আসবে। আশু প্রতিকার চাইলে ঠিক জায়গায় এই বিপদের কথা পৌঁছে দিতে হবে, এখনই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy