—ফাইল চিত্র।
মানুষ কী ভাবে বাঁচে, তা সবচেয়ে ভাল টের পাওয়া যায় শীতকালে।” বেশ কয়েক বছর আগের এক সন্ধেয় এক মাঠে বসে কথাটি বলেছিলেন আশি ছুঁইছুঁই এক অবসরপ্রাপ্ত মাস্টারমশাই। বলেছিলেন, “এই যে পুরনো চামড়াটা ফেটে গিয়ে নতুন চামড়া উঠে আসছে খোলস বদলের মতো করে, এর মানে কী জানিস? শীত পেরোলে আমি একটা নতুন মানুষ। তার নতুন শরীর। শীত মানে তো একটা লড়াই। এই লড়াইটার পুরস্কার হিসাবেই শীত যাওয়ার সময় আমাদের এই নতুন শরীরটা দিয়ে যায়।”
কথাটি তিনি বললেন যেখানে বসে, তার কাছাকাছির মধ্যে ধানের বীজতলা করা হয়েছে। মাথার উপর তারায় ভর্তি আকাশ। রূপকথার গল্প পড়ে জেনেছি, আজীবন মরে যাওয়া মানুষ-পশু-পাখিরা সেই আকাশে আলো করে তারা হয়ে রয়েছে। মাঝে-মাঝে কাছের নদীর দিক থেকে ভেসে আসা উত্তুরে বাতাস আকাশটাকে আরও সংযমী করে দিচ্ছে। এত দিন পরে কথাগুলো যদি এক বার ফিরে দেখি, তা হলে টের পাই, এর ভিতরে অনন্ত বিষাদের সঙ্গেই রয়ে গিয়েছে গুলিবিদ্ধ হওয়ার বেদনাও। যা আমাদের ফের মনে করিয়ে দেয়— নলেন গুড়, ভিক্টোরিয়া, পৌষমেলার ঋতু তো বটেই; তার সঙ্গেই, শীতকাল আসলে একটি ধারণাও।
প্রতিটি ধারণার এক বা একাধিক নিজস্ব ভাষা থাকে। যে ভাষার মধ্যেও আবার লুকিয়ে থাকে না-ভাষার নন্দনতত্ত্ব। যা, আসলে নৈঃশব্দ্য। বছরের শুরুতেই সেই নৈঃশব্দ্যের ধূসর চিত্রটি স্বতন্ত্র হয়ে উঠল এক কবির মৃত্যুতে। এক ঘর বইয়ের ভিতর ঘোলাটে ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে ছিলেন কবি দেবারতি মিত্র, তাঁর মৃত্যুর কয়েক দিন আগে— কথাটি জানতে পেরেছিলাম সমাজমাধ্যমের এক বন্ধুর পোস্ট থেকে। এই দৃশ্যের কাছে এসে আমাদের সারা জীবনের জ্যোৎস্না স্তব্ধ হয়ে যায় মুহূর্তেই। নাভিমূল থেকে ওঠে দীর্ঘশ্বাস— কবির চোখের যা কিছু স্বপ্ন-সাধ, তা ছাদ ফুঁড়ে এসে খেয়ে নিচ্ছে ইগল।
তবে, সবটা কি সেই ইগল পাখি খেয়ে যেতে পারল? মনে হয়, কবিতার দীর্ঘ ছায়াকে আড়াআড়ি ভাবে পাশে শুইয়ে, চোখ থেকে ক্রমে সব জরুরি চিহ্ন ফুরিয়ে আসছে এ কথা জেনেই, কী এক অটুট পিপাসা নিয়ে সকলের অজানতেই চেষ্টা করে চলেছিলেন তিনি সংযোগ স্থাপনের, ওরহান পামুক যে সংযোগের কথা বলেছিলেন— ঈশ্বর কবির মাধ্যমে কথা বলেন। ঘরের ছাদের দিকে চেয়ে সেই এক অতলের খোঁজই করে চলেছিলেন তিনি, যা ঢেউয়ের মতোই কবির কাছে ফিরে আসে কখনও, কোনও এক অভিমান নিয়ে তার পর ফিরে যায় বার বার। জানলার বাইরের পৃথিবীতে নিজেদের মতো চলাফেরা করল বন্ধু ও শত্রুরা, খানিকটা সূর্যের আলোও এল হয়তো। জীবনের শেষ ক’টা দিন জেগে থেকেও সে সব তাকিয়ে দেখলেন না কবি আর।
সত্যিই কি দেখলেন না? না কি, স্বেচ্ছায় গ্রহণ করলেন এমন এক অন্ধত্বের আস্তরণ, যা কেবল দেখার বাইরের দেখাকেই খোলস ছাড়িয়ে হাজির করবে তাঁর সামনে? দেখার বাইরের দেখাটুকুর জন্য, এক জীবন জুড়ে নানা স্পর্শ ও হাহাকারের মধ্য দিয়ে তাকে নিখুঁত ভাবে চিনে নিতে পারার জন্যই তো কবি-জীবন। নিঃসঙ্গ, একা, শিশুর স্বপ্নের মতো, নতুন নক্ষত্রের জন্মের মতো সেই জীবন। মৃত্যুর আগের ওই দিনগুলোয় তাঁর দেখার পথ জুড়ে কবি দেবারতি মিত্র কত দূর ফেলে রেখেছিলেন রুদ্ধ কপাট, তা জানা গেল না। বাংলা ভাষার পাঠকরা শুধু জানলাম, কবির মৃত্যুর এক প্রবল ভার পড়ে রইল আমাদের জন্য। যে ভার পিঠে নিয়েই বাগানে এসে হাজির হল সাদা ঘোড়া, বইমেলা।
কবির মৃত্যুর পর বইমেলা এল, এমনটা নতুন নয়। ছ’বছর আগে কবি সুপ্রভাত রায়ের মৃত্যুর কথা মনে পড়ে। বইমেলার শীত এবং সেই শীতে কবির দরজায় এসে হাজির হওয়া মৃত্যুকে মনে হয় রামকিঙ্করের ভাস্কর্য, যার নির্মম নিখুঁত প্রতিভায় বুক কেঁপে যায় বার বার! তবু, বইমেলা আসে শীতের স্বাভাবিক নিয়মেই। বইমেলা আমাদের কী দিল? বই পড়ার চেয়েও তা আরও বেশি করে যা দিল, তা আসলে নানা ধরনের বন্ধুত্ব। এক বইমেলায় তাদের সঙ্গে চা-কফি খাওয়া হয়। ঠিক হয়, পরের বইমেলায় ফের ধুলো ঘেঁটে বার করে আনা হবে অভিমানের অপরাজিত পাণ্ডুলিপি। তার পর দেখা যায়, আর কারও সঙ্গে কখনও দেখা হল না। একটু বয়স বাড়লে বোঝা যায়, বন্ধুদের চেয়েও আসলে বেশি কাছের বন্ধুত্বের সে সব স্মৃতিই! বইমেলার মাঠে সারা দিন সারা রাত জুড়ে আঁকাবাঁকা পড়ে রইল যার চিহ্ন। সকলকে কথা দিয়েও একা হয়ে যাওয়া কোনও অতি পুরনো এবং বোকা বন্ধু ধুলোবালি পেরিয়ে মায়াবী মাটি থেকে বন্ধুদের স্মৃতির সেই বিপুল সংসার কুড়িয়ে নিতে গিয়ে বিস্কুটের দাম দিতে ভুলে যায়। বই কিনবে বলে স্টলে ঢুকেও, পয়সা নেই বলে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এল যে তরুণ, সে আর ওই বোকা বন্ধু তার পর বইমেলার আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে থম মেরে। তাদের দেখা হবে না। তাদের কথা হবে না। তবু, দু’জন দু’রকম যন্ত্রণার প্রাথমিক সমাধান খুঁজবে বলে দাঁড়িয়ে থাকবে পাশাপাশি। এও তো বইমেলা!
সুখী রাষ্ট্রের অজস্র মৃত মানুষের মতো মন্দির বানানোর হল্লায় শামিল না হয়ে নানা আলোকিত জেদি মানুষের বইয়ের কাছে ফিরে আসাও তো বইমেলা! পুরনোকে ভালবাসা দিয়ে ভরসা দিয়ে নতুন করে নেওয়ার উৎসব। মৃত্যু-হিম শীতের মধ্যেও আলো জ্বেলে রাখার উৎসব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy