স্পঞ্জ আয়রন-কে লুকিয়ে রাখা হয়েছে নামের মধ্যে। ফাইল চিত্র।
একশো জনের মতো মেয়ে। কেউ শ্রমিক, কেউ নিজের সংসারে কাজ করেন, কেউ কলেজছাত্রী। সব কাজ পাশে সরিয়ে রেখে দুপুরবেলা হাইওয়ের ধারে হলঘরটিতে বসেছেন পরিবেশ আর জীবিকার কথা আলোচনা করতে। ঝাড়গ্রাম জেলার শালবনি পঞ্চায়েতের কয়েকটি গ্রামের মেয়েরা। কারও সঙ্গে সন্তান, কেউ বয়স্ক মানুষদের একা রেখে এসেছেন। কেউ ফিরে গিয়ে রাঁধবেন। রাস্তা দিয়ে গমগম করে ডাম্পার ছুটছে। সতর্ক হয়ে চলতে হয়। প্রশাসন, জঙ্গল বিভাগ, ভূমিরাজস্ব দফতর— সবার কাছে রাশি রাশি দরখাস্ত পড়েছে। এ বার একজোট হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলছেন নারী মঞ্চের মেয়েরা। এইটুকু এলাকার মধ্যে এত রকমের সমস্যা যে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন পড়ান যাঁরা, তাঁদের জন্যই সভাটি একটি ক্লাসরুম হয়ে উঠতে পারে।
একটি শিল্প হাত-পা ছড়াচ্ছে বাড়বে বলে। সে তো সুখের কথা। দেওয়ালে লেখা হত না এক জমানায়— ‘শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’? নামে তা সিমেন্ট কারখানা। সম্প্রতি সিমেন্ট থেকে নাম বদলে হয়েছে ‘উদ্যোগ’। স্পঞ্জ আয়রন-কে লুকিয়ে রাখা হয়েছে নামের মধ্যে। শালবনি গ্রাম পঞ্চায়েতের জিতুশোল মৌজা ছাড়িয়ে বাগমুড়ি মৌজায় পৌঁছে গেছে কারখানা। আরও জমি চাই। ছড়াবার মন্ত্র হল, জমি দখল, জমি কেনা, বর্জ্য ফেলা। স্থানীয় মহিলা সমিতি এলাকার অনেকগুলি বাগান পঞ্চায়েতের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বছর কুড়ি ধরে দেখাশোনা করে আসছে। বাগানের মালিকরা শহরবাসী, বহু দিন আসেন না, গাছপালা দেখাশোনা করেন, ফল তোলেন মেয়েরাই। এখন শোনা যাচ্ছে, সেগুলির মালিকানা চলে গেছে এমন সব ব্যক্তির কাছে, যাঁরা বাগানের বাইরে পাঁচিল তুলে জেসিবি দিয়ে গাছ কেটে ফেলছেন, নাকি পিকনিক স্পট হবে। এই বাগানগুলি কিনে নিচ্ছে কারখানা। পাট্টার জন্য আবেদন করে বসে আছেন মেয়েরা, যদিও তাঁরা জানেন মালিকানা তাঁদের নয়। যাঁরই হোক, বাগানগুলি খাস জমিতে। কিন্তু এত দিনে বেড়ে ওঠা বড় গাছগুলি? হাত বদল কি বৈধ ভাবে হচ্ছে? সে বিষয়ে জানার এক্তিয়ার তাঁদের নেই। কারণ, তাঁরা তৃতীয় পক্ষ।
তুলনীয় অবস্থা জঙ্গল সুরক্ষা কমিটির। তাঁদের সঙ্গে জঙ্গল দেখাশোনার চুক্তি হলে বিভাগ থেকে তাঁদের জমির নকশা দেওয়া হয়। অনেক কমিটি সে নকশা পেয়েছে, কিন্তু শালবনির সমিতিগুলি পায়নি। ওই নকশা বদলাচ্ছে। কিন্তু কেন, তার কোনও উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। রায়তি জমি যাঁদের, তাঁদের মধ্যেও আশঙ্কা। কারখানার কাছ থেকে প্রস্তাব এসেছে এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীর কাছে। তাঁর জমিটি তারা কিনতে চায়। তিনি রাজি হননি প্রথমে। তার পর দেখলেন, চার পাশের সব প্লট বিক্রি হয়ে গেল। নির্বিচারে কাঁচামাল ও কারখানার বর্জ্য ফেলা হতে লাগল তাঁর জমি ঘিরে। তখন আর আত্মসমর্পণ না করে উপায় কী? নিজের জমিটি কিনে নেওয়ার জন্য আবার দরবার করতে গেলেন। তারা নিল না। চোখের সামনে জমি পরিণত হল বর্জ্যের স্তূপে। স্পেশাল ইকনমিক জ়োনের জন্য জমি এই ভাবেই চার পাশ থেকে ঘিরে কিনে নেওয়া হত এক সময়। মাঝখানে বসে থাকা অভিমানী চাষির বেরোবার পথ থাকত না।
বেশ কয়েক বছর হল ঝাড়গ্রাম শহরের মধ্যে নির্বিচারে গাছ কাটা হয়েছে, সেও উন্নয়নের নামে। রিয়েল এস্টেট-ই এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। হাতির চলার পথ মানুষের যথেচ্ছ নির্মাণে অবরুদ্ধ। এখন বৈদ্যুতিক কাঁটাতার দিতে হবে দলছুট হাতির আক্রমণ থেকে শহরের লোককে বাঁচানোর জন্য। পরিবেশ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ভাবনা-চিন্তার পথে অন্তরায় অর্থবান, সংগঠিতরা। ডেভলপার, শিল্পপতি, রিসর্টের মালিক। এঁদের মান্য করেন রাজনীতিকরা, কাজেই পরিবেশ কোনও নির্বাচনের অ্যাজেন্ডা হয়ে ওঠে না। কিন্তু পরিবেশ দূষণ যাঁদের জীবন বিপন্ন করে, তাঁদের কথা শোনার পথ কোথায়? সরকারি আধিকারিকরা নীরব। অর্থবানদের হাত এত লম্বা যে, যাঁরা অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অন্য অভিযোগে এফআইআর দাখিল হয়ে যায়।
সিমেন্ট তথা স্পঞ্জ আয়রন কারখানাটি জঙ্গল এলাকার একেবারে প্রান্তে। এত কাছে কারখানা অনুমতি পেল কী করে? ২০১৫ সালে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ছাড়পত্র পায় কারখানাটি। কিন্তু কারখানা চালানোর শর্ত উল্লঙ্ঘন করায় ২০১৯ সালে পর্ষদের ইনস্পেকশন টিম এসে দেখে, চাষজমির উপর যথেচ্ছ বর্জ্য বোঝাই করা। ক্ষতিপূরণ আদায় করার জন্য ফাইন করা হয়, কারণ দর্শানো নোটিস দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে দূষণ কমেনি। ক্ষতিপূরণও পাননি মানুষ।
কেবল কারখানার সামনের বড় গাছগুলি নয়, হাইওয়ের উপরেও গাছের পাতা ধুলোয় রাঙা। যে ঘরে বসে কথা হচ্ছে, সেখানে শতরঞ্চি সরিয়ে পা রাখলে পায়ের পাতা কালো হয়ে যায়। আজকাল ওই এলাকায় কুয়োর জল আর ব্যবহার করা যায় না। তাতে লাল ধুলোর সর। জঙ্গলে গিয়ে ফিরলে মেয়েদের জামাকাপড় পরিষ্কার করতে ডিটারজেন্ট লাগে, সে কাপড় পরা যায় না। বিপন্ন হচ্ছে জীবিকা। জঙ্গল থেকে যে পাতা তাঁরা কুড়িয়ে আনেন, তা অনেক বার ধুলেও পরিষ্কার হয় না। সবচেয়ে বিপদে আছে শিশুরা। এলাকায় জন্ডিস বাড়ছে। সকালে শিশুদের রোদে বসতে বলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু শীতের সকালে বাইরে বসলেই শ্বাসকষ্ট। ডাম্পার চলেছে রাস্তা কাঁপিয়ে। ট্রেনে করে কাঁচামাল আসে। কিন্তু লোডিং-এর জায়গা স্টেশনের ধারে না থাকায়, ডাম্পারের মাল ফেলা হয় গ্রামের জমিতে। স্পঞ্জ আয়রন কারখানা কেন্দ্রীয় দূষণ পর্ষদের শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী ‘রেড ক্যাটেগরি’র দূষণকারী শিল্প। কিন্তু পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ স্পঞ্জ আয়রন তৈরি হয় ভারতে। সারা দেশে এর সংখ্যা বাড়ছে, ২০০১ সালে ২৬ থেকে বেড়ে ২০২২-এ হয়েছে ২১৯। উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ। গ্যাসের বদলে কয়লার জ্বালানিতে চালানোর ফলে এদের দূষণ ভয়াবহ। এটা কি কোনও সমাপতন যে, অধিকাংশ স্পঞ্জ আয়রন কারখানাই জনজাতিবহুল এলাকায়? তার ফলে যেমন বিপন্ন হয় মানুষের জঙ্গলভিত্তিক জীবিকা, তেমন এঁদের কথা শোনার, উত্তর দেওয়ার বড় গরজ নেই। তিরিশ বছর আগেও এখানে পাথর কারখানা ছিল। সিলিকোসিসে আক্রান্ত মানুষদের নিয়ে আন্দোলন হয়েছিল। তখনও পুঁজির হাত এত লম্বা হয়নি। ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল মানুষ। এখন পুঁজির ক্ষমতা আকাশছোঁয়া। সরকার ও কর্পোরেটই ভাগ্যবিধাতা। ফাঁক গলে খসে গেছে জনগণ।
পুরনো বাগানগুলির হাতবদল কী ভাবে হচ্ছে, মেয়েরা জানতে চাইলে জেলাশাসক বলেন আদালতে যান। শাল জঙ্গলের চরিত্র কী ভাবে বদলে ঝাটি জঙ্গল হয়ে যাচ্ছে, জানতে চাইলে ভূমিরাজস্ব আধিকারিক বলেন, জঙ্গল বিভাগকে জিজ্ঞাসা করুন। জঙ্গল বিভাগ কথা কয় না। আসলে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কোনও তথ্যই দেয় না সরকার। ভর্তুকি দিয়ে যারা জনতার জীবন সহজ করে, তারা প্রশ্ন শুনতে চায় না। মেয়েরা প্রশ্ন নিয়ে একত্র হবে, তাও তাদের নিতান্ত অপছন্দের। উন্নয়ন এখন এতটাই জনদরদি যে, প্রশ্ন করতে আগ্রহী জনগোষ্ঠীর মুখোমুখি বসা তাদের কাজের মধ্যে পড়ে না। ফলে, রথ এগিয়ে যায়, যাত্রী পড়ে থাকে পথের পাশে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy