দম্পতি গিয়ে দেখেন, তাঁদের এক জনের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ইতিমধ্যেই পাসপোর্ট তৈরি হয়ে রয়েছে। —ফাইল চিত্র।
সারা জীবনের সঞ্চয়ের কিছু টাকা দিয়ে ইউরোপে ঘুরতে যাবেনবলে ঠিক করে রেখেছিলেন এক দম্পতি। ৬০ পেরোনোর মুখে সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে বলে কয়েক মাস ধরে চলছিল প্রস্তুতি। কিন্তু সব উৎসাহে জল ঢেলে পাসপোর্টের আবেদন ফিরিয়ে দেয় আঞ্চলিক পাসপোর্ট সেবা কেন্দ্র। উল্টে পাসপোর্ট সংক্রান্ত আদালতে হাজির থাকার চিঠি আসে তাঁদের নামে।
দম্পতি গিয়ে দেখেন, তাঁদের এক জনের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ইতিমধ্যেই পাসপোর্ট তৈরি হয়ে রয়েছে। পাসপোর্টধারী বিদেশেও চলে গিয়েছেন। কী করে সম্ভব? পাসপোর্ট অফিস জানায়, তাঁদের ঠিকানার প্রমাণপত্র থেকে জন্মের শংসাপত্রের নথি জাল করে পাসপোর্ট বানানো হয়েছে। প্রৌঢ়া দেখেন, তাঁর স্বামীর নামে পাসপোর্ট থাকলেও ছবি রয়েছে অন্য ব্যক্তির। ওই ব্যক্তি কে? জানা গেল, পাসপোর্ট সেবা কেন্দ্রের নির্দেশে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। যে দেশে পাসপোর্টটি নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছেপ্রশাসনিক ভাবে। কিন্তু কত দিনে জটিলতা কাটবে? কবে দু’জনের ভ্রমণের স্বপ্নপূরণ হবে? জানেন না দম্পতি।
এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রতি বছরই এমন বেশ কিছু সংখ্যক পাসপোর্ট ধরা পড়ছে যা অন্য কারও নথিজাল করে বানানো। সম্প্রতি পাসপোর্ট চক্রের মাথাদের গ্রেফতারির পরে বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। যদিও ভুক্তভোগীদের বড় অংশই বলছেন, ‘‘দিনকয়েক আলোচনা হয়। কিছুতেই কিছু বদলায় না।ভুগতে হয় সেই সাধারণ মানুষকেই।’’ পুলিশ সূত্রের খবর, তদন্তে দেখা যাচ্ছে, বনগাঁর এক ব্যক্তির নাম, ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট তৈরি করানো হয়েছে বাংলাদেশেরনড়াইলের বাসিন্দার ছবি বসিয়ে। খুলনার বাসিন্দার ছবি দেওয়া পাসপোর্ট তৈরি হয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ের এক বাসিন্দার নাম-ঠিকানা দিয়ে। তদন্তকারী এক পুলিশ অফিসারই বললেন, ‘‘জঙ্গিপুরের তুহিনা খানের পাসপোর্টেবারাসতের শম্পা বিশ্বাসের ছবি। ডেবরার হাফিজুল মেহেদির পাসপোর্টে নিউ টাউনের সমর সরকারের ছবি। শিলিগুড়ির রসিদুল আজ়াদের পাসপোর্টেক্যানিংয়ের মোসলেম ঘরামির ছবি। বারাসত, নিউ টাউন এবং ক্যানিংয়ের এই বাসিন্দারা অন্যের নথি ব্যবহার করে নিজেদের পাসপোর্ট বানিয়েছে। আদতে তারা কেউই ভারতের বাসিন্দা নয়। আসল লোকজন পাসপোর্ট বানাতে গেলে বা নিজেদের নথি ব্যবহার করে কিছু করতে গেলে বিষয়টি ধরা পড়ছে।’’
জাল পাসপোর্ট তৈরির অভিযোগে ২০১৭ সালের নভেম্বরেবহরমপুর থেকে ১১ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। তাদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ডে বাংলাদেশিদের ছবি বসিয়ে জাল পাসপোর্ট বানানোর অভিযোগ ছিল। দিনকয়েক আগে মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ায় জঙ্গি সন্দেহে দু’জন গ্রেফতার হতেই পাসপোর্ট জাল-চক্রের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। যদিও মুর্শিদাবাদেরজেলাশাসক রাজর্ষি মিত্র বলেন, ‘‘পাসপোর্ট পুরোপুরি বিদেশ মন্ত্রক থেকে দেওয়া হয়। পুলিশ নথি খতিয়ে দেখে। আমাদের আলাদাকরে দেখার কিছু থাকে না।’’ তবে জেলা পুলিশের এক আধিকারিক দাবি করেছেন, যথাযথ ভাবেই সব যাচাই করা হয়।
গত তিন বছরে কেরল, অসম এবং তামিলনাড়ু থেকে এনআইএ বা সে রাজ্যের পুলিশঅন্তত ১০ জনের ক্ষেত্রে মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে, তারা বাংলাদেশি নাগরিক। তাদের বাংলাদেশি এবং ভারতীয় পাসপোর্ট— দুই-ই রয়েছে। তাদের কাছে আধার কার্ডও আছে। সেই কার্ড বাতিলের জন্য নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানোর পাশাপাশি সেটির প্রতিলিপি জেলা প্রশাসনকেও দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনও ওই ১০ জনের আধার কার্ড বাতিলের জন্য আধার কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু এর পরেও কিছুই বদলায় না বলে অভিযোগ।
পাসপোর্ট করাতে গিয়ে সমস্যায় পড়া ভুক্তভোগীদের দাবি, বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দালালেরমাধ্যমে না গেলে বহু দিন সময় লেগে যাচ্ছে। দালালেরা ওয়েবসাইটের ‘স্লট’ আগাম দখল করে রাখায় নির্দিষ্ট সময়ে প্রমাণপত্র আপলোড করতেও ভুগতে হয়। অভিযোগ, এর পরে পুলিশি যাচাইয়ে(ভেরিফিকেশন) ছাড়পত্র পেতে টাকা দিতে হয়। এমনকি, ডাকঘরের মাধ্যমে নতুন পাসপোর্ট ঠিকানায় পেতেও দিতে হয় টাকা। দিনকয়েক আগেই এক ডাকঘরকর্মীরপাসপোর্ট পৌঁছে দিয়ে টাকা দাবি করার ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
একই ভাবে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট বা পিসিসি পাওয়ার ক্ষেত্রেও ভুগতে হচ্ছে বলে অভিযোগ। পাসপোর্টের আবেদনকারীর সব তথ্য খতিয়ে দেখে পুলিশ যে রিপোর্ট দেয়, সেটাকেই বলা হয় পিসিসি। নবীকরণের ক্ষেত্রেও যদি দেখা যায়, আবেদনকারী প্রথম বার তৎকালে পাসপোর্ট নিয়েছিলেন এবং কোনও কারণে তাঁর পুলিশি যাচাই হয়নি বা আবেদনকারী ঠিকানা বদল করেছেন, তা হলে নতুন পিসিসিপ্রয়োজন হয়। এখন বেশ কিছু বিদেশি দূতাবাসে ভিসার আবেদন করতে গেলে পিসিসি চাওয়া হচ্ছে। পুরনো নিয়মে পাসপোর্টের আবেদনের পরে পুলিশি যাচাই হত। তবে তার পরে পাসপোর্ট পেলে ভিসা পেতে তেমন অসুবিধা হত না। এখন নতুন নিয়মে পাসপোর্ট দ্রুত আসছে ঠিকই। তবে নথি যাচাই পরে হওয়ায় পাসপোর্ট পেয়ে বিশেষ লাভ হচ্ছে না। বিদেশযাত্রার জন্য ভিসা চাইতে গেলেই দূতাবাস পিসিসি চাওয়ায় আবেদনকারীকে নতুন করে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ, পাসপোর্ট পেয়েও ঝক্কি কমছে না। ভুগছেন সাধারণ মানুষই।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy