সম্প্রতি গুজরাতের ছ’শো মৎস্যজীবী স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি চেয়েছেন গুজরাত হাই কোর্টের কাছে। এই মৎস্যজীবীরা ধর্মে মুসলমান। তাঁদের অভিযোগ, তাঁদের উপর যে সব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে, তাতে তাঁরা জীবিকা হারাচ্ছেন। তিলে তিলে মরার চাইতে নিষ্কৃতি-মৃত্যুর অনুমোদন দিক রাষ্ট্র। এই ঘটনাটি সংবাদে এসেছে, কারণ কঠিন রোগে আক্রান্তরা নিষ্কৃতি-মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করলেও, জীবিকা হারিয়ে এতগুলি মানুষের মৃত্যুর আবেদন করছেন, এমন দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই।
এই মুসলমান মৎস্যজীবীরা বংশপরম্পরায় মাছ ধরে আসছেন গুজরাতের নদী ও জলাভূমিতে। মোক্কার সাগর ও গোসাবারা বাঁধের জলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বাঁধের জলে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসত বলে সেখানে মাছ ধরায় স্থানীয় প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। প্রথম দিকে মৎস্যজীবীরা বিকল্প পেশার খোঁজ করেন। কিন্তু আর কোনও কাজের অভিজ্ঞতা নেই, দিনমজুরিও তাঁদের পছন্দ নয়— তাই সমুদ্রে মাছ ধরাই এখন তাঁদের সামনে একমাত্র পথ। তাঁদের ছিল ছোট জাল আর হোডি (ছোট নৌকা)। কিন্তু সমুদ্রে মাছ ধরতে চাই ট্রলার, বড় জাল। ঋণ চাইলে ব্যাঙ্ক দেয় না। চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে কেনা বড় নৌকা এবং জাল পোরবন্দর এলাকায় রাখতে দেয় না স্থানীয় খারুয়া সম্প্রদায়ের হিন্দুরা। কাজেই পোরবন্দর থেকে আট কিলোমিটার দূরে নভি বন্দরে (সরকারি বন্দরে) জাল ও নৌকা রাখার ব্যবস্থা করলেন তাঁরা। অভিযোগ, সেখানেও খারুয়া মৎস্যজীবীরা নানা ভাবে সমস্যার সৃষ্টি করেছে। মুসলমান মৎস্যজীবীদের মাছ বিক্রির জন্য বন্দর এলাকাতে বসতে দেওয়া হচ্ছে না। বহু বার জানানোর পরেও স্থানীয় প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা করেনি। রাজনৈতিক নেতারাও জাতপাত-নির্ভর হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক হাতছাড়া করতে চান না।
কাজেই মুসলমান মৎস্যজীবীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। আত্মহত্যার অনুমোদন চেয়ে তাঁদের এই চরম সঙ্কটের দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন তাঁরা। তাঁদের আক্ষেপ, বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় মুসলমানদের সাহায্য নিচ্ছে গ্রামের হিন্দুরা। বাধা দিচ্ছে জীবিকা অর্জনের বেলা। দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় রাজনীতির ছত্রছায়াতে এসে খারুর সম্প্রদায়ের মৎস্যজীবী নেতারা সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বকে আরও উস্কে দিচ্ছেন, বাড়ছে রাজনৈতিক নিপীড়ন।
গুজরাতের ঘটনা ব্যতিক্রমী নয়। তামিলনাড়ুতেও জাতপাতের লড়াই রয়েছে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের মধ্যে। কাট্টুমারাম ও পট্টনাভর, মৎস্যজীবী দুই গোষ্ঠীর মধ্যে জাতপাতের লড়াই প্রবল রয়েছে। এঁরা একে অন্যকে সঙ্গে নিয়ে মাছ ধরেন না। তামিলনাড়ুর উপকূল জুড়ে থাকা ২২৯টি মৎস্যজীবী গ্রামের প্রতিটিই জাত-নির্ভর। প্রতিটি গ্রামের ছোট মৎস্যজীবীরা আপন আপন এলাকাতে মাছ ধরেন, এক সঙ্গে মাছ ধরতে যান না। আবার বাংলার মাটিতেও ‘মালো’ ও ‘ঝালো মালো’— এই দুই জনগোষ্ঠীর মানুষদের মূল পেশা মাছ শিকার হলেও, তাঁদের মধ্যে জলও চলে না, এক সঙ্গে মাছ ধরতে যাওয়া তো দূরের কথা। মুসলমানদের মধ্যে ‘নিকেরি’ বলে একটি সম্প্রদায় ছিল, যার সদস্যরা মাছ ধরা পেশাতেই যুক্ত ছিলেন। কিন্তু নদী, খালবিলে উঁচু জাতের মৎস্যজীবীরা মাছ ধরে যাওয়ার পরেই জলে নামতে পারতেন নিকেরিরা।
এমন বহু বিভাজন রয়েছে আজও। অথচ, ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের জীবিকা অর্জনে মৌলিক অনেক সমস্যা প্রবল হয়ে উঠছে। উন্নয়নের নামে সমুদ্র উপকূলের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে। নদীর গতিপথ রোধ করে উঠছে নতুন নির্মাণ। উচ্ছেদ হচ্ছেন প্রান্তিক মৎস্যজীবীরা। নদী-জলাশয়ের জলও দূষণে আক্রান্ত। দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে দেশজ মাছ। নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে জলাভূমি ভরাট হচ্ছে, জীবিকা হারাচ্ছেন ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী। ট্রলারে গভীর সমুদ্রে লাগামহীন মাছ ধরা চলছে, কমছে মাছের প্রজাতি।
সেই সঙ্গে মৎস্যজীবীদের হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রতট ব্যবহারের অধিকার। হোটেল, রিসর্ট এবং অন্যান্য নির্মাণ সমুদ্রতট দখল করে নিচ্ছে। উপকূল এলাকায় বা তার কাছাকাছি মাছ বিক্রির জন্য ভাল বাজারের পরিকাঠামো তৈরি নেই। অথচ, উপযুক্ত ভাবে মাছ সংরক্ষণ করা ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের নাগালের বাইরে। বরফকল থেকে পাওয়া বরফের দাম বাড়ছে, তাই অল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করা ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা সংরক্ষণের খরচ কুলোতে পারছেন না। বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে বার বার সাইক্লোনের ধাক্কায় উপকূলের মৎস্যজীবীদের জীবন বিধ্বস্ত। ক্ষতি হচ্ছে জাল ও নৌকার, জীবনহানিও হচ্ছে। ছোট মৎস্যজীবীদের জীবন ও জীবিকার কোনও সুরক্ষা নেই। এই পরিস্থিতিতে জাতপাতের লড়াই সামনে এলে জীবিকার লড়াই সরে যাচ্ছে আরও দূরে। জাত-সম্প্রদায় অতিক্রম করে জীবিকার প্রশ্নে এক না হতে পারলে অনেক মৎস্যজীবীকে দিনমজুরির মতো পেশায় সরে যেতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy