অঙ্গীকার: শপথগ্রহণের দিন নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১০ মে, ২০২১। পিটিআই।
আরও এক বার ক্ষমতায় ফিরে আসা তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের থেকে আমরা কী আশা করতে পারি? প্রথমেই করোনা পরিস্থিতিকে ঠিকঠাক সামাল দেওয়া এবং এই রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যাতে ভেঙে না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করা। করোনা পরিস্থিতি রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কঠিন পরীক্ষার সামনে ফেলেছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার কোনও রকম ফাঁকফোকর থাকলে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে। আমাদের এই পরীক্ষা কাজে লাগানো উচিত ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আরও উন্নত করা উচিত। বিগত এক দশকে সরকারি স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর যেটুকু উন্নতি হয়েছে, তা মোটামুটি কলকাতা-কেন্দ্রিক। জেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির অবস্থা খুব উৎসাহব্যঞ্জক নয়। সেগুলিকে এই সুযোগে ঢেলে সাজিয়ে নেওয়া উচিত। আমাদের রাজ্যের মানুষকে যেন কথায় কথায় ভেলোর দৌড়তে না হয়।
স্বাস্থ্য ছাড়া যে বিষয়টায় আমি সবচেয়ে বেশি জোর দিতে চাই, তা হল— শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান। মাঝারি শিল্পে পশ্চিমবঙ্গের অগ্রগতি অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় খারাপ না হলেও বৃহৎ শিল্প টানার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ কিছু বড় রাজ্যের তুলনায় বেশ খানিকটা পিছিয়ে। আগামী পাঁচ বছর বর্তমান সরকারের এই দিকে একটু মন দেওয়া উচিত। বিগত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যত্ন সহকারে ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’ তৈরি করেছে। তাই বৃহৎ শিল্পের জন্য জমি পাওয়াটা খুব সমস্যার ব্যাপার হবে বলে মনে হয় না। আমি বৃহৎ শিল্পের উপর জোর দিচ্ছি, কারণ বড় শিল্পের সঙ্গে অনেক ধরনের অনুসারী শিল্পের চাহিদা বাড়ে ও এই অনুসারী শিল্প স্থাপনের ফলে প্রচুর কর্মসংস্থান হয়। অর্থাৎ, একটি বৃহৎ শিল্প স্থাপিত হলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যে লাভ হয়, তা বেশ কিছু মাঝারি শিল্প স্থাপনের থেকে বেশি।
শিল্পায়ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের কিছু সুবিধা আছে। প্রথমত, এখন আর বাম জঙ্গি শ্রমিক ইউনিয়ন নেই, বা তাদের সেই ক্ষতিকারক প্রভাব নেই। দ্বিতীয়ত, বন্ধ বা হরতালের যে ‘সংস্কৃতি’ পশ্চিমবঙ্গে ছিল, তা এখন অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। তাই বর্তমান সরকার যদি শিল্পায়ন নিয়ে এগোতে চায়, তাদের এই দুই সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না। তৃতীয়ত, বাংলায় শিক্ষিত ও দক্ষ যুবক-যুবতীর অভাব নেই। তারা শিল্পায়নের প্রচেষ্টাকে যে সাদরে গ্রহণ করবে, সে নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু উল্টো দিকে বর্তমান সরকারকে কিছু অসুবিধার সম্মুখীনও হতে হবে। প্রথমত, বর্তমান করোনা পরিস্থিতি। দ্বিতীয়ত, শিল্পায়ন নিয়ে বর্তমান সরকারের প্রতি শিল্পমহলের বিশ্বাসযোগ্যতা, যা তারা হারিয়েছিল সিঙ্গুর থেকে টাটা গোষ্ঠী বিদায় নেওয়ার পর। ভারত তথা বিদেশি শিল্পমহলের কাছে সেই ঘটনা খুব উৎসাহব্যঞ্জক কোনও বার্তা বহন করেনি। ফলত, বাংলার শিল্পায়ন নিয়ে শিল্পমহলের এই নেতিবাচক ধারণার পরিবর্তন আবশ্যিক এবং তা বর্তমান সরকারের করা উচিত। বিগত বাম জমানা থেকে বাংলার মানুষকে অল্পে সন্তুষ্ট থাকতে শেখানো হয়েছে। ‘যেটুকু পাচ্ছি, তা-ই আমার পাওনা’— এই মানসিকতা থেকে বাংলার মানুষকে বার করে আনা জরুরি। বাংলার সাধারণ মানুষের ‘এক্সপোজার’ বাড়ানো এবং তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী করে তোলাও সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাঁদের উদ্যোগী করে তোলাটাও জরুরি। ব্যাপক শিল্পায়ন প্রচেষ্টা এই মানসিকতার আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম বলে আমার মনে হয়।
কৃষিক্ষেত্রে বাংলার অবস্থা অন্য অনেক রাজ্যের থেকে ভাল। ধান উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ তৃতীয়, চা উৎপাদনে দ্বিতীয় ও আনাজ উৎপাদনে প্রথম। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ আয় ও ক্রয়ক্ষমতা অন্য রাজ্যের তুলনায় বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে কিছু গবেষণায় প্রকাশ। এই ফল আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এই বর্ধিত আয় বা ক্রয়ক্ষমতা কতটা আমাদের রাজ্যের কৃষি বা অন্যান্য কর্মসংস্থান থেকে এসেছে, আর কতটা আমাদের পরিযায়ী শ্রমিকদের বাইরে থেকে পাঠানো, তা নিয়ে কিছুটা সংশয় থেকেই যায়। কিন্তু কৃষিজাত আয় বৃদ্ধির হার যে ক্রমশ কমে আসছে, তা নিয়ে খুব দ্বিমত নেই। সেই জন্যই কৃষিক্ষেত্রের আধুনিকীকরণ জরুরি। এর জন্য যা সরকারি সাহায্যের দরকার, তা সরকার করবে আশা করি।
এ বার শিক্ষাক্ষেত্রের কথায় আসি। প্রথমে স্কুল শিক্ষার কথা বলি। আমি নিজে হাওড়ার সরকারি জেলা স্কুলে পঠনপাঠন শেষ করি প্রায় ত্রিশ বছর আগে। কিছু দিন আগে আমাদের স্কুলের ১৭৫ বছর পূর্তি উৎসবে খুব উৎসাহের সঙ্গে স্কুলপ্রাঙ্গণে সবাই মিলিত হই। নিজের স্কুলে গিয়ে আনন্দের সঙ্গে বেশ কিছুটা দুঃখও হয়। এই ত্রিশ বছরে কিছু নতুন বাড়ি হয়েছে কিন্তু এখনও সেই পুরনো বেঞ্চগুলি রয়ে গিয়েছে যেগুলিতে আমরা বসতাম, আর সেই পুরনো ব্ল্যাক বোর্ড। স্কুলপ্রাঙ্গণটিও বেশ অপরিচ্ছন্ন। কলকাতার কাছে একটি নামী সরকারি স্কুলের পরিকাঠামোর কেন ত্রিশ বছরেও সে রকম উন্নতি হল না, ভেবে অবাক হচ্ছিলাম। অরবিন্দ কেজরীবাল দিল্লির সমস্ত সরকারি স্কুলের ভোল পাল্টে দিয়েছেন ৬ বছরের মধ্যে, অথচ আমরা ত্রিশ বছরেও তার ধারেকাছে পৌঁছতে পারলাম না! এর উপর সরকারি স্কুলগুলি আর অভিভাবকদের ঈপ্সিত স্কুলগুলির মধ্যে পড়ে না, এবং আমাদের স্কুলেরও প্রায় তা-ই অবস্থা। কলকাতার অত্যন্ত কাছের একটি নামী সরকারি স্কুলের যদি এই অবস্থা হয়, তা হলে গ্রামের স্কুলগুলির কী হাল, সহজেই অনুমান করা যায়। আশা করব, বর্তমান সরকার এই দিকে বিশেষ নজর দেবে, আর সরকারি ও সরকারপুষ্ট স্কুলগুলির পরিকাঠামো ও শিক্ষার মানোন্নয়নে উদ্যোগী হবে। যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ ও স্কুলগুলির পরিকাঠামো উন্নয়ন আবশ্যিক। দুর্বল ভিতের উপর কখনও পোক্ত বাড়ি হয় না।
রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি জাতীয় র্যাঙ্কিং-এ পিছিয়ে পড়ছে। প্রথম ত্রিশে রাজ্যের মাত্র ২টি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রথম একশোয় মাত্র ৫টি কলেজ স্থান পেয়েছে। মেডিক্যাল কলেজগুলির মধ্যে প্রথম চল্লিশে রাজ্যের একটিও নেই। তাই উচ্চশিক্ষাতেও সরকারকে একটু মন দিতে অনুরোধ রইল। গবেষণার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ সরকারি সাহায্য, পরিকাঠামোর উন্নতি ও শিক্ষার মানোন্নয়নে যোগ্য ব্যক্তির নিয়োগ এখানেও প্রয়োজন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিচালন ও শিক্ষক নিয়োগে রাজনীতিকরণ যদি রোখা যায়, তা হলে আমরা আবার আগের গৌরবের জায়গায় ফিরতে পারব।
পরিশেষে, সরকার সকলের জন্য কাজ করুক। মানুষকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান দেওয়ার সঙ্গে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করুক, রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলগুলির উপর মানুষের নির্ভরশীলতা কমাক ও একই সঙ্গে মানুষকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী করে তুলুক। শিল্প আসুক, বিনিয়োগ আসুক, প্রচুর কর্মসংস্থান হোক। দল, মত নির্বিশেষে সকলে যেন সরকারের কাজের সুফল পায়। মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক দল ব্যক্তিগত পছন্দ বা অপছন্দের হতে পারে, কিন্তু সরকার সকলের। তাই সরকারের কাছে সবাই সমান, তিনি সমর্থক হন বা বিরোধী। এই সংস্কৃতি যদি পশ্চিমবঙ্গে চালু করা যায়, তা হলে হয়তো আমরা রাজনৈতিক হিংসার ‘কালচার’ থেকে মুক্তি পাব। প্রগতির ক্ষেত্রে ‘আমরা-ওরা’ সংস্কৃতি কাঙ্ক্ষিত নয় এবং আমার আশা বর্তমান সরকার এই অসুস্থ মানসিকতা থেকে পশ্চিমবঙ্গকে মুক্ত করবে।
অর্থনীতি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy