ভারতে গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামো অনেকটা ত্রিস্তরীয় পিরামিডের মতো। পিরামিডের একদম নীচের স্তরে আছে সাব সেন্টার বা উপকেন্দ্র। গড়ে প্রতি ৫০০০ গ্রামীণ মানুষের জন্যে একটি উপকেন্দ্র থাকার কথা। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, উপকেন্দ্রগুলিতে কোনও স্থায়ী ডাক্তার থাকেন না। এক জন পুরুষ ও এক জন মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী উপকেন্দ্রগুলি দেখভাল করেন। উপকেন্দ্রগুলিতে সাধারণ প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকে, এবং জনস্বাস্থ্য ও সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার সরকারি কর্মসূচির প্রচার উপকেন্দ্রগুলির প্রধান কাজ। গ্রামীণ স্বাস্থ্য পিরামিডে উপকেন্দ্রের উপরের স্তরে আছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে পাকাপাকি ভাবে এক জন ডাক্তার ও তিন জন নার্স ছাড়াও ১২ জন স্বাস্থ্যকর্মী থাকার কথা। প্রতি ৩০,০০০ গ্রামীণ মানুষের জন্যে চার থেকে ছয় শয্যাবিশিষ্ট একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকার কথা সরকারি নিয়মে। গ্রামীণ স্বাস্থ্য পিরামিডের একেবারে উপরের স্তরে থাকে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি এক-একটি ৩০ শয্যাবিশিষ্ট ছোটখাটো হাসপাতাল যেখানে চার জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-সহ ২১ জন স্বাস্থ্যকর্মী থাকার কথা। নিয়ম মতো ১২০০০০ গ্রামীণ মানুষের জন্যে একটি করে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকার কথা। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এর উপরের স্তরে থাকে মহকুমা বা জেলা হাসপাতাল ও সাধারণ সরকারি হাসপাতাল। গ্রামীণ স্বাস্থ্য পিরামিডের নীচের স্তরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির সুপারিশের ভিত্তিতে এই হাসপাতালগুলিতে অপেক্ষাকৃত জটিল রোগের চিকিৎসা হওয়ার কথা। তা হয়ও। হয়তো বা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মাত্রাতেই হয়। কিন্তু যে হেতু এই উপরের স্তরের হাসপাতালগুলি সবই শহর এলাকায়, গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর আলোচনায় এগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করব না।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, গত ১৫ বছরে গ্রামবাংলায় মোট স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা মোটামুটি একই আছে। বাম জমানার শেষ দিকে বেশ কিছু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে উন্নীত করা হয়েছিল। গত দশ বছরে নতুন করে কিছুই হয়নি— ২০১২ সালে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৩৪৮টি, ২০১৯ সালেও তা-ই আছে।। রাজ্যের গ্রামীণ জনসংখ্যা অবশ্য গত ১৫ বছরে প্রায় ৫০ লক্ষ জন বেড়েছে। ফলে সমস্ত রকমের গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপর চাপ বেড়ে গিয়েছে। আগের সরকারের আমলেও অবস্থা যথেষ্ট খারাপ ছিল। ২০০৫ সালে রাজ্যের গ্রামীণ হাসপাতালগুলিতে প্রতি ৬০৭০ মানুষ পিছু একটি শয্যা ছিল; ২০১২ সালে সেটা হয় মোটামুটি ৩৯৩০ মানুষ পিছু একটি শয্যা। কিন্তু গত এক দশকে গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে সরকার কিছু করেছে বা ভেবেছে বলে মনে হয় না। অন্তত প্রাপ্ত তথ্যে তেমন কোনও ভাবনার প্রতিফলন নেই।
গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে নিযুক্ত চিকিৎসকদের সংখ্যার হিসেবটা আরও ভয়াবহ। ২০০৫ সালে যেখানে গ্রামে চাকরিরত সরকারি চিকিৎসক ছিলেন ১৪৫২ জন, ২০১৯ সালে সেই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৮৮১ জনে। মানে ২০০৫ সালে যেখানে গ্রামে প্রতি ৪১,০০০ মানুষ পিছু এক জন সরকারি চিকিৎসক ছিলেন, ২০১৯ সালে সেখানে প্রতি ৭৪,০০০ মানুষের জন্য এক জন। গ্রামের মানুষকে যে চিকিৎসার জন্যে ক্রমাগত বেসরকারি ব্যবস্থার উপর নির্ভর করতে হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! সরকার সবার জন্য স্বাস্থ্যসাথী অকারণে চালু করেনি! গ্রামীণ সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়ে ঠেকা না দিতে পারলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। তবে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা এখনও মূলত শহর-কেন্দ্রিক। তাই স্বাস্থ্যসাথীর ফলে গ্রামের মানুষের চিকিৎসাজনিত পরিষেবা কী ভাবে অদূর ভবিষ্যতে সহজলভ্য হবে, সেই প্রশ্ন থাকছে। প্রসঙ্গত, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সরকার অনুমোদিত অনেক চিকিৎসক পদেরই গত দশ বছরে বিলুপ্তি ঘটেছে।
তবে তৃণমূল সরকারের দশ বছরে কি গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর কোনও উন্নতি হয়নি? অন্তত দু’টি ব্যাপারে এই সরকারের সাফল্য স্বীকার করতেই হবে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে চিকিৎসক ছাড়া অন্যান্য মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী ও নার্স নিয়োগ করার ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। বিশেষত, নার্স ছাড়া অন্য মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীদের ক্ষেত্রে অনুমোদিত পদের ও চাকরিরত কর্মীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে গত দশ বছরে। এই মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীরাই কিন্তু সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে সাধারণ মানুষের প্রাথমিক যোগাযোগ স্থাপন করেন। এই বাড়তি মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের নিশ্চয়ই একটা সুফল পাওয়া যাবে গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে। কিন্তু সে সুফল পুরোপুরি পেতে গেলে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে উপযুক্ত সংখ্যায় চিকিৎসক নিয়োগ জরুরি। অন্যথায় নিন্দুকে বলতে পারে যে, এই নিয়োগ শুধু দলীয় কর্মীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থামাত্র।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কী ভাবছে, তা আমরা জানতেই পারি না। নির্বাচনী প্রচারে শাসক-বিরোধী কেউই এ নিয়ে রা কাড়েন না। অথচ সাড়ে ছয় কোটি বঙ্গবাসী গ্রামে থাকেন। তাঁদের ভাল থাকার, সুস্থ থাকার অন্যতম জরুরি উপাদান হল গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামো। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হাতে স্বাস্থ্য দফতরের দায়িত্ব। শুনতে পাই বা সরকারি বিজ্ঞাপনে দেখি যে, বর্তমান সরকার নাকি জেলায় জেলার সুপার-স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরি করেছে। তাতে গ্রামের মানুষের চিকিৎসার সুবিধে লাভ হয়েছে কতটা জানি না, তবে সরকারি বিজ্ঞাপনের ছবি যে উৎকৃষ্ট পাওয়া গিয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আসলে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক জন ডাক্তার নিয়োগ করলে তার প্রচার-মূল্য আর কতটুকু! মানুষের চোখে অনেক বেশি পড়ে সুপার-স্পেশালিটি হাসপাতালের নতুন তৈরি হওয়া ঝাঁ চকচকে নীল সাদা বাড়ি। প্রদীপের নীচের অন্ধকারটা থেকেই যায়।
একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। এক অসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীর কাছে শোনা। কোনও এক জেলায় একটি সুপার-স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরির কথা হচ্ছে। ১০০ কোটি টাকা বাজেট। জেলা পরিকল্পনা পর্ষদের মিটিংয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিও আছেন। তিনি তথ্য দিয়ে বোঝালেন যে, সদর হাসপাতালের সত্তর শতাংশ শয্যায় ভর্তি আছেন প্রসূতিরা। কোনও বাড়তি জটিলতা না থাকলে কিন্তু গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই প্রসব সম্ভব। জেলার ২৫টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে ২ কোটি টাকা করে দিলে সেখানে প্রয়োজনীয় বাড়তি পরিকাঠামোটুকু বানিয়ে নেওয়া সম্ভব। অবশ্য চিকিৎসক নিয়োগ করতে হবে, কিন্তু সে তো সুপার-স্পেশালিটি হাসপাতালেও করতে হবে। এতে সদর হাসপাতালের অন্তত ৬০ শতাংশ শয্যা খালি হবে। বাকি ৫০ কোটি টাকা দিয়ে সদর হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নতি, কিছু বাড়তি শয্যার ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। তবে প্রসূতিদের আর চিকিৎসা বা পরামর্শের জন্য জেলা সদরে আসার দরকার পড়বে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার রাজি হল না। তাদের দরকার এমন কিছু, যার দৃশ্যমানতা বেশি।
শুধু রাজনীতিকদের দোষ দিয়েই বা কী হবে? যত দিন না আমরা নিজেদের ভাল-মন্দ তলিয়ে দেখতে শিখব, দাবি করব আমাদের জীবনের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনার, অন্ধকারটা থেকেই যাবে।
অর্থনীতি বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy