ম্লান-মূঢ়: নির্যাতনের সত্য প্রকাশের পর স্থানীয় নেতাদের গ্রেফতারের দাবি নিয়ে পথে নামা, সন্দেশখালি, ২৫ ফেব্রুয়ারি। ছবি: পিটিআই।
তিনশো আট ঘর বাঙালের মধ্যে একমাত্র ঘটি আমার মা। সেই সুবাদে পাড়াতুতো কাকিমা-জেঠিমাদের হাতে কত জিভে-লেগে-থাকা পিঠে যে খেয়েছি, পৌষপার্বণে। তখন কেউ খেলায় হারলে বা জিতলেও, ‘পিঠে কাঁটাতারের দাগ’, ‘বেড়া টপকে এসেছিস কেন’ ইত্যাদি বলার মতো ইতরামি সহজলভ্য ছিল না; আর সেই সময়েই পিঠের সঙ্গে ‘রঁদেভু’ শুরু হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, ওই অমৃত আর পেটে সইবে না। কেবল আমার নয়, রাত এগারোটায় গন্ডায় গন্ডায় মেয়েকে পিঠে বানানোর অছিলায় তুলে নিয়ে যাওয়া হত শুনতে শুনতে, লক্ষ মানুষের অ্যালার্জি জন্মে গেছে পাটিসাপটা কিংবা দুধপুলির উপর। আর কেউ কেউ হতাশ হয়ে ভেবেছে, যাহ, আরও একটা প্রিয় শব্দ খরচের খাতায় চলে গেল।
বাস্তবের কালি লেগে শব্দের পতন ‘পিঠে’ দিয়ে শুরু হয়নি। যে দিন ‘সঞ্চয়িতা’য় টাকা রেখে ডুবে গিয়েছিল অজস্র পরিবার, সে দিন কোনও কিশোরী হয়তো প্রথম বার ‘সঞ্চয়িতা’ হাতে নিতে গিয়ে কেঁপে উঠেছিল। শ্রদ্ধা, ভালবাসায় চোখ বুজে আসে ‘সারদা’ শব্দ উচ্চারিত হলে। এক দিন ওই শব্দটাকেও ব্যবহার করা হল, গরিবের সর্বস্ব লুট করার জন্য। যে ‘নারদ’ শব্দটার মধ্যে ছিল একটা মজাদার মুচমুচে ভাব, তা শুনলেও কেমন গা ঘিনঘিন করে এখন। বিরক্তি লাগে, ‘ভক্ত’ শব্দটা শুনলে। আর জলাশয়ের পর জলাশয় বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে দেখতে দেখতে ‘উন্নয়ন’ শব্দটা (তা সে রাস্তা কিংবা তিহাড় জেল যেখানেই থাকুক) শুনলে আতঙ্ক লাগে।
এই তালিকাতে ‘সন্দেশ’ শব্দটাও ঢুকে পড়বে যে-কোনও দিন। তার পরও টিভির পর্দায় “মণিপুর নিয়ে কিছু বলেননি কেন?”, “কামদুনির প্রতিবাদী মিছিলে কই হাঁটেননি আপনি”, অথবা “আগের আমলের বানতলার ঘটনা ভুলে গেলেন নাকি?” চলতেই থাকবে। চৈতন্যবোধ কি পুরোপুরি অন্তর্হিত হল সমাজ থেকে? কোনও একটি বিষয় নিয়েও সহনাগরিকেরা একমত হতে পারবেন না? যিনি বা যাঁরা বলেছেন, সন্দেশখালিতে বহিরাগতরা গিয়ে সেজেগুজে নাটক করেছে, তাঁদের আরও অনেকে জিজ্ঞেস করতে পারবেন না, “কখনও সন্দেশখালি গেছেন? এখনও কতটা কঠিন ওখানে যাওয়া, কী ভাবে নদী পেরোতে হয়, কোনও আন্দাজ আছে?”
বলতে না পারার কারণ, প্রত্যেকে আলাদা আলাদা দলে বিভক্ত। এই অজুহাত অত্যন্ত প্রবল সন্দেহ নেই। মণিপুরের নারকীয়তার সময় চুপ করে ছিলেন যাঁরা, যাঁরা সিডি প্রকাশ করে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তাপসী মালিককে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনা আসলে ঘটনা নয়, একটি চক্রান্ত; তাঁদের মুখে সন্দেশখালি নিয়ে লম্বাচওড়া বাতেলা শূন্যগর্ভ ঠেকতেই পারে। কিন্তু তার পরও প্রশ্ন জাগে, দল আসলে কী? বাম হোক বা ডান, কোনও দলের এক জনও ক্ষুধার্ত কর্মী কি সেই দলের কোনও সম্পন্ন কর্মীর ঘরে ঢুকে গিয়ে দুপুরের ভাত চাইতে পারে, অন্য ভাবে সম্পর্কিত না হলে? রাজনৈতিক দল মাত্রেই একটা আলেয়া, যা ভোট-রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় ‘আলো’ বলে ভাবতে আমরা বাধ্য।
কিন্তু ‘সমাজ’ তো তা নয়। সেখানে কেন এত একা হয়ে যাবে মানুষ যে, সমাজমাধ্যম জুড়ে যোগাযোগের মহাসমুদ্রে বাস করেও দিনের শেষে তাকে একটা জনশূন্য দ্বীপে সেঁধিয়ে যেতে হবে? কেন এই ভেবে ভয় পেতে হবে যে, একটি দলকে সমর্থন করেও, প্রতিটি দলের অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে, সকলের কাছেই সন্দেহভাজন হয়ে উঠতে হবে? কেন সমাজ থেকেই দেওয়া হবে না সেই বার্তা যে, শত্রুকে আপ্যায়ন করাই আমাদের সনাতনী রীতি? শত্রুতা মানেই সমূলে বিনাশ করে দেওয়ার ইচ্ছেটা একটা অসুখ। বিধ্বস্ত দুর্যোধনের কাছে যুধিষ্ঠির প্রস্তাব রেখেছিলেন, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে যে কোনও এক জনকে যুদ্ধে হারিয়ে সিংহাসন পুনর্দখল করতে। দুর্যোধন যদি গদাযুদ্ধের জন্য নকুল বা সহদেবকে বেছে নিতেন? অথবা স্বয়ং যুধিষ্ঠিরকেই আহ্বান করতেন? তা হলে তো মহাকাব্যের জয়-পরাজয়ের চিত্রটাই পাল্টে যেত। খলনায়ক হলেও বীরধর্মে বিশ্বাসী দুর্যোধন কিন্তু ভীমকেই গদাযুদ্ধে আহ্বান করেছিলেন।
দুর্বল শত্রুকে নয়, আক্রমণ করতে হলে প্রবল প্রতিপক্ষকেই বেছে নিতে হয়, মহাভারতের এই শিক্ষাই আসল রাজনীতির শিক্ষা। কিন্তু আজকে ‘পলিটিক্স’ নয়, ‘পলিট্রিক্স’-এর রমরমা। ধর্মযুদ্ধ কথাটার মানে ‘ধর্ম’ নিয়ে যুদ্ধ নয়। যে ঘোড়ার পিঠে আছে সে ঘোড়ার পিঠে আসীন কারও সঙ্গে লড়বে, আর যে পদাতিক সে লড়াই করবে মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা কারও সঙ্গে, এই স্বাভাবিক সৌজন্য। কিন্তু সৌজন্য ফসিল হয়ে গেছে। কারণ, সব সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট করে দেওয়া আগ্রাসী রাজনীতির যুগে, আমরা শত্রুকে হারাতে চাই না আর; শত্রুকে ফাঁসাতে চাই।
অথচ বিকল্প উদাহরণেরও অভাব নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, ইংল্যান্ড আর জার্মানির রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের ভিতরেও অজস্র জার্মান শেপ্রাডর জন্ম নিয়েছে। জার্মান শেপার্ড আর ল্যাব্রাডর রিট্রিভার-এর হাইব্রিড এই সারমেয়র শরীরে একাধারে জার্মান আর ব্রিটিশ রক্ত। আশ্চর্য লাগে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও ইংল্যান্ড, এমনকি জার্মানিও বৈরিতাকে কুকুরের স্তরে নামিয়ে আনেনি। স্বল্প সংখ্যায় হলেও দুই দেশের সারমেয়র সংযোগে জার্মান শেপ্রাডররা পৃথিবীতে এসেছে তখনও।
এক জার্মান লেখকের মুখে এই গল্প শুনতে শুনতে বেদনায় মন ভারী হয়ে গিয়েছিল— গত বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজনৈতিক কর্মী অভিজিৎ সরকার ও তাঁর পোষ্যগুলির কথা মনে পড়ায়। মারা যাওয়ার অল্প আগে অভিজিৎ একটি ভিডিয়ো না করে গেলে আমরা ওই নিরাশ্রয় পথকুকুরগুলির কথা জানতেই পারতাম না, অভিজিৎ যাদের লালনপালন করতেন। হাই কোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত চলছে, অভিজিৎ-এর খুনের দায়ে যাদের ছবি প্রকাশিত হয়েছে তারা নাকি সবাই ফেরার। কেউ জানে না শেষ অবধি খুনিরা সাজা পাবে কি না, তবে এটুকু বলাই যায় যে, ওই বেওয়ারিশ কুকুরগুলোকে মেরে ফেলার জন্য, কারও শাস্তি হবে না। আচ্ছা সে বারের ভোটে কোন চিহ্নে ছাপ দিয়েছিল কুকুরগুলো, আরটিআই করলে পরে জানা যাবে কি?
যে যেখানে যা সুবিধা পেয়েছেন, ফ্ল্যাট, চাকরি, বদলি বা পুরস্কার, তাকে ধরে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবেন; সাহিত্য উৎসব থেকে ভিন্ন রাজনৈতিক মতামতের লোকজনকে বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক সাজবেন। এগুলোই স্বাভাবিক। “এঙ্গেলস’এর বাবার মালিকানাধীন ‘এরমেন অ্যান্ড এঙ্গেলস’ টেক্সটাইল মিল’-এর পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কার্ল মার্ক্সও পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে লড়তে পারতেন না” বলতে বলতে, শাসকের মৃদু বিরোধিতা করে শাসকাশ্রিত প্রোমোটারের থেকে আর একটু সুবিধা নেবেন, তাও অস্বাভাবিক নয়।
মাইক ডেভিস-এর প্ল্যানেট অব স্লামস বলে একটা বই আছে। অনেকের কাছে, ওই বইটাই এঙ্গেলস’এর দ্য কন্ডিশন অব দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস-এর নতুন সংস্করণ, কারণ গুয়াংডং বা শাংহাই-এর ‘স্পেশাল ইকনমিক জ়োন’ এর সঙ্গে ঊনবিংশ শতাব্দীর ম্যানচেস্টার বা গ্লাসগোর অসম্ভব মিল। ঠিক তেমনই মিল অত্যাচার নেমে আসা প্রতিটি জনপদ এবং অত্যাচার হচ্ছে দেখেও চুপ থাকা সুবিধাভোগীদের মধ্যে।
ছোটবেলায় পুকুরের মাছ চুরি যাওয়ার গল্প শুনতাম। এখন শুনি রাতের অন্ধকারে পুকুরে ফলিডল দেওয়ায় সকালে মরা মাছ ভেসে উঠেছে পুকুর জুড়ে। চুরি করে কোনও জিনিসের স্বাদ নেওয়ার মধ্যেও কোথাও একটা নান্দনিকতা আছে। চোরকে নিয়ে গল্প কিংবা গান হয় তাই। কিন্তু জল্লাদদের নিয়ে তো তা হতে পারে না। পুকুরভর্তি জ্যান্ত মাছ দেখে ফলিডল ঢালতে যাদের দু’বার ভাবতে হয় না, পাকা ধানের খেতে নোনা জল ঢুকিয়ে দেয় যারা, হাতে পারমাণবিক বোমা থাকলে তারা আর একটা হিরোশিমাকে ধ্বংস করতে পারত।
শঙ্খ ঘোষ, ক্ষমতার মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন, “যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন দিয়েছি নরক করে”। সমাজের ভিতর থেকে চেতনার ঐকমত্য তৈরি না হলে, প্রতিবাদী-নির্বিবাদী সবার জন্যই, রৌরব অপেক্ষা করে আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy