নন্দলালের ভারী রাগ, অঙ্কের পরীক্ষায় মাষ্টার তাহাকে গোল্লা দিয়াছেন। সে যে খুব ভাল লিখিয়াছিল তাহা নয়, কিন্তু তা বলিয়া একেবারে গোল্লা দেওয়া কি উচিত ছিল?” বিশ্ব ক্ষুধা সূচক বা গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্স-এর তথ্য প্রকাশ হতে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থা যেন সুকুমার রায়ের ‘নন্দলালের মন্দ কপাল’ গল্পের নন্দলালের মতো। সে বেচারি অঙ্কে কাঁচা, ইতিহাসে ভাল। কিন্তু স্কুলের পরীক্ষায় শুধু অঙ্ক আর সংস্কৃতে প্রাইজ় দেওয়া হয়। সংস্কৃতটা চেষ্টা করলে বাগে আসতে পারে ভেবে সে চুপিচুপি সংস্কৃত পড়ে। সারা বছর ‘হসতি হসত হসন্তি’ মুখস্ত করে বেচারি রেজ়াল্টের দিন জানতে পারে, সে বারে সংস্কৃতের প্রাইজ় উঠে গিয়েছে। বদলে শুরু হয়েছে ইতিহাসের পুরস্কার।
দেশের বর্তমান সরকারের পুরস্কার ও র্যাঙ্কের লোভ সুবিদিত। হরেক রকম বিষয়ে সূচক প্রকাশ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে সেই নিরিখে লিগ-টেবিলে সাজায় নানান আন্তর্জাতিক সংস্থা। বছর বছর সেই সব সারণিতে দেশের ওঠাপড়া নিয়ে দিনকতক খুব হইচই হয়। উঠলে সরকারের পৌষমাস, নামলে বিরোধীদের আহ্লাদ। সরকার তখন গোসা করে সূচকটিকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়। নিন্দুকেরা আবার বলেন যে, খুদিরামকে টেক্কা দিতে চাওয়া নন্দলালের মতো লিগ সারণিতে কয়েক ধাপ ওঠার জন্য দেশের সরকার নানা রকম কৌশলও অবলম্বন করে থাকে। যেমন বিশ্ব ব্যাঙ্কের ‘ইজ় অব ডুয়িং বিজ়নেস ইন্ডেক্স’ বা ব্যবসা করার স্বাচ্ছন্দ্যের সূচকের নিরিখে এগিয়ে যেতে চটজলদি এমন কয়েকটি পদক্ষেপ করা হয়েছিল, যাতে শেষ পর্যন্ত নাকি অসুবিধাই হয়েছে ব্যবসায়ীদের একাংশের। এই সূচকটির নিরিখে এক বছরে চোদ্দোটি ধাপ এগিয়ে ২০২০ সালে ১৯০টি দেশের মধ্যে ৬৩তম স্থানে ছিল ভারত। সরকারপক্ষের মুখপাত্র যখন তা দেখিয়ে বুক বাজিয়ে বলছিলেন ‘অচ্ছে দিন’ সমাগত, তখন কি আর তিনি জানতেন যে, এক বছর পরে বেচারি নন্দলালের মতোই মন্দ কপাল দেখা দেবে তাঁদের? সূচকটির গঠন-প্রক্রিয়ায় সমস্যা আছে মেনে নিয়ে এবং কারচুপির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বিশ্ব ব্যাঙ্ক এ বছর সেটি প্রকাশই করেনি।
২০১৯ ও ২০২০ সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের নিরিখে দেশের স্থান ছিল যথাক্রমে ১০২ ও ৯৪। এ বছরের গ্লোবাল হাঙ্গার রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের স্থান ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১তম। বিরোধীরা তেড়ে উঠে জানতে চাইলেন, কেন এই পতন। বিভিন্ন সংবাদপত্র দেখাল, এ তালিকায় চিন রয়েছে প্রথম স্থানে। ভারতের আগে রয়েছে নেপাল, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান। এ দিকে সরকার এতে আমল দিতেই নারাজ। নারী ও শিশুকল্যাণ দফতর বিবৃতি দিয়ে জানাল যে, সূচকটির গঠন-প্রক্রিয়া অবৈজ্ঞানিক। ভারতের অবস্থা মোটেই এমন শোচনীয় নয়— উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সূচকটির মধ্যে এমন সব তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনটির থেকে অনেক দূরে থাকে ভারত। ভারতের প্রতি কোন সুগভীর বিদ্বেষ থেকে সূচকটির প্রকাশক দুই ইউরোপীয় সংস্থা— কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ও ওয়েল্ট হাঙ্গার হিল্ফে— এমন ষড়যন্ত্রে অবতীর্ণ হল, তা অবশ্য এখনও খোলসা করেনি ভারত সরকার।
এ-হেন বিতর্কিত সূচকটিকে এ বার একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক। চারটি নির্দেশক তথ্যের উপরে দাঁড়িয়ে আছে গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্স— মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ মানুষ অপুষ্ট; পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে ‘ওয়েস্টিং’, অর্থাৎ উচ্চতার অনুপাতে কম ওজন থাকার হার; পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে ‘স্টান্টিং’ অর্থাৎ বয়সের অনুপাতে কম উচ্চতাসম্পন্ন হওয়ার হার; এবং পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে মৃত্যুর হার। প্রথম নির্দেশকটির সঙ্গে অন্য তিনটির তফাত লক্ষণীয়। সেই তিনটি নির্দেশক যে শুধু শিশুস্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় তা-ই নয়, মাপজোখের পদ্ধতিটিও প্রথমটির ক্ষেত্রে আলাদা। শিশুদের অপুষ্টির নির্দেশকগুলি সরাসরি তাদের উচ্চতা এবং ওজন মেপে হিসাব করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে মানদণ্ডগুলি ঠিক করে দিয়েছে, তা থেকে পিছিয়ে থাকলে শিশুটির শারীরিক বৃদ্ধি যথাযথ হয়নি বলে ধরে নেওয়া হয়। সূচকে ব্যবহৃত স্টান্টিং ও ওয়েস্টিং-এর তথ্য নেওয়া হয়েছে দেশের সরকারি সমীক্ষা থেকেই। শিশুমৃত্যুর হারও এসেছে দেশের স্যাম্পেল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমের দেওয়া তথ্যসূত্র থেকে। সুতরাং এই তিনটি নির্দেশক নিয়ে সরকারের নতুন করে কিছু বলার থাকতে পারে না। শুধুমাত্র প্রথম নির্দেশকটির তথ্য দেয় রাষ্ট্রপুঞ্জের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজ়েশন (এফএও)। এই সমীক্ষায় সুস্থ ও কর্মক্ষম জীবন কাটাতে দৈনিক যত ক্যালরির প্রয়োজন, কেউ তার চেয়ে কম খেলে তাঁকে অপুষ্ট বলে চিহ্নিত করা হয়। সমীক্ষাটি যথেষ্ট বিবেচনাপ্রসূত— পুষ্টিবিদ্যায় বহুলপ্রচলিত ‘ফুড ব্যালান্স শিট’ ব্যবহার করে তৈরি। অতএব দেখা যাচ্ছে, এই চারটি তথ্যকে মিলিয়ে একটি সূচক তৈরি করার পদ্ধতি নিয়ে তাত্ত্বিক বিতর্কের অবকাশ থাকলেও, আলাদা আলাদা করে নির্দেশকগুলির কোনওটিই ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
ভারতীয়দের ডায়েটে ক্যালরির পরিমাণ কমছে, এ তথ্য নতুন নয়। আরও দুশ্চিন্তার কথা, দরিদ্রদের মধ্যেও এই হ্রাস লক্ষ করা যাচ্ছে— তাঁদের খাবারে ক্যালরির পরিমাণ আগের থেকেও কমছে। অর্থনীতিবিদেরা একে বলেন ‘হিডেন হাঙ্গার’ বা সুপ্ত ক্ষুধা। যাঁদের পেট ভরছে, তাঁরাও যথেষ্ট পরিমাণে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট পাচ্ছেন না। বিভিন্ন সমীক্ষায় ইঙ্গিত মিলেছে, করোনা-কালে এই সুপ্ত ক্ষুধার সমস্যাটি আরও বেড়েছে।
ভারতে শিশুমৃত্যুর হার অনেকটা কমলেও এখনও তা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। আবার শিশুমৃত্যুর হার কম হলেও, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে শিশুদের অপুষ্টি অত্যন্ত বেশি। দারিদ্রের হার অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও আফ্রিকার দেশগুলিতে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার অনেক কম। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-র বিভিন্ন দফার তথ্য দেখায় যে, ১৯৯০ থেকে ২০১৫-১৬ পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে স্টান্টিং কমলেও, ২০১৫-১৬ এবং ২০১৯-২০’র মধ্যে অনেক রাজ্যেই তা বেড়েছে। স্টান্টিং হল শিশুর জন্ম থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তার স্বাস্থ্যের সূচক। বর্তমানে দেশের আটত্রিশ শতাংশ শিশু স্টান্টেড। আর ওয়েস্টিং হল তার বর্তমান স্বাস্থ্যের সূচক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পনেরো শতাংশের বেশি শিশুর উচ্চতা অনুপাতে ওজন কম হলে সেটিকে মনে করতে হবে আশঙ্কাজনক জনস্বাস্থ্য সঙ্কট। ভারতে শিশুদের মধ্যে ওয়েস্টিং সেই বিপদসীমার উপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে বহু দশক ধরে। বস্তুত, গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্সের নিরিখে প্রতিবেশী দেশগুলির তুলনায় পিছিয়ে থাকাও অনেকটাই এই ওয়েস্টিং-এর কারণে।
২০০৫-০৬ সালের এনএফএইচএস রিপোর্ট প্রকাশের পর প্রবল চাপের মুখে পড়ে সংসদে দাঁড়িয়ে মনমোহন সিংহ বলেছিলেন যে, শিশুদের অপুষ্টির সমস্যা জাতির লজ্জা। আজ যখন সেই এনএফএইচএস-এর তথ্যই দেখাচ্ছে যে, শিশুদের অপুষ্টি দেশের বিভিন্ন জেলায় বেড়েছে শেষ কয়েক বছরে, তা স্বীকার করতেই এই সরকারের অহংয়ে লাগছে, কুণ্ঠাবোধ হচ্ছে। কুযুক্তির জাল বুনে বলা হচ্ছে দরিদ্রতম অংশের মধ্যেও মোটে চার শতাংশ শিশু অপুষ্ট। সরকার বলছে, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে ২০১৮ সালের আগে শিশুদের বৃদ্ধি মাপার ব্যবস্থা ছিল না, তাই তার আগে দেশের শিশুদের অপুষ্টি সম্পর্কে কিছুই নাকি বলা যায় না। কিছু অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে ওজন মাপার ব্যবস্থা ছিল না, তা ঠিক— কিন্তু বেশির ভাগ কেন্দ্রে ছিল, সেটা আরও বেশি ঠিক। তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই যে, ২০১৮ সালের আগে দেশের সমস্ত অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে সেই পরিকাঠামো ছিল না, তবুও শুধুমাত্র অঙ্গনওয়াড়ির তথ্য দিয়ে কি আদৌ দেশের শিশু অপুষ্টির হার হিসাব করা সম্ভব? সরকার কি বলতে চায় যে, বিপুল অর্থব্যয়ে এনএফএইচএস-এর মতো যে সমীক্ষাগুলি করা হয়, তার কোনও গুরুত্বই নেই?
গ্লোবাল হাঙ্গার রিপোর্টের গোড়াতেই বলা হয়েছে, এক বছরের মধ্যে কোনও দেশে অপুষ্টি বা ক্ষুধা বাড়তির দিকে না কমতির দিকে, সেই বিচার এই সূচকের নিরিখে দেশগুলির আপেক্ষিক অবস্থান দেখে করা যাবে না। এর নানা কারণের মধ্যে একটি হল, গত বছর যতগুলি দেশের মধ্যে এই র্যাঙ্কিং করা হয়েছে, এ বছরে মোট দেশের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। কোনও কোনও নির্দেশকের ক্ষেত্রে প্রতি বছর আলাদা তথ্যও পাওয়া যায় না। আবার দীর্ঘ সময়কাল ধরে অবস্থানের তুলনা করাও ঠিক নয়, কারণ সূচকটির গঠন-প্রক্রিয়ায় মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন করা হয়।
তবু ফি বছর লিগ সারণিতে দেশের ওঠা-নামা নিয়ে সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়। আর নন্দলালের মতো একবগ্গা জেদ ধরে বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ের তৈলাক্ত বংশদণ্ড বেয়ে উঠতে চাওয়া, ও মনমতো ফল না হলে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব নিয়ে আসা— সরকারের এই প্রবৃত্তি দেখে থ্রি ইডিয়টস-এর র্যাঞ্চোর মতো বলতে ইচ্ছে করে, “বেটা, কামিয়াব নেহি, কাবিল বনো।”
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy