আমাদের রাজনীতিপ্রিয় রাজ্যে প্রশাসন নিয়ে বেশি মানুষ চিন্তিত নন। প্রশাসনিক প্রস্তুতিতে কী কী ফাঁক ছিল? আদৌ কোনও ফাঁক ছিল কি? এ প্রশ্নে কম মানুষই আগ্রহী হবেন। — ফাইল চিত্র।
এখন যেমন উন্নয়ন, এক কালে ছিল আইনশৃঙ্খলা। তখন শৃঙ্খলা বজায় রাখাই ছিল জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রাথমিক কাজ। একশো বছর আগেও ছিল তাই। আমরা যখন চাকরিতে ঢুকি, তখনও। পুলিশ সুপারের তো বটেই, জেলাশাসকের মূল্যায়নেও আইনশৃঙ্খলা প্রাধান্য পেত। জেলার মানুষ টিউবওয়েল গুনে দেখতেন না। তাঁরা দেখতেন, সাহেব মারমুখী জনতাকে ‘ফেস’ করতে পেরেছেন, না ‘ক্যাজ়ুয়াল লিভ’-এর দরখাস্ত টেবিলে রেখে পিছনের দরজা দিয়ে কেটে পড়েছেন? এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। শহরে, শহরতলিতে ডিএমের দায়িত্ব নিয়েছেন পুলিশ কমিশনার। পুলিশের কাজ পুলিশ করুক। এটাই এখন স্বীকৃত মন্ত্র।
বিগত দশ-বিশ বছরে পুলিশের আধুনিকীকরণে খরচও কম হয়নি। এ জন্য টাকা জুগিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। আমাদের রাজ্যে বরাদ্দ ছিল বছরে ১০০ কোটি। তা ছাড়া ছিল অর্থ কমিশনের বিশেষ অনুদান। আমাদের সময়ে তিন জন মন্ত্রী বা উচ্চপদস্থ অফিসার একসঙ্গে জেলায় এলে তাঁদের পাইলট গাড়ি দিতে প্রাণান্ত হত। এখন পুলিশে গাড়ির ছড়াছড়ি। জেলা স্তরে ‘ইন্টেলিজেন্স’ গচ্ছিত ছিল এক জন ডিএসপির জিম্মায়। এখন বহু লোকজন, সৈন্যসামন্ত। ফোনে আড়িপাতার সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি। তা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার কাজ সহজ হয়নি। কারণ, দুষ্কৃতীদের হাতে এখন স্মার্ট ফোন। গুজব ছড়ানো, লোক জড়ো করা, গোলমাল বাধানোর প্রযুক্তিও উন্নত। তা ছাড়া আমাদের রাজ্যে রাজনৈতিক জটিলতাও বেড়েছে। সমাজের একাংশে এখন ‘সাম্প্রদায়িক অশান্তি’ উত্তরণের পথ হিসাবে বিবেচিত।
বছর পাঁচেক হল এ রাজ্যে রামনবমীর মিছিল বেরোচ্ছে। পৃষ্ঠপোষক ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ’ এবং তার বিভিন্ন শাখা সংগঠন। যারা মিছিলে হাঁটেন, তাঁদের হাতে থাকে বাঁশ, লাঠি বা খোলা তরোয়াল। সঙ্গে থাকে আরও শক্তিশালী ডিজে। কোন পুলিশ আটকাবে এই অশ্বমেধ যজ্ঞ? তাই ছোট-বড় ঝামেলা হয়। এ বছর একটু বেশিই হল। শিবপুরের কাজিপাড়ায় আগের বছরেও অশান্তি হয়েছিল। এ বছরেও এলাকা উত্তপ্ত হল। জ্বালানো হল রাস্তার ধারে দাঁড় করানো কিছু গাড়ি। কিছু দোকান পোড়ানো হল। কিছু লোক আহত হলেন। পুলিশের সমালোচনা হল। প্রশ্ন উঠল, যেখানে আগের বছর অশান্তি হয়েছে, সেখানে মিছিলের অনুমতি দেওয়া হল কেন?
পুলিশ বলল, কে অনুমতি দিয়েছে? আমাদের অনুমতির শর্ত ওরা মানেনি। তা ছাড়া ওরা মিছিলের রুট বদলেছে। অনুমোদিত পথ দিয়ে যায়নি। মিছিলে লোক এত বেশি ছিল যে, ‘কন্ট্রোল’ করা যায়নি। হাই কোর্টে রাজ্য সরকারের তরফে এ-ও বলা হয়েছে যে, অনুমতি দেওয়া হয়েছিল শান্তিপূর্ণ মিছিলের। হিংসাত্মক ঘটনা ঘটায় এফআইআর হয়েছে। ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। অভিযুক্তেরা গ্রেফতার হয়েছেন। কিছু এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছে। এ জন্য কিছু নম্বর তো দিতেই হবে প্রশাসনকে। হাতের লেখা আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় যেমন নম্বর দেওয়া হয়। দু’দিন পরে রিষড়ায় দেখা গেল আক্রমণ। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে রাজ্যপাল দার্জিলিং থেকে বিবৃতি দিলেন প্রশাসনকে চাঙ্গা করতে। তাঁর সফর সমাপ্ত করে আগেই ফিরে এলেন কলকাতায়।
আগাম খবর না থাকলে এ ধরনের পরিস্থিতি সামলানো যায় না। আগাম খবর কি ছিল না? হাওড়ার ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতি থেকে পরিষ্কার, এই প্রশ্নগুলি যে উঠছে, তা তিনি জানেন। কিছু ক্ষেত্রে পুলিশের কথা তিনি মেনে নিয়েছেন— ‘অত লোকের মধ্যে গুলি চালালে কারও মাথায় লেগে যেত’। খাঁটি কথা। কিন্তু পুলিশকে ‘ক্লিনচিট’ দিতে তিনি রাজি নন। ‘গাফিলতি ছিল’। ‘ভয় পেয়ে গিয়েছিল’। ‘পদক্ষেপ করা হবে’। ‘রেয়াত করা হবে না’। সে এক যুগ ছিল যখন অফিসারদের দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে মন্ত্রী পদত্যাগ করতেন। এখন মন্ত্রী প্রকাশ্যে আমলাদের ভুল ধরিয়ে দেন। তা-ও প্রশ্ন ওঠে, সরকার কি যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রস্তুত ছিল না? মিছিলের আগের দিন কেন আমরা মুখ্যমন্ত্রীকে দেখলাম না জেলা অফিসারদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে? ধর্নার কর্মসূচি কি কয়েক দিন পরে নেওয়া যেত না?
রাজ্যপালকে অবশ্য দেখা গেল ‘সক্রিয়’ ভূমিকায়। তিনি রাজভবনে বিশেষ সেল চালু করলেন পরিস্থিতির উপর নজর রাখার জন্য। দার্জিলিঙে গিয়েছিলেন জি-২০ মিটিংয়ে। রিষড়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিলেন সেখান থেকে। সফর কাটছাঁট করে দ্রুত ফিরে এলেন কলকাতায়। হনুমান জয়ন্তীর দিন শ্রীভূমির হনুমান মন্দিরে পুজো দিলেন। তার পর একবালপুরে গিয়ে সংখ্যালঘু বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বললেন। তার পরে পোস্তায় গিয়ে ছাতুর সরবত খেলেন। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়, বাংলার কোনও রাজ্যপাল আগে এতটা করেননি। স্বরাষ্ট্র সচিবকে রাজভবনে ডেকে একটা রিপোর্ট নেওয়া— ব্যস। তার বেশি কেউ দরকার মনে করেননি। অথচ দেখলাম, অন্তত এই বিষয়ে রাজ্যপালের নামে অতি-সক্রিয়তার অভিযোগ উঠল না।
উচ্চ আদালতও ছিল যথেষ্ট সক্রিয়। রামনবমীর অভিজ্ঞতার পরে আদালত ঝুঁকি নিতে চায়নি। নিশ্চিত করতে চেয়েছে যে, হনুমান জয়ন্তীতে একই ভুল না হয়। আদালতের নির্দেশে ‘স্পর্শকাতর’ এলাকায় সিআরপিএফ মোতায়েন করা হয়েছে। হনুমান জয়ন্তী পালিত হয়েছে নির্বিঘ্নে। হাই কোর্ট উৎসবে নিরাপত্তা দেবে, নির্বাচনে দেবে না, তা-ও কি হয়? আমরা আশা করব, পঞ্চায়েত নির্বাচনে উচ্চ আদালত দর্শক হয়ে থাকবে না। গত নির্বাচনে কী হয়েছিল তা আমাদের মনে আছে। তার পুনরাবৃত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
আমাদের রাজনীতিপ্রিয় রাজ্যে প্রশাসন নিয়ে বেশি মানুষ চিন্তিত নন। প্রশাসনিক প্রস্তুতিতে কী কী ফাঁক ছিল? আদৌ কোনও ফাঁক ছিল কি? এ প্রশ্নে কম মানুষই আগ্রহী হবেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে কি শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে? তা-ও বড় প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল, এই ঘটনায় লাভবান হল কোন পক্ষ? সাগরদিঘির পরাজয়ের পরে তৃণমূল বিশেষ জোর দিচ্ছিল মুসলিম ভোটারদের এককাট্টা করতে। রামনবমীর ঘটনায় সেই প্রয়াস কি উৎসাহিত হল? না বাধাপ্রাপ্ত? মিছিলের আগের দিন ধর্নায় বসা কি উচিত হয়েছে? না কি ভুল হয়েছে? তাই কি তড়িঘড়ি পুলিশের ঘাড়ে দোষ চাপাতে হল? তা কি করা হল এই বার্তা দিতে যে, ‘প্রোটেকশন’ দেওয়াই মুখ্যমন্ত্রীর একমাত্র কাজ নয়। তাঁর আরও কাজ আছে?
বাংলার মানুষ এ সব প্রশ্নের সমাধান চাইবেন কি না জানি না। কিন্তু প্রশাসক হিসেবে আমার কাছে এ প্রশ্নের গুরুত্ব অপরিসীম।
(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy