প্রতীকী ছবি।
কোভিডের এক একটা ঢেউ আসে, আর রাষ্ট্র এমন ভান করে, যেন এটা যে হবে তা জানাই ছিল না! অথচ, টিকাকরণের পরেও যে কোভিড ছড়িয়েছে, তার সাক্ষী বহু দেশ। ইজ়রায়েলে চার ডোজ় টিকার পরেও সংক্রমণ বেড়েছে পনেরো গুণ! আয়তনে পশ্চিমবঙ্গের সমান জার্মানি, সেখানে তৃতীয় ঢেউ পেরিয়ে কোভিডের চতুর্থ প্রবাহে জানুয়ারিতে প্রতি দিন আক্রান্ত প্রায় এক লক্ষ মানুষ। আমেরিকায় দিনে দশ লক্ষ।
করোনা ভাইরাসের ক্রমাগত মিউটেশন চলছে, আসছে একের পর এক স্ট্রেন। কোনটা অধিক সংক্রামক, কোনটা বেশি নরখাদক, এ সব তথ্য অনেকটাই অজানা। তবে করোনার দুটো ঢেউ পেরিয়ে এ রাজ্যে যা জানা গিয়েছে তা হল, আমরা বাস করছি ‘সব হবে’-র দেশে। জিশুর জন্মদিনে ফুর্তি হবে, বর্ষবরণে ঢালাও নাচানাচি হবে, মেলা হবে, নির্বাচনী সমাবেশ হবে। তার পরে সংক্রমণ ছড়াবে, শুরু হবে লকডাউনে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশি কড়াকড়ি, অতঃপর পুলিশের মধ্যেও আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়বে। যাঁরা কিছু দিন আগেও বলেছিলেন, ‘ও সব আমাদের হবে না’, তাঁরাই বলতে থাকবেন, ‘ভয় নেই তো, ডাক্তারবাবু?’ যাঁদের অভয় দেওয়ার কথা, সেই ডাক্তাররা দলে দলে আক্রান্ত হবেন।
আরও কিছু কি জানা যায়নি? গত দু’টি ঢেউ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, যুদ্ধের কৌশলেও পরিবর্তন চাই। কেবল আক্রান্ত মানুষের জন্য বেড বা সেফ হোম খুলে তৃতীয় প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। সুস্থ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমবে। স্বাস্থ্যকর্মী বলতে শুধু ডাক্তার, নার্স, বা হাসপাতালের অন্য কর্মীরা নন, গ্রামের আশাকর্মী এবং পুরসভার স্বাস্থ্যকর্মীরাও। এই স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর কেবল কাজ চাপালেই হবে না, তাঁদের অভিজ্ঞতা, পরামর্শও শুনতে হবে। কারণ কোথায়, কী ভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, কারা রয়ে যাচ্ছেন টিকার বাইরে, তা তাঁদের মতো কেউ জানে না। রাজ্যে আশাকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, ও সর্বস্তরের সরকারি কর্মীদের এখন শুধু কোভিড সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ দেওয়াই যথেষ্ট নয়। কর্মক্ষেত্রে এবং পরিবারে-প্রতিবেশে কোভিড পজ়িটিভ মানুষ থাকবেন, ধরে নিয়েও কী করে স্বাভাবিক জীবন-জীবিকার সব কর্তব্য পালন করা যায়, সে বিষয়েও তাঁদের অবহিত করা চাই।
কারণ কোভিড সহজে যাবে না। বার বার মিউটেশন মানেই নতুন নতুন স্ট্রেন, সংক্রমণের ঢেউ বার বার। আগে থাকতে যুদ্ধের রূপরেখা ঠিক করা থাকলে পালে বাঘ পড়লে খাঁচাবন্দি করতে সময় লাগে কম। তাই প্রয়োজন নানা প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট কোভিড বিধি। স্কুলে এক জন পড়ুয়া পজ়িটিভ হলেই কি গোটা স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে? এক জন কর্মী আক্রান্ত হলেই স্তব্ধ হবে গোটা দফতর? এত দিনে বোঝা গিয়েছে যে, স্কুল বন্ধ রাখলে শিশুরা নিরাপদ, এই ধারণাও একটা সময়সীমার পরে আর কাজ করে না। গত দু’বছরে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের। লেখাপড়া তো বটেই, স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগও রয়েছে। মিড-ডে মিল না পেয়ে পুষ্টির মান কমছে, বাড়ছে অসুস্থতার সম্ভাবনা, সামান্য অসুখেও অতিরিক্ত তীব্রতা। গরিব শিশুদের সপ্তাহের খাদ্য-উপকরণ ঘরে পৌঁছে না দিয়ে বিধি মেনে গরম, পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা যায়। স্কুল ভবনে সুবিধা না হলে এলাকার কোনও বড় ভবনে ছাত্রছাত্রীদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে পড়াতেও সমস্যা নেই। পুরোপুরি লকডাউন পথ নয়, এই ভাবনা একশো ভাগ বাস্তবসম্মত।
সংক্রমণ সত্ত্বেও কাজ চালিয়ে যাওয়া যায়, তার একটা উদাহরণ তো চোখের সামনেই রয়েছে— হাসপাতাল। অসংখ্য ডাক্তার আক্রান্ত হচ্ছেন, তা সত্ত্বেও চিকিৎসা পরিবেষা চালু থাকছে। তার নানা কৌশল বার করা হচ্ছে। এখন যেমন স্বাস্থ্য দফতর ব্যবস্থা করেছে যে, মেডিসিন, স্ত্রীরোগ, সার্জারি ও অন্য ক্লিনিক্যাল বিভাগে সব ডাক্তার এক সঙ্গে রোগী না দেখে, ভাগ করে রোগী দেখবেন। অসুস্থতার জন্য চিকিৎসকের অভাব কমাতে ননক্লিনিক্যাল বিষয়ের ডাক্তাররাও এগিয়ে আসুন। জুনিয়রদের পাশাপাশি সিনিয়ররাও আর একটু দায়িত্ব নিন। কোভিড ও ননকোভিড ইমার্জেন্সি শুধু নয়, ফিভার ক্লিনিকে, সাধারণ আউটডোরে এই চিকিৎসকদের কাজে লাগানো হোক। প্যারামেডিক্যাল কর্মীরা টিকা দিতে, কোভিড টেস্ট করতে, চিকিৎসাতে ডাক্তারদের সাহায্য করতে পারেন অনেকটাই। টিকাকরণের দায়িত্ব নিন জনস্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞরাও।
করোনা থেকে বাঁচতে গিয়ে রুটি-রুজি বন্ধ করা চলে না, তা কি এত দিনেও জানা যায়নি? ভুললে চলবে না যে, কোভিডই একমাত্র অতিমারি নয়— লাইনে আছে ইবোলা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, আরও অনেক রোগ। যে দেশ দীর্ঘ কাল একটানা লড়াই করে গুটি বসন্ত বা পোলিয়োমুক্ত হতে পারে, ভাইরাস থেকে মুক্তির পথ সে দেশে অজানা নয়। স্বাস্থ্যের প্রাপ্য খুদকুঁড়ো, বাজেটের দু’তিন শতাংশ— তাতেও ভাগ বসিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণ হয় না। জাতীয় ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চালু করে, তাতে বাজেট বরাদ্দ করুক কেন্দ্র। দেশ জুড়ে পুণের মতো আরও অনেক ভাইরাস গবেষণা ও জিন মানচিত্র দেখার আধুনিক কেন্দ্র প্রয়োজন। বহুজাতিক ও টিকাব্যবসায়ী বৃহৎ ওষুধ কোম্পানির মৃগয়া বন্ধ করে, টিকা ও ওষুধের উৎপাদন-বিপণনকে জনমুখী করা হোক।
এই তরঙ্গটাকে পার করে দিতে পারলেই কোভিড-পর্ব সামলে দেওয়া যাবে, এই মনোভাব নিয়ে যদি কাজ করে সরকার বা নাগরিক, তা হলে বুঝতে হবে, অতিমারি থেকে আমরা কিছুই শিখিনি।
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy