Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
বিরোধী দলের নেতাদের জন্য বিজেপির দরজা খোলা কেন
BJP

ভয় আছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষাও

অশোক চহ্বাণ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কংগ্রেসের এই প্রবীণ নেতা মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বাবা শঙ্কররাও চহ্বাণ ছিলেন রাজীব গান্ধী সরকারের অর্থমন্ত্রী।

bjp

নতুন: বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীসের সঙ্গে অশোক চহ্বাণ। মুম্বই, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪। ছবি: পিটিআই।

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৭:৫৭
Share: Save:

সাধারণত কোনও কংগ্রেস নেতা দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আগে নিজের মোবাইল বন্ধ করে দেন। তাঁকে কোনও ভাবেই ফোনে পাওয়া যায় না। তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের মাধ্যমেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না। কোনও ভাবেই কংগ্রেস নেতাদের পক্ষে তাঁকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে রাখা আর সম্ভব হয় না।

অশোক চহ্বাণ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কংগ্রেসের এই প্রবীণ নেতা মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বাবা শঙ্কররাও চহ্বাণ ছিলেন রাজীব গান্ধী সরকারের অর্থমন্ত্রী। পি ভি নরসিংহ রাওয়ের সরকারের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন তিনি। অশোক চহ্বাণ দীর্ঘ দিন মহারাষ্ট্রের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন। নানদেদ থেকে সাংসদও হয়েছিলেন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপির কাছে হারেন।

অশোক চহ্বাণ বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আগে নিজের মোবাইল বন্ধ করে দেননি। কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগও বন্ধ করেননি। উল্টে দিল্লিতে এসে সরাসরি কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজন সারেন। সেখানেই তাঁর বিজেপিতে যোগ দেওয়ার কথা জানান। কংগ্রেসের অন্দরমহলের দাবি, চহ্বাণ খড়্গেকে জানিয়েছিলেন, তিনি আর ইডি-সিবিআইয়ের চাপ নিতে পারছেন না। আদর্শ আবাসন দুর্নীতির মামলায় নতুন করে সিবিআই, ইডি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অর্থনীতি নিয়ে মোদী সরকার সংসদে যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল, তাতেও আদর্শ কেলেঙ্কারি তুলে ধরা হয়েছে। দুই মিলিয়ে যে কোনও দিন গ্রেফতারির আশঙ্কা করছেন তিনি। একমাত্র উপায়, বিজেপিতে যোগ দেওয়া।

কংগ্রেসের দাবি ভুল হতেই পারে। তবে এতে কোনও ভুল নেই যে, অশোক চহ্বাণ বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। যে বিজেপি তাঁকে গত লোকসভা নির্বাচনে নানদেদ থেকে হারিয়ে সংসদে আসার রাস্তা বন্ধ করেছিল, সেই বিজেপিই এ বার তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠাচ্ছে।

প্রশ্ন হল, কেন? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জন্য ৩৭০ আসনে জয়ের লক্ষ্য রেখেছেন। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী, এনডিএ লোকসভায় ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ৪০০টি আসন জিততে চলেছে। উল্টো দিকে, বিরোধী শিবির এখনও ঘর গুছিয়েই উঠতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী পদে মোদীর বিকল্প কে, এই প্রশ্নের উত্তর এখনও ‘ইন্ডিয়া’ নামক বিরোধী মঞ্চের কাছে নেই। বিরোধীদের হালচাল দেখে মনে হচ্ছে, তাঁরাও ধরে নিয়েছেন যে, আগামী লোকসভা ভোটে জিতে নরেন্দ্র মোদী তৃতীয় বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন।

এখানেই প্রশ্ন। বিজেপি যখন এতটাই নিশ্চিত, তখন আদর্শ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত অশোক চহ্বাণকে সাদরে বিজেপি-তে ডেকে নিয়ে গিয়ে রাজ্যসভায় পাঠাতে হয় কেন? কেনই বা মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে বিজেপির কাছে পরাভূত কংগ্রেসের কমল নাথ রাজ্যসভায় যেতে না পেরে অসন্তুষ্ট জেনে বিজেপি তাঁকে দলে টানতে ঝাঁপিয়ে পড়ে? কেন নীতীশ কুমারের জন্য বিজেপির দরজা বন্ধ বলে অমিত শাহ ঘোষণা করার পরেও নতুন করে তাঁর হাত ধরতে বিজেপি পিছপা হয় না? কেন যোগী আদিত্যনাথ থাকা সত্ত্বেও উত্তরপ্রদেশের জাঠ বলয়ে সীমাবদ্ধ জয়ন্ত চৌধরিকে ইন্ডিয়া জোট থেকে ভাঙিয়ে আনতে তাঁর পিতামহ চৌধরি চরণ সিংহের জন্য ভারতরত্ন ঘোষণা করা হয়? কেন বিজেপিকে মতাদর্শের বাছবিচার না করে এনসিপি-র অজিত পওয়ার থেকে উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা থেকে একনাথ শিন্দেকে ভাঙিয়ে আনতে হয়? নির্দিষ্ট মতাদর্শের ভিত্তিতে তৈরি বিজেপির দরজা কেন সর্বদাই তৃণমূল থেকে এসপি, কংগ্রেস থেকে বিএসপি নেতাদের জন্য খোলা থাকে?

এর দু’টি সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে। এক, যে যা-ই ধরে নিক, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ নিজেরা জয়ের বিষয়ে নিশ্চিত নন। মুখে বিশ্বগুরু ভারতের কথা বললেও তাঁরা জানেন, সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। রোজগার থেকে চাকরির সুযোগ, সবেতেই সমস্যা রয়েছে। কারণ, সমাজের উপরের অংশের মানুষ ফুলে-ফেঁপে উঠলেও অর্থনীতির নিচুতলার মানুষ আরও সমস্যায় ডুবে যাচ্ছেন। দুই, মোদী-শাহ আর যেন তেন প্রকারেণ জয় চাইছেন না। তাঁদের লক্ষ্য লোকসভার দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়। লোকসভায় ৫৪৫টি আসনের মধ্যে ৩৭০টি আসন জেতার লক্ষ্য টপকে যাওয়া। যাতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা হোক বা ‘এক রাষ্ট্র, এক ভোট’ কার্যকর করা, সংখ্যালঘুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তুলে দেওয়া হোক বা উপাসনাস্থল আইন সংশোধন করে কাশী-মথুরাতেও মসজিদ-ইদগার জায়গায় মন্দির তৈরির রাস্তা খোলা হোক— কোনও ক্ষেত্রেই যাতে অসুবিধা না হয়। তাঁরা যাতে বুক ঠুকে বলতে পারেন, যা-ই করুন না কেন, মানুষের রায় তাঁদের সঙ্গে রয়েছে।

সম্ভবত এই দু’টিই সঠিক উত্তর। বিজেপি দেশের গরিব-নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের আর্থিক দুরবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আবার বিজেপি ৩৭০ আসনে জিততেও মরিয়া। তাই শুধু নিজের শক্তির উপরে ভরসা না করে কংগ্রেস থেকে এনসিপি, সব দলের দিকে হাত বাড়িয়েই আছে বিজেপি।

ঠিক এক সপ্তাহ আগের কথা। প্রধানমন্ত্রী সে দিন তাঁর নিজের রাজ্য গুজরাতের আমদাবাদে। চাষিদের জন্য তাঁর সরকার গত দশ বছরে কী কী করেছে, গ্রামের গরিব মানুষের জন্য কী কী কাজ হয়েছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি। সে দিনই দিল্লিতে আর্থিক বিশ্লেষক সংস্থা ইন্ডিয়া রেটিংস অ্যান্ড রিসার্চের অর্থনীতিবিদরা দেশের অর্থনীতির হাল নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, ভারতের অর্থনীতি এখনও বাজারের চাহিদা বা কেনাকাটার খরচের উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু বাজারে এখন যে চাহিদা, তা শুধু আয়ের দিক থেকে উপরের সারিতে থাকা জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষের দিক থেকে আসছে। ধনীরাই বাজারে খরচ করছেন। নিচুতলার মানুষের চাহিদা নিম্নমুখী। তাই জামাকাপড়, আসবাব, বৈদ্যুতিন পণ্যের মতো জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়ছে না। চার চাকা গাড়ির বিক্রি বাড়ছে। গরিব, নিম্নবিত্তের ভরসা মোটরবাইক, স্কুটারের বিক্রি কমছে। রেলের যাত্রী বাড়ছে না। বিমানের যাত্রী বাড়ছে। মধ্যবিত্তের আয়ত্তের মধ্যে থাকা ৫০ লক্ষ টাকা বা তার কম দামের ফ্ল্যাটের বিক্রি কমছে। কিন্তু ২ কোটি থেকে ৪ কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল আবাসনের বিক্রি বাড়ছে। এর কারণ হল, গরিব, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের আয় বাড়ছে না। মূল্যবৃদ্ধির নিরিখে ধরলে বাস্তবে আয় কমছে। সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, ২০২২-এর তুলনায় ২০২৩-এ অফিস-কারখানায় নতুন চাকরির সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে। চাকরির বাজারে কতখানি হাহাকার, তার প্রমাণ হল, গত সপ্তাহে উত্তরপ্রদেশে পুলিশ কনস্টেবল পদে ৬৭ হাজার চাকরির জন্য ৪৮ লক্ষ চাকরিপ্রার্থী পরীক্ষা দিয়েছিলেন।

নিচুতলার এই অসন্তোষ শুধু রামরাজ্যের স্বপ্নে ধামাচাপা পড়ে যাবে ভেবে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। তাই বিজেপি আর কোনও ঝুঁকি নিতে চাইছে না। বিজেপির প্রধান শক্তি দলের সংগঠন। ৯৬ কোটি ভোটার এ বার ভোট দেবেন। বিজেপি গত লোকসভা নির্বাচনে ২৩ কোটি ভোট পেয়েছিল। এ বার বিজেপি ১০ লক্ষ বুথের প্রতিটিতে ৩৭০টি করে ভোট পাওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে। অর্থাৎ, মোট ৩৭ কোটি ভোটের লক্ষ্য। এর অর্ধেক পেলেই বিজেপি ৩৭০ আসনের লক্ষ্য ছুঁয়ে ফেলতে পারে। হিন্দি বলয়ের উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান থেকে মহারাষ্ট্র, গুজরাতের মতো রাজ্যে এমনিতেই গত লোকসভা ভোটে সিংহভাগ আসনে জিতেছিল বিজেপি। সেখানে আসন বাড়ার জায়গা কম। সেই একটি, দু’টি, তিনটি বাড়তি আসন নিশ্চিত করতে কোথাও অশোক চহ্বাণ, কোথাও জয়ন্ত চৌধরিকে কাছে টানছে বিজেপি। পূর্ব ভারতে নীতীশ কুমার থেকে দক্ষিণে এইচ ডি দেবগৌড়া-কুমারস্বামী, সকলের জন্যই দরজা খোলা।

ডিগবাজি শুধু নীতীশ-জয়ন্তরাই খাচ্ছেন না। বিজেপি নিজেও ৩৭০-এর লক্ষ্যে ডিগবাজি খাচ্ছে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy