এক গ্রামের স্কুলে পড়াতে গিয়ে প্রথম দিনই প্রেয়ার লাইনে খুব হাসাহাসি শুনলাম। এক শিক্ষার্থী ছাত্রদের লাইনে দাঁড়াবে, না ছাত্রীদের— সেই নিয়ে সমস্যা। শিক্ষার্থীর চুল খুব ছোট করে ছাঁটা, শরীরে পেশিশক্তির কিঞ্চিৎ বাহুল্য। ছাত্র নয়, সে ছাত্রীই। ফুটবল খেলে এবং খেলা শেখে। তাই অমন ব্যঙ্গ তাকে নিয়ে। ভারতের মহিলা ফুটবল তথা মেয়েদের খেলার জগতের দৈন্যদশার পিছনে ওই উপহাসের একটা বিরাট ভূমিকা আছে বলে মনে হয়। আজ আমরা মেরি কম, মীরাবাই চানু, পি ভি সিন্ধু, লাভলিনা বরগোহাঁই প্রমুখকে নিয়ে সোশ্যাল সাইট ভরিয়ে ফেলছি। নেতা, মন্ত্রীদের অভিনন্দন বার্তা উপচে পড়ছে। কিন্তু তাতে একটি সাফল্যের পিছনে থাকা দশটি ব্যর্থতা, হাজারও অপমান এবং লাঞ্ছনার ইতিহাস ঢাকা পড়ে না। অলিম্পিক্স বা সমপর্যায়ের প্রতিযোগিতায় গলায় মেডেল না ঝোলাতে পারলে ভারত ক্রিকেটার ভিন্ন অন্য খেলোয়াড়কে চিনতে পারে না। আর মহিলা খেলোয়াড়দের সেই বঞ্চনা, অব্যবস্থা, দারিদ্র, রাজনীতি ইত্যাদির সঙ্গে দু’টি অতিরিক্ত বাধাও অতিক্রম করতে হয়— পুরুষতন্ত্র এবং সামন্ততন্ত্রের বাধা।
হিমা দাস জীবনের অন্যতম সেরা সাফল্য দ্বারা দেশকে গর্বিত করার পর অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার এক টুইটে বলা হয়েছিল— তিনি ভাল ইংরেজি বলতে পারেন না। ট্র্যাকে তাঁর কৃতিত্বের চেয়ে ‘বাইট’ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর স্কিল প্রাধান্য পেয়েছিল। কারণ, ‘মেয়েদের খেলা’ আমাদের দেশে কখনওই পুরুষের খেলার মতো ‘সিরিয়াস ব্যাপার’ হয়ে উঠতে পারেনি। হিমা দাস যখন একটি ঠিকঠাক স্পোর্টস শু-র অভাবে জাতীয় স্তরেও সুবিধা করতে পারছিলেন না, তখন এই ‘ইংরেজি’ বিশেষজ্ঞরা বাতানুকূল ঘরে খেলা নিয়ে সেমিনার শুনছিলেন। আর ‘কোনি’র ক্ষিদ্দার মতো কোনও খেলাপাগল ‘সাধক’ ছাত্রীর পাতে দু’টি ডিম তুলে দেওয়ার জন্য মরিয়া লড়ছিলেন। গবেষণা বলছে, মহিলা খেলোয়াড়দের ৬-৪৫ শতাংশই উপযুক্ত খাদ্য পান না (পুরুষের ক্ষেত্রে ০-১৯ শতাংশ)। সমাজকর্মী শর্মিলা চানু মীরাবাই-এর সাফল্যকে শাবাশি দিয়েও বলেছেন, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে এত দারিদ্র যে, শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে মেয়েরা শারীরিক শ্রমের দিকে ঝোঁকেন এবং অনেকে খেলাধুলায় চলে আসেন।
আমাদের দেশে মেয়েদের জীবনকাহিনি লিখতে হলে ভূমিকা শুরু হবে ‘কন্যাভ্রূণ হত্যা’ দিয়ে। তার পর উপসংহার পর্যন্ত একে একে আসবে বঞ্চনা, অপুষ্টি, অত্যাচার, ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, গার্হস্থ হিংসা, খুন ইত্যাদি (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে)। ‘মেয়েজন্ম’ ঘরের কাজ, সংসার করা, স্ত্রী ও মা হওয়ার জন্য। সেই মেয়ে খেলোয়াড় হবে, এই কটু বাস্তব সামাজিক খুল্লতাতদের বটতলার খাপে ঠিক খাপ হয়ে বসে না। নির্দিষ্ট খেলার জন্য উপযুক্ত পোশাক পরতে পর্যন্ত তাঁরা মেয়েদের অনুমতি দেন না। এক ক্রীড়া শিক্ষিকা বান্ধবীর কাছে শুনছিলাম, কেমন করে তাঁর ছাত্রী কেবল পোশাকবিধির জন্য রাজ্য স্তরে যাওয়ার সুযোগ হারিয়েছে। আর যদি বা মেয়ের খেলার আগ্রহকে মেনেও নেওয়া যায়, তার প্রশিক্ষণ, প্রস্তুতির উপযুক্ত সরঞ্জাম, পুষ্টিকর পথ্য— এ সব আসবে কোথা থেকে? ট্রেনিং বা প্রতিযোগিতার জন্য দূরে যেতে হলে স্পনসর মিলবে? নিরাপত্তার খাতিরে সঙ্গে যাবেন কে? অর্থের জোগান কে দেবেন? খেলায় সফল হলেই কি মেয়েরা আর্থিক ভাবে নিরাপদ হবেন? সেখানেও সেই পুরুষতন্ত্র। ভারত একমাত্র যে খেলাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে, তা ক্রিকেট। সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলা পুরুষ ক্রিকেটার বছরে যা উপার্জন করেন, তাঁর মহিলা সহযাত্রী সেই আয়ের অনেকটাই কম পান (অন্য খেলা ছেড়েই দিলাম)। কাজেই দিনের শেষে কেরিয়ারের চিন্তা দূরে ঠেলে মহিলা ক্রীড়াবিদ মরিয়া হন রেল বা অন্য কোথাও একটি চাকরি জোটানোর জন্য।
মেয়েদের খেলার ক্ষেত্রে ‘নিরাপত্তা’ একটি বড় ব্যাপার। ২০১০ সালে ভারতের মহিলা হকি দলের ৩১ জন সদস্য একত্রে কোচ এম কে কৌশিকের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনেন। ভয়ে বা লজ্জায় এমন অনেক অভিযোগই উচ্চারিত হয় না। বৈষম্য এবং অব্যবস্থা মেয়েদের নিরাপত্তা এবং সাফল্যকে বার বার আঘাত করে। যেমন, ২০১৬ সালে ‘সাউথ এশিয়ান ফেডারেশন গেমস’-এর সময় ভারতের পুরুষ রিলে দলকে যেখানে স্টেডিয়ামের কাছেই আরামদায়ক হোটেল দেওয়া হয়েছিল, মেয়েদের পাঠানো হয়েছিল কুড়ি কিলোমিটার দূরে অসুবিধাজনক জায়গায়। মহিলাদের কিছু বিশেষ মানসিক এবং শারীরিক প্রশিক্ষণ ও চর্চা প্রয়োজন হয়। তেমন প্রশিক্ষক এবং মনোবিদ ক’জনের জোটে? ‘পিরিয়ড’ ব্যাপারটিকে বৈজ্ঞানিক ভাবে মোকাবিলা করার শিক্ষা না থাকায় বহু মেয়ের খেলোয়াড় জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর সঙ্গে সেই অভিভাবক দল রয়েছেন, যাঁরা মেয়ে খেলোয়াড়কে ‘গৃহবধূ’ বানাতে সদাব্যস্ত। বিয়ের পর অবধারিত ভাবে চাই সন্তান। খেলা তখন ছেলেখেলায় পরিণত হয়। মেরি কম আর কত জন হতে পারেন? প্রচণ্ড মানসিক বল না থাকলে মহিলা হয়ে খেলার জগতে বেশি দিন থাকা প্রায় অসম্ভব।
মহিলা খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে তাই ‘মেডেল’ খুব অর্থবহ একটি ব্যাপার। মেডেলই মূলত মেয়েদের কথা মানুষকে জানায়। মিডিয়ায় মহিলাদের খেলা বা খেলোয়াড়দের জন্য পুরুষের প্রাপ্য সময়ের এক-চতুর্থাংশও বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া ধার্য হয় না। ‘অর্জুন’ তালিকায় যদি বা রমণীর প্রবেশ ঘটে, ‘দ্রোণাচার্য’তে এখনও গান্ধারীরা আণুবীক্ষণিক। শিশুবয়সেই বেছে নিয়ে মহিলা খেলোয়াড় তৈরি করার কথা এ দেশে রূপকথার চেয়েও অসম্ভব। প্রায় প্রত্যেক গার্লস স্কুলেই ‘খেলার দিদিমণি’ থাকেন। ক’টি স্কুলে মেয়েদের নিয়মিত মাঠে নামানো হয়? অন্য বিষয়ের সমান গুরুত্ব দিয়ে খেলাকেও দেখা হয়? গ্রামের বা পাড়ার মেয়েকে ‘খেলা’য় উৎসাহ দেওয়ার জন্য মেয়েদের ক্লাব কোথায় আছে? মেয়েদের খেলার মাঠই বা ক’টা আছে? অধিকাংশ ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানে মহিলা পরিচালকই নেই। এমনকি দেশের জনসংখ্যায় প্রায় অর্ধেক হওয়া সত্ত্বেও ‘ইন্ডিয়ান স্পোর্টস ফেডারেশন’-এর বোর্ড মেম্বারদের মধ্যে দশ শতাংশও মহিলা নেই।
‘সিন্ধু বিজয়’-এর খবর শুনে অভিনন্দনের আতিশয্যে ভেসে যাওয়া ভাল। সেই সঙ্গে নারী খেলোয়াড়কে সুযোগ ও সম্মান দেওয়ার দাবিও উঠতে থাকুক। কোনি আর ক্ষিদ্দা— দু’জনের বুকের উপরই দাঁড়িয়ে রয়েছে ভারতের ভিকট্রি স্ট্যান্ড। সে বুকে সমমর্মিতার বল চাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy