Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
প্রায়-নিশ্চিত ক্ষতির মুখে দাঁড়িয়ে মানুষ ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নেয় কেন
Investing in Share market

অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটে

ফোনে ডিম্যাট অ্যাকাউন্টের অ্যাপ বন্ধ করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শিশির। তপেশের বহু সাধ্যসাধনায় শেয়ার বাজারে টাকা খাটাতে আরম্ভ করেছিল সে, তার পর চুম্বকের মতো আটকে গিয়েছে।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:৪২
Share: Save:

আরে, এই এক বিমা নিগমের শেয়ার আমায় পথে বসিয়ে দিল। আইপিও-তে কিনেছিলাম, গত বছর মে মাসে। তার পর থেকে শুধুই লোকসান।” ফোনে ডিম্যাট অ্যাকাউন্টের অ্যাপ বন্ধ করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শিশির। তপেশের বহু সাধ্যসাধনায় শেয়ার বাজারে টাকা খাটাতে আরম্ভ করেছিল সে, তার পর চুম্বকের মতো আটকে গিয়েছে।

“যাহ! তা কী করবি, ছেড়ে দিবি না কি শেয়ারগুলো?” তপেশ প্রশ্ন করে।

“ছাড়ব, কিন্তু যে টাকাটা লাগালাম, সেটা অন্তত উঠে আসুক। এখন বেচে দিলে তো আর এই লসটা কভার হবে না,” যে সুরে উত্তর দিল শিশির, তাতে বোঝা গেল, ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে ও।

“এই চক্করে পড়েই লোকে বছরের পর বছর খারাপ চাকরি করে গেল, ডিসফাংশনাল বিয়েও ভেঙে বেরোতে পারল না,” সিগারেটের টুকরোটা অ্যাশট্রেতে ফেলে মন্তব্য করলেন শিবুদা। তিনি যে আদৌ ওদের কথা শুনছিলেন, সেটাই বোঝা যায়নি এত ক্ষণ। “ধর, লোকসান-টোকসান করেও তোর বিমা-র শেয়ারে লাখখানেক টাকা পড়ে আছে,” শিশিরকে উদ্দেশ করে বললেন শিবুদা, “এমনিতে যদি আজ তোকে এক লাখ টাকা লগ্নি করতে হয়, তুই কি এই বিমা কোম্পানির শেয়ারে করবি? আমার ধারণা, করবি না— তার চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক স্টক আছে টাকা লাগানোর জন্য। তা হলে, বিমা-র শেয়ারগুলো বেচে সেই টাকাটা অন্য, লাভজনক, শেয়ারে লাগাচ্ছিস না কেন?”

“দুটো কি এক কথা হল, শিবুদা? ওটায় যে এক লাখ টাকা আছে, তাতে তো তেত্রিশ হাজার টাকা লোকসানও আছে,” কাতর গলায় উত্তর দেয় শিশির।

“দ্যাখ, শেয়ার বাজার সম্বন্ধে আমার জ্ঞানগম্যি পাতে দেওয়ার মতো নয়— কোন স্টকটা রাখবি আর কোনটা বেচবি, সে পরামর্শ আমার থেকে নিস না,” ডিসক্লেমার দেন শিবুদা। “অবিশ্যি, তুই যে প্যাঁচটায় পড়েছিস, ওটা শেয়ার বাজারের নিজস্ব নয়। এর নাম সাঙ্ক কস্ট ফ্যালাসি— সুধীন দত্ত হয়তো বলতেন, ‘ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে? মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া।’— কোনও একটা সিদ্ধান্ত ভুল হলে, সেই ভুল স্বীকার না করে তার পিছনে আরও টাকা, আরও সময়, আরও চেষ্টা ব্যয় করে খেলাটাকে ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রয়াস। বিমা নিগমের আইপিও-তে টাকা লাগানো তোর ভুল হয়েছিল। তুই এখনও সেই ভুলটাকে আঁকড়ে ধরে আছিস, যদি তা এক দিন ঠিক হয়ে যায়, সেই আশায়।”

উত্তর দেওয়ার জন্য মুখ খুলছিল শিশির, শিবুদা হাত তুলে ওকে থামালেন। “তুই একা নোস, আমরা সবাই হরহামেশা এই কাজ করে চলেছি। যুক্তি দিয়ে যদি ভাবিস, তা হলে দেখবি, টাকার কোনও অতীত নেই— আগের শেয়ারে লোকসান করে তোর হাতে এক লাখ টাকা থাকলেও তার যা অর্থমূল্য, আগের শেয়ারে লাভ করে হাতে লাখ টাকা থাকলেও তাই। এই মুহূর্তে তোর একটাই কাজ হওয়া উচিত, সবচেয়ে বেশি লাভ হতে পারে, এমন একটা শেয়ারে এই টাকাটা লগ্নি করে দেওয়া। তুই পারছিস না, তার কারণ তুই এই লোকসানটাকে মানতে পারছিস না। এটুকু লোকসান মেনে টাকাটা অন্য কোথাও লগ্নি করলে এক বছর পরে হয়তো তোর অনেক বেশি লাভ হবে— তা সত্ত্বেও কাজটা করছিস না কেন?”

শিশির চুপ। সূর্য মন দিয়ে শুনছিল এত ক্ষণ, এ বার বলল, “উত্তরটা তো আপনি বলেই দিয়েছেন— সাঙ্ক কস্ট ফ্যালাসি। আর একটু বড় করে দেখলে, মেন্টাল অ্যাকাউন্টিং। রিচার্ড থেলারের গোড়ার দিকের কাজ, আপনিই এক বার পড়িয়েছিলেন আর্টিকলটা।”

“পারফেক্ট!” সূর্যর দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকান শিবুদা। “মেন্টাল অ্যাকাউন্টিং। আমাদের মাথার মধ্যে আসলে অনেকগুলো খোপ আছে— এক-একটা জিনিসের জন্য এক-একটা খোপ। দিনের শেষে আমরা প্রতিটা খোপের হিসাব মিলিয়ে দেখি, লাভ হল, না কি ক্ষতি। এই যে শেয়ারে লগ্নি, এগুলোরও কিন্তু আছে— প্রতিটা শেয়ারের জন্য একটা করে খাপ। আমরা পুরো পোর্টফোলিয়ো দেখার বদলে প্রত্যেকটা শেয়ারের লাভ-ক্ষতি আলাদা করে দেখি। যে-হেতু আমরা ক্ষতি অপছন্দ করি— বস্তুত, লাভ যতখানি পছন্দ করি, তার সমান পরিমাণ ক্ষতি অপছন্দ করি মোটামুটি তার দ্বিগুণ— ফলে, ক্ষতিতে চলছে, এমন খাপ আমাদের অস্বস্তিতে রাখে। ক্ষতি মেনে নিয়ে সেই খাপ বন্ধ করে দিলে সেই ক্ষতি মোছার আর কোনও উপায় থাকে না। আমরা এটা মানতে পারি না। এটা জেনেও না যে, এই লোকসানের অঙ্কটুকুর জন্য ক্যাপিটাল গেন ট্যাক্সে ছাড় পাওয়া যাবে; এটা জেনেও না যে, ক্ষতির পরিমাণ আর বাড়তে না দিয়ে সেই টাকা অন্য খাতে সরিয়ে নিলে সেখানে হয়তো লাভ হবে।”

গোপাল চা দিয়ে গিয়েছে। কথা থামিয়ে কাপে চুমুক দেন শিবুদা। তার পর শিশিরের প্যাকেটটা টেনে নিয়ে একটা সিগারেট ধরান। ধূমপানের কু-অভ্যাস ছাড়বেন বলে সঙ্গে প্যাকেট রাখা বন্ধ করেছিলেন বছর তিনেক আগে, তার পর থেকে শিশিরের প্যাকেটের ভরসাতেই চলছে। গোটাতিনেক রিং ছেড়ে তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতেই শিবুদা ফের কথার সূত্র ধরে নিলেন, “ড্যানিয়েল কানেম্যান এই মেন্টাল অ্যাকাউন্টিংয়ের গল্পটাকে ফ্রেমে বসিয়েছেন। আক্ষরিক অর্থেই। তিনি ব্রড ফ্রেম আর ন্যারো ফ্রেমের কথা বলেছেন। ন্যারো ফ্রেম মানে, প্রত্যেকটা খোপকে আলাদা আলাদা করে দেখা; আর ব্রড ফ্রেম মানে, পুরো ছবিটাকে দেখা। কানেম্যান বলছেন, আমরা প্রতিটা খাপে লাভে থাকতে এমনই ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে, গোটা ছবিটা দেখেই উঠতে পারি না। এবং, তাতে বিস্তর ক্ষতি হয়, হরহামেশা। যদি ব্রড ফ্রেমে ভাবতে পারি, যেমন ধর শেয়ারের ক্ষেত্রেই যদি প্রতিটা স্টককে আলাদা খোপে না দেখে একটা ধারাবাহিক খেলার এক-একটা চাল বলে ভাবতে পারি— যেখানে এক দান হারলেও পরের দানে জেতার সুযোগ আছে— তা হলে একটা স্টকে লোকসান হলেও ততখানি আফসোস হত না। কিন্তু, ন্যারো ফ্রেমে দেখলে— এই বিমা নিগমের স্টকটুকুকে একটা বিচ্ছিন্ন খাপ হিসাবে দেখলে— তার লোকসান মেনে নেওয়া অনেক কঠিন। আর সেই কারণেই আমরা আরও ভুল সিদ্ধান্ত করতে থাকি।

“ক্ষতির সম্ভাবনা আমাদের মনকে কী ভাবে পাল্টে দেয়, নিজেকে প্রশ্ন করলেই উত্তর পাবি। ধর, এমন একটা অবস্থা তৈরি হল, যেখানে ৯৫% সম্ভাবনা যে, তোর পুরো দশ লক্ষ টাকা ক্ষতি হবে। কিন্তু, তার আগে তোকে একটা সুযোগ দেওয়া হল, চাইলে তুই ন’লক্ষ টাকা ক্ষতি স্বীকার করে এক লাখ টাকা বাঁচাতে পারবি। এখানে বুদ্ধিমানের কাজ হল দ্বিতীয় পথে হাঁটা, কারণ প্রথম পথে তোর সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ সাড়ে ন’লক্ষ টাকা— মোট টাকার অঙ্ককে ক্ষতির প্রবাবিলিটি দিয়ে গুণ করলে যেটা পাওয়া যায়, সেটাই এক্সপেক্টেড লস বা সম্ভাব্য ক্ষতি। কিন্তু বেশির ভাগ লোককে এই জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিলে তারা ঝুঁকি নিতে চাইবে। পুরো টাকাটা বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা করবে। এবং, কুড়ি বারের মধ্যে উনিশ বারই পুরো টাকাটা খোয়াবে। উল্টো দিকে, কাউকে যদি বলিস যে, হয় সে নিশ্চিত ভাবে এক লক্ষ টাকা পেতে পারে, অথবা একটা লটারিতে যেতে পারে, যেখানে ৯৫% সম্ভাবনা, সে এক লাখ কুড়ি হাজার টাকা পাবে, অর্থাৎ প্রতি কুড়ি বারে উনিশ বার, আর পাঁচ শতাংশ সম্ভাবনা যে কিছুই পাবে না— ভেবে দেখ, কেউ কি সেই লটারি চাইবে? সবাই নিশ্চিত এক লাখ টাকা নেবে, যদিও এ ক্ষেত্রের তার সম্ভাব্য প্রাপ্তির পরিমাণ ১,১৪,০০০ টাকা।

“মাথা যদি গুলিয়ে না যায়, তা হলে পুরোটা এক বার ভাব,” শিবুদা দম নেওয়ার জন্য একটু থামলেন, “দু’ক্ষেত্রেই নিশ্চিত প্রাপ্তি ছিল এক লক্ষ টাকা— ন’লাখ টাকা ক্ষতির পরে পড়ে থাকা এক লাখ টাকার যা মূল্য, পড়ে পাওয়া এক লাখ টাকার মূল্য তার থেকে কানাকড়িও কম-বেশি নয়। প্রথম ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিলে প্রাপ্তির পরিমাণ কমছিল, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বাড়ছিল। দু’ক্ষেত্রেই ঝুঁকির পরিমাণ সমান। একই লোক প্রথম ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিল, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিল না। কেন জানিস? কারণ দশ লক্ষ টাকার ক্ষতির সম্ভাবনা তাকে এমনই বিচলিত করল যে, সে সবটুকু দিয়ে সেই ক্ষতি ঠেকানোর চেষ্টা করল। এটা কোনও এক জনের কথা নয়, আমাদের সবার কথা। অনেকখানি খোয়ানোর সম্ভাবনা তৈরি হলে আমরা সবটুকু বাজি রাখতে তৈরি হয়ে যাই। যুধিষ্ঠিরের কথা ভাব, আর সন্দেহ থাকবে না।”

“ধুর ধুর, এর চেয়ে লটারির টিকিট কাটা ভাল। এক বার লেগে গেলে আর এত সাত-পাঁচ নিয়ে ভাবতেই হবে না,” শিবুদার কথা শেষ হতেই বলল তপেশ। বহু ক্ষণ চুপ করে থেকে ওর পেট ফুলছিল।

“কথাটা যদি প্রসঙ্গ বুঝে বলিস, তা হলে শাবাশ। প্রায়-নিশ্চিত ক্ষতির ঠিক উল্টো দিকে রয়েছে প্রায়-অসম্ভব লাভ। সেটাও মানুষের মনকে পাল্টে দেয়, ঠিক উল্টো পথে। কিন্তু আজ আর সময় নেই। পরের দিন এক বার মনে করিয়ে দিস, লটারির গল্পটা বলব।” শিশিরের প্যাকেট থেকে দিনের শেষ সিগারেটটি বার করে নিয়ে উঠে পড়লেন শিবুদা।

অন্য বিষয়গুলি:

Share Market
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy